‘কলম’ সত্য প্রতিষ্ঠা আর মিথ্যা বিতাড়নের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার
১১ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১১ মে ২০২৪, ১২:০৫ এএম
মানব সৃষ্টির পর মানুষের শিক্ষার প্রসঙ্গটি উল্লেখিত হয়েছে। কারণ, শিক্ষাই মানুষকে অন্যান্য জীবজন্তু থেকে স্বতন্ত্র এবং সৃষ্টির সেরা রুপে চিহ্নিত করে। শিক্ষার পদ্ধতি সাধারণতঃ দ্বিবিধ। (এক)- মৌখিক শিক্ষা এবং (দুই)- কলম ও লেখার মাধ্যমে শিক্ষা। পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরা আলাক -এর শুরুতে ইকরা শব্দের মধ্যে মৌখিক শিক্ষা রয়েছে। কিন্তু উক্ত সূরা -এর চতুর্থ আয়াতে শিক্ষাদান সম্পর্কিত বর্ণনায় কলমের সাহায্যে শিক্ষাকেই অগ্রে বর্ণনা করা হয়েছে। কলম হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা’র প্রদত্ত একটি বড় নিয়ামত। যাঁরা কলমকে সত্য ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তারা দুনিয়াতে হাজার বছর বেঁচে থাকেন। কলম না থাকলে পৃথিবীতে কোন কিছুই প্রতিষ্ঠিত হতো না। দুনিয়ার কায়-কারবারও সঠিকভাবে পরিচালিত হতো না। দয়াময় প্রভু মানবজাতিকে অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় করে সৃষ্টি করে তাদের হাতে কলম উঠিয়ে দিয়েছেন। আর এ কলমের সাহায্যেই তারা শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি, বিজ্ঞান, শিল্প-কলা, তথ্য-প্রযুক্তি লিখে দিন দিন আধুনিকতার চরম উন্নতির শিখরে আরোহণ করছে। কলমকে বলা হয় হৃদয়ের জিহবা, জড় জগতের সবচেয়ে সম্মানী বস্তু। মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে ইহা অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। এর শক্তি অপরিসীম। ইহা এক প্রচন্ড দ্রোহ, শাণিত কৃপাণ, অসত্যের বিরুদ্ধে এক বজ্রকঠিন হাতিয়ার। টেইলর বলেছেন, কলম হলো যন্ত্রপাতির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক। ইহা তরবারীর চেয়েও ধারালো, চাবুক বা লোহার ডান্ডার চেয়েও ভয়াবহ।
হযরত আবু হোরায়রা (রা.)- এর রেওয়ায়েতক্রমে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা যখন আদিকালে সবকিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে তাঁর কাছে রক্ষিত কিতাবে একথা লিপিবদ্ধ করেন যে, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে। হাদীসে আরও বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকে লেখার নির্দেশ দেন। সেমতে কলম কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সব লিখে ফেলে। এ কিতাব আল্লাহর কাছে আরশে রক্ষিত আছে। (কুরতুবী)। সূরা আলাক -এর চতুর্থ আয়াতে ছিল কলমের সাহায্যে শিক্ষাদানের বর্ণনা। আর পঞ্চম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রকৃত শিক্ষাদাতা আল্লাহ তাআলা। তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে অসংখ্য, অগণিত শুধু কলমের মধ্যেই সীমিত নয়। তাই বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে পূর্বে জানত না। এতে কলম অথবা অন্য কোন উপায় উল্লেখ না করার মাঝে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার এ শিক্ষা মানুষের জন্মলগ্ন থেকে অব্যাহত রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে অজ্ঞাত বিষয়সমূহের জ্ঞানদান করে ধন্য করেছেন এবং তাদেরকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে টেনে নিয়ে এসেছেন। তিনি মানুষকে লিখন বিদ্যার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কেননা, যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের ইতিহাস, জীবনালেখ্য ও উক্তি, আল্লাহ তাআলার অবতীর্ণ কিতাবসমূহ যাবতীয় বিষয়াদিই কলমের সাহায্যে লিখিত হয়েছে এবং পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষয় হয়ে থাকবে। কলম সৃজিত না হলে ইহকাল ও পরকালের সবকাজ কর্মেই বিঘিœত হতো। কলমের একটি মাত্রই কাজ; আর তা হলো লেখা। চার্লস গ্রভিল বলেছেন, ‘একটি কলমের সাহায্যে যেভাবে হৃদয়ের কথা উৎসারিত হয়, তেমনি আর কিছুতেই হয় না’। যিনি কলমের সাহায্যে সমাজের যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার, জুলুম-অনাচার ও নির্যাতন-নিপীড়ন দূর করতে চান তাকে হতে হয় সত্যের পক্ষে অকুতোভয় সৈনিক। তাকে মোকাবিলা করতে হয় নিদারুণ দুঃখ-মুসিবত, চলতে হয় নিঃসীম অন্ধকার পথে-ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের উপর দিয়ে, পার হতে হয় কাঁটাবনের ঠিক মাঝখান দিয়ে, বন্ধু করে নিতে হয় ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর অভাব-অনটনকে। পৃথিবীর বড় কলম সৈনিকদের জীবনেতিহাস পাঠ করলে আমাদের সামনে উপরোক্ত চিত্রগুলোই ফুটে উঠে। আল্লামা ইকবাল, জর্জ বানার্ড ‘শ, কাজী নজরুল ইসলাম, ইমাম গাযালি, ইবনে তাইমিয়া, আল ফারাবি, শেখ সা’দী প্রমুখের সংগ্রামী জীবন এবং তাদের ক্ষুরধার লেখনীই বিশ্ব সভ্যতাকে অজ্ঞতার তিমির থেকে টেনে তুলে আলোর সোনালি দিগন্তে নিয়ে আসে। যে কলম দেশাত্মবোধ, মানবতা, উদারতা, মহানুভবতা প্রতিভার বিকাশ সাধন করে মানুষের সঠিক পরিচয় তুলে ধরে প্রভুর সাথে যথাযথ সম্পর্ক তৈরি করে দিতে পারে না, সে কলম ধারালো কলম নয়; সে কলম ভোঁতা কলম, অকেজো কলম।
যে কলম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করে তামাম দুনিয়ার মানুষকে শান্তির সামিয়ানায় এনে দাঁড় করায়। যে কলম নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, সর্বহারা, দিশেহারা ও হতাশাগ্রস্তদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠভূমিকা রাখে; সে কলমই নৈতিক কলম, কল্যাণকামী কলম, সংগ্রামী কলম। আর এ কলমই সমাজের বিনির্মাণের শাণিত হাতিয়ার, এমন এক সম্মোহনী শক্তি যার শক্তি হাজারো তরবারী থেকেও ধারালো। কলমকে যদি প্রকৃতির ভাষা হিসেবে নিরূপণ করা যায় তাহলে এর সাহায্যে প্রকৃত শৈল্পিকসৌন্দর্য ফুটে উঠবে। জ্ঞানী সম্প্রদায় বলেন, ‘জগতে তিনটি কলম আছে। ১) আল্লাহ তাআলার কুদরতী হস্তে সৃজিত কলম, একে তিনি তাকদীর লেখার কাজে আদেশ করেছিলেন। ২) ফেরেশতাদের কলম, যা দ্বারা তারা ভবিতব্য ঘটনা, তার পরিণাম এবং মানুষের আমলনামা লিপিবদ্ধ করেন। ৩) সাধারণ মানুষের কলম : যা দিয়ে তারা নিজেদের কথা-বার্তা, অর্জিত জ্ঞান, ভাবাবেগ, চিত্ত চেতনার কথা লেখে এবং নিজেদের অভিষ্ট কাজে ব্যবহার করে’। লিখন প্রকৃতপক্ষে এক প্রকার বর্ণনা এবং বর্ণনা মানুষের এক বিশেষ গুণ যা আল্লাহ্পাক প্রদত্ত। প্রখ্যাত তাফসীরবিদ মোজাহিদ আবু আমের বলেন, ‘মহান আল্লাহ্পাক চারটি বস্তু স্বীয় কুদরতী হস্তে সৃষ্টি করেছেন। এ চারবস্তু ব্যতীত সমগ্র সৃষ্টিজগৎ ও বস্তুসমূহ ‘কুন’ -তথা হয়ে যাও আদেশের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর স্বহস্তে সৃজিত চারটি বস্তু হলো-কলম, আরশ, জান্নাতুল আদন ও হযরত আদম (আ.)।
মনীষীরা বলেছেন, ‘বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র। তাই কলমকে বানাতে হবে সত্যের প্রতিষ্ঠা আর মিথ্যা বিতাড়নের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে। ন্যায়ের পক্ষে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এটা হবে ধারালো অস্ত্র। নীতির প্রতিষ্ঠা আর দুর্নীতি নির্মূল করণের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এ কলমই পারে মননশীল সাহিত্য রচনার মাধ্যমে জাতিকে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে, দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা আলাক ৪-৫) রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ্ তাআলা যখন আদিকালে সবকিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে তার কাছে রক্ষিত কিতাবে একথা লিপিবদ্ধ করেন যে, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে। ইবনে মুবারক (রহ.) বলেন, ‘সত্যিকার জ্ঞানী হতে হলে সর্বদা নিজকে জ্ঞান অন্বেষণে মগ্ন রাখতে হবে। আর যে নিজকে জ্ঞানী ভেবে নেয় সে প্রকৃত জ্ঞানী নয়, সে মূর্খ। হযরত ঈসা (আ.) বলেন, ‘অসৎ জ্ঞানীর উপমা সেই পাথরের ন্যায় যেটি ঝর্ণার মুখে পড়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়; সে নিজেও পানি পান করে না এবং শস্য ক্ষেতেও পানি যেতে দেয় না। হযরত সুফিয়ান সওরী (রহ.) বলেন, ‘এলেম চিৎকার করে আমলের আহবান জানায়, তার দাবি এ আহবানে সাড়া দিলে এলেম থাকে, অন্যথায় বিদায় নিয়ে চলে যায়। আর কলমই হলো জ্ঞান লিখার একমাত্র মাধ্যম।
বর্তমান পৃথিবীতে যাদের কলমের জোর বেশি তারাই শক্তিশালী। বিশ্ব চলে তাদের দাপটে, পৃথিবীকে মেনে নিতে হয় তাদের কর্তৃত্ব। একসময় মুসলমানদের কলমের শক্তি ছিল প্রবল। তারা তাদের কলমের আঁচড়ে সারা পৃথিবীকে আলোয় আলোকিত করে তুলেছিল। তাদের দোয়াতের কালিতে লেখা হয়েছে জ্ঞান- বিজ্ঞানের সবগুলো অধ্যায়। অধুনা পৃথিবী আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাদের গৌরব-গাথা, কৃতিত্বের কথা,তাদের ক্ষুরধার লিখনীর কথা। কেননা তাদের কলমের ধারালো লিখনীই পৃথিবীকে করে তুলেছে উদ্ভাসিত ও দীপ্তিময়। এভাবে যতদিন মুসলমানদের হাতে কলম ছিল ততদিন পৃথিবীবাসী তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। আর এখন তারা কলম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভোগ-বিলাস আর আরাম-আয়েশের জিন্দেগী শুরু করার মাধ্যমে নিজেদের ললাটে অপমান আর জিল্লতির কলঙ্কটীকা নিজেরাই লিখে দিয়েছে। তাই পৃথিবীর সর্বত্রই শোনা যায় তাদের গগনবিদারী আর্তচিৎকার, তাদের রাঙ্গা খুনে রঞ্জিত হচ্ছে সবুজ-শ্যামল পৃথিবী। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো আবার কলম হাতে নেয়া। হারানো গৌরবগুলো পুনরুদ্ধার করা। জাতির এ ক্রান্তিকালে জ্ঞানীর গবেষণা যেন থেমে না যায়, কলমের কালি যেন শুকিয়ে না যায়, জবান যেন স্তব্ধ হয়ে না যায়।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বেতন পেয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করল বেক্সিমকোর শ্রমিকেরা
লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ৪৭
ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য মনোনীত দুই সদস্যের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ
ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়ী পার্টনার চাই : টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস
আদানির দুর্নীতি : এবার ভারতেই বির্তকের মুখে মোদি সরকার
প্রেসিডেন্টর সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ
নিজ্জর হত্যায় মোদীর সংশ্লিষ্টতার দাবি কানাডার সংবাদমাধ্যমের ,‘হাস্যকর’ দাবি ভারতের
পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে গুলি, নিহত ৪২
এক সপ্তাহে রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হচ্ছে : পুতিন
মুরগি-সবজিতে কিছুটা স্বস্তি, আলু এখনো চড়া
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ
পার্থে শুরুতেই চাপে ভারত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা
সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমীরের কুশল বিনিময়
সিঙ্গেল সিটের দাবিতে গভীর রাতেও হলের বাইরে ছাত্রীরা
ইসরাইলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪৪ হাজার অতিক্রম করলো
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন অ্যার্টনি জেনারেল পাম বন্ডি
‘আ.লীগকে রাজনীতিতে সুযোগ দেওয়া মানে শহীদদের সঙ্গে গাদ্দারি করা’