সূর্যঘড়ি নির্মাণকারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবনে আশ শাতির

Daily Inqilab আকাশ হাসান

২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০৪ এএম | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০৪ এএম

আবুল হাসান আলাউদ্দীন আলী ইবনে ইবরাহীম আল আনসারী বা সংক্ষেপে ইবনে আশ শাতির বা ইবনে আশ শাতির (১৩০৪-১৩৭৫খ্রি.) ছিলেন একজন আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও প্রকৌশলী। তিনি দামেস্কের উমাইয়া মসজিদে একজন মুওাক্কিত (সালাতের সময়গুলো নির্ধারণের জন্য নির্ধারিত ব্যক্তি) হিসেবে কাজ করতেন এবং ১৩৭১ বা ১৩৭২ সালে তিনি মসজিদের মিনারের জন্য একটি সূর্যঘড়ি তৈরি করেন।

ইবনে আশ শাতির ছয় বছর বয়সে পিতৃহারা হন। এরপর তিনি দাদার কাছে লালিত পালিত হন। তার কাছ থেকেই তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে আকর্ষিত হন। ইবনে আশ শাতির শিক্ষা অর্জনের জন্য কায়রো এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় যান। আবু আলী আল মাররাকুশি এর কাছে পড়াশোনা সমাপ্ত করে তিনি দামেস্কে ফিরে যান। এসময় উমাইয়া মসজিদে মুওাক্কিত হিসেবে তিনি নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তার মুওাক্কিত হিসেবে কাজের মধ্যে ছিলো দৈনিক পাঁচবার সালাতের সময় ও রমজান মাসের শুরু ও শেষ কবে তা নির্ণয় করা। এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে তিনি বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক যন্ত্র তৈরি করেন। তিনি নানা জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন এবং গাণিতিকভাবে তা মিলানোর চেষ্টা করেন। যা মসজিদের কাজের পাশাপাশি তার নিজের গবেষণাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তিনি তার এই গবেষণা একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ছক আকারে লিখে রাখেন। যদিও এই ছক কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর লেখা ইবনে আশ শাতিরের লেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘আল কিতাব নিহায়াত আল সুল ফি তাসহিহ আল উসুল’ (প্রচলিত নিয়মের সংশোধনের জন্য শেষ অভিযান)। এই বইয়ে তিনি ক্লডিয়াস টলেমী (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০-১০০) এর মডেলের চাঁদ, সূর্যের ও গ্রহের গতিপথের একটি বিরাট অংশ সংশোধন করেন। এখানে তিনি অতিরিক্ত এপিসাইকেল (Epicycle) সরিয়ে সেখানে তুসি যুগলের ব্যবহার করেন। তার এই মডেলটি পরবর্তীতে ১৬ শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) এর মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে ইবনে আশ শাতিরের নাম উচ্চারিত হয় না। যদিও ইবনে আশ শাতিরের এই কাজটি ‘জুয আল জাদীদ’ (নতুন গ্রন্থ) –এ প্রকাশ করা হয়েছে কোপার্নিকাসের জন্মের প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে।

পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাথে ইবনে আশ শাতিরের কিছুটা পার্থক্য ছিল। যেমন- পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের হিসাব মিলাতে চেষ্টা করছিলেন দর্শনের ভিত্তিতে এবং অ্যারিস্টটল (খ্রীষ্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) এর জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে। অন্যদিকে ইবনে আশ শাতির হিসাব মিলিয়েছিলেন বাস্তব জগতের প্রাপ্ত তথ্য থেকে। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে আশ শাতিরের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ফলেই তিনি ক্লডিয়াস টলেমী (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০-১০০) এর মডেল হতে একটি এপিসাইকেল সরিয়ে দেন। এর ফলে পূর্বে দেওয়া যে কোনো মডেলের তুলনায় ইবনে আশ শাতিরের মডেল উন্নত প্রকৃতির ছিল। এটিই প্রথম মডেল ছিল যা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরীক্ষা করা সম্ভব ছিল। তার এই কাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানের শাখায় একটি বিপ্লব ঘটিয়েছিল। যাকে ‘রেনেসাঁ যুগ পূর্ববর্তী বৈজ্ঞানিক বিপ্লব’ বলা যেতে পারে।

যদিও ইবনে আশ শাতিরের মডেলকে পৃথিবীর প্রথম মডেল হিসেবে ধরা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এর থেকে ইটালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। ইবনে আশ শাতির যে পদ্ধতিতে ক্লডিয়াস টলেমী (খ্রীষ্টপূর্ব ১৮০-১০০) এর মডেলকে সংশোধন করেছিলেন। নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) এর বই ‘De revolutionibus’ ঠিক সে উপায়ই ছিল। কোপার্নিকাসের দেওয়া চন্দ্র ও শুক্রগ্রহের গতিপথ, ইবনে আশ শাতিরের মডেলের সাথে মিলে যায়। এসকল কারণে কিছু কিছু পণ্ডিত বলে থাকেন, কোপার্নিকাসের কাছে ইবনে আশ শাতিরের কাগজগুলো কোনোভাবে পৌঁছেছিল। কিছুকাল আগে বাইজেন্টাইনদের সময়কালে ইবনে আশ শাতিরের কাজের ন্যায় কাজ সমৃদ্ধ একটি পান্ডুলিপি ইতালি থেকে উদ্ধার করা হয়। এর ফলে ধারণা করা হয়, যখন পূর্ব থেকে জ্ঞান ধীরে ধীরে পশ্চিমে যাচ্ছিলো তখন কোপার্নিকাসের হাতে আসে ইবনে আশ শাতিরের কাজ।

এই মহান জ্ঞানসাধক ১৩৭৫ সালে দামেস্কে মৃত্যুবরণ করেন।


বিভাগ : ইসলামী জীবন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

পানির সংকট

পানির সংকট

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু