সালাম ইসলামী সম্ভাষণ রীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ
২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
সালাম ইসলামী সংস্কৃতিতে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ সমূহের মধ্যে অন্যতম। ইসলামে প্রত্যেক মুসলিমের মধ্যে সালাম আদান প্রদানের ব্যাপক প্রচলনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে অনেক নির্দেশনা পাওয়া যায়। আজকে আমরা জানব ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ সালাম এর আভিধানিক অর্থ,হুকুম, সালামের মাসনুন শব্দসমূহ, সালামের জবাবের মাসনুন শব্দসমূহ ও সালাম ব্যতীত অন্য সংস্কৃতির সম্ভাষণসমূহ ব্যবহারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ও সালাম আদান প্রদানের গুরুত্ব সম্পর্কে। ‘সালাম’ শব্দটি আরবি। বাংলায় এর আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় ‘শান্তি কামনা করা’, ‘নিরাপত্তা কামনা করা’ প্রভৃতি। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টিতে সালামের ভূমিকা: ইসলামী ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টিতে সালামের ভূমিকা অপরিসীম। সালাম আদান প্রদানের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন মজবুত ও সুদৃঢ় হয়ে থাকে। এমনকি কোন মুসলিম অপর মুসলিমের সাথে সালাম আদান প্রদানের মাধ্যমে শত্রুতা ভুলে গিয়ে একাত্ম হয়ে থাকতে পারে।এ ছাড়া অনুমতি চাওয়ার সময় শুরুতে সালাম প্রদান করে অনুমতি চাওয়ার নির্দেশ কুরআন মাজিদে এসেছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের ঘরের বাইরে অন্য কোনো ঘরে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি চাও এবং এর অধিবাসীদের সালাম দাও। তা তোমাদের জন্য উত্তম এইজন্য যে, সম্ভবত তোমরা স্মরণ করবে।’ (সুরা নূর : ২৭)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যখন তোমরা সম্ভাষিত হও কোনো সম্ভাষণ শব্দ দ্বারা, তখন তোমরা সম্ভাষণ জানাও তার থেকে উত্তম সম্ভাষণের শব্দ দ্বারা অথবা তাই ফিরিয়ে দাও।’ (সুরা নিসা : ৮৬)। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একজন মুসলিমের অপর মুসলিমের উপর ছয়টি কর্তব্য রয়েছে: যখন সে অসুস্থ হবে তখন তার সেবা করবে,আর যখন মারা যাবে তখন তার নিকট উপস্থিত হবে, এবং সে জবাব দিবে যখন সে ডাকবে, এবং সে তাকে সালাম দিবে যখন সে তার সাথে সাক্ষাত করবে, এবং সে যখন হাঁচি দিবে তখন তার উত্তর দিবে, এবং অনুপস্থিত ও উপস্থিত সর্বাবস্থায় তার জন্য কল্যাণ কামনা করবে।’ (বুখারি,মুসলিম)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একজন মুসলিমের অপর মুসলিমের উপর ছয়টি কর্তব্য রয়েছে: যখন সে তার সাথে সাক্ষাত করবে তখন তাকে সালাম দিবে, এবং যখন সে তাকে ডাকবে তখন তাকে জবাব দিবে, এবং যখন সে হাঁচি দিবে তখন তার জবাব দিবে, এবং যখন সে অসুস্থ হবে তখন তার সেবা করবে, এবং যখন মারা যাবে তখন তার জানাজায় উপস্থিত হবে, এবং তার জন্য তাই পছন্দ করবে যা সে পছন্দ করে।’ (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না তোমরা ঈমান আনবে।আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমান আনতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে। আর আমি কি তোমাদেরকে সে বিষয়ে জানাব না যখন সেটা করবে তখন তোমরা একে অপরকে ভালোবাসবে? (সেটা হচ্ছে) তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের অধিক প্রচলন কর।’ (বুখারি, মুসলিম)। জান্নাতিদের একে অপরের মাঝে সম্ভাষণের মাধ্যম হবে সালাম। জান্নাতিগণ একে অপরকে সালাম প্রদান করবেন এবং আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর ফেরেশতাগণ তাদেরকে সালাম জানাবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সেখানে তাদের প্রথম কথা হবে পবিত্রতা আপনার হে আল্লাহ’ এবং তাদের সম্ভাষণ হবে সালাম। আর তাদের শেষ কথা হবে এটাই যে ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য’।’ (সুরা ইউনুস : ১০)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘পরম দয়ালু প্রতিপালকের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে সালাম।’ (সুরা ইয়াসিন : ৫৮)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন ‘তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের কল্যাণ হোক।তোমরা সেখানে (জান্নাতে) চিরদিনের জন্য প্রবেশ কর।’ (সুরা যুমার : ৭৩)। সম্ভাষণার্থে সালামের পরিবর্তে অন্য শব্দ ব্যবহার করা মাকরুহ।
কে কাকে সালাম প্রদান করতে পারবেন : মুসলিমরা একে অপরকে সালাম প্রদান করতে পারবেন। এক্ষেত্রে মাসনুন নিয়ম হচ্ছে বাহনে চড়ে ভ্রমণরত ব্যক্তি পায়ে হাঁটা ব্যক্তিকে সালাম দিবেন, পায়ে হাঁটা ব্যক্তি বসে থাকা ব্যক্তিকে সালাম দিবেন, কম সংখ্যক লোক বেশি সংখ্যক লোককে সালাম দিবেন,একজন ব্যক্তি একটি কাফেলাকে সালাম দিবেন এবং ছোটরা বড়দের সালাম দিবে। তবে বড়রাও ছোটদেরকে সালাম শিক্ষা দেওয়ার জন্য সালাম দিতে পারবেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে ছোটদেরকে সালাম শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বড়দের সালাম প্রদান বিষয়ে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
কাকে সালাম প্রদান করা যাবে না: মুসলিম ব্যতীত অন্য কাউকে সালাম প্রদান করা হারাম। কারণ সালাম শুধু মুসলিমদের মধ্যে প্রচলন ঘটানোর জন্য হাদীসে এসেছে। তবে কোন ভিন্ন ধর্মের জালিম শাসক যদি সালাম প্রদান করতে বাধ্য করে এবং সালাম না দিলে তার পক্ষ থেকে জুলুমের শিকার হওয়ার আশঙ্কা করলে তাকে সালাম দেয়া জায়েয।আর আহলে কিতাবদের সালাম দেওয়া পূর্বে জায়েয ছিল। কিন্তু বর্তমানে যেহেতু খাঁটি আহলে কিতাব নেই, সুতরাং বর্তমান ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সালাম দেওয়াও জায়েয নেই।তবে কোন প্রয়োজনে অমুসলিমদের সালাম দিতে হলে এভাবে সালাম দিবে ‘আসসালামু আলা মানিত্তাবাআল হুদা’ অর্থাৎ ‘শান্তি বর্ষিত হোক হেদায়াতের পথ অনুসরণকারীর উপর”। আর কোন অমুসলিম কোন মুসলিমকে সালাম প্রদান করলে উত্তরে শুধু ‘ওয়া আলাইকুম’ বলবে।
কখন সালাম দেওয়া মাকরুহ: প্রত্যেক মুসলিম প্রত্যেকবার সাক্ষাতের সময় পরস্পরকে সালাম প্রদান করবেন, এমনকি দেয়ালের পেছনে আড়াল হয়ে পুনরায় সাক্ষাত হলেও। তবে দিনে ও রাতে কয়েকটি সময় আছে যখন সালাম প্রদান করা মাকরুহ। এই সময়গুলো হলো : ১.নামাজ পড়া অবস্থায় কোনো ব্যক্তিকে সালাম দেয়া উচিত নয়। কারণ নামাজের অবস্থায় ওই ব্যক্তি এর উত্তর দিতে পারবেন না। উত্তর দিলে নামাজ ভেঙে যাবে। ২. কেউ প্রশ্রাব-পায়খানা করছে এমতাবস্থায় তাকে সালাম দেয়া যাবে না। কারণ তখন জবাব দেয়ার কোনো উপায় নেই। সালামও এক ধরনের জিকির। প্রশ্রাব-পায়খানার সময় জিকির করা যাবে না। ৩. ওজুরত অবস্থায় কাউকে সালাম দেয়া যাবে না। এতে তার ওজুর মনোযোগ নষ্ট হবে; ওজুতে ভুলও হতে পারে।
৪. কেউ খাবার খাচ্ছে এমতাবস্থায়ও সালাম দেয়া যাবে না। এ সময় সালাম দিতে নিষেধ করা হয়েছে হাদিসে। ৫. কোরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় কোনো ব্যক্তিকে সালাম দেয়া উচিত নয়। ৬. জিকির ও মোরাকাবারত ব্যক্তিকে সালাম দেয়া উচিত নয়। ৭. ওয়াজ ও নসিহত শোনা অবস্থায় সালাম দেয়া উচিত নয়। ৮. দ্বীনি শিক্ষার মজলিসে মশগুল ব্যক্তিকে সালাম দেয়া উচিত নয়। ৯. আজানরত অবস্থায় মুয়াজ্জিনকে সালাম দেয়া যাবে না। ১০. কেউ কোনো জরুরি হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত তখনও সালাম দেয়া যাবে না। সালামের উত্তর দেয়া যেহেতু ওয়াজিব এজন্য যাকে সালাম দেয়া হচ্ছে তার অবস্থাটি বিশেষ বিবেচনায় রাখাই হচ্ছে সালামের মূল আদব। সালামের জবাব দানের হুকুম: সালাম দেওয়া সুন্নাত হলেও এর জবাব দেওয়া ওয়াজিব।
সালাম দেওয়ার মাসনুন বাক্যসমূহ: সালাম দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মাসনুন বাক্য হাদীস সমূহ থেকে পাওয়া যায়। নিম্নে সেসকল মাসনুন বাক্য বর্ণিত হলো : ১. ‘আসসালামু আলাইকুম’ অর্থাৎ ‘আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক’, ২. ‘সালামুন আলাইকুম’ অর্থাৎ ‘আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক’, ৩. ‘সালামুন আলাইকা’ অর্থাৎ ‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক’, ৪. ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আপনাদের উপর শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক’, ৫. ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’ অর্থাৎ ‘আপনাদের উপর শান্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক’।
আর সালামের জবাব দানের কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক মূলনীতি হলো সালামের শব্দসমূহ থেকে এক শব্দ বৃদ্ধি করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যখন তোমরা সম্ভাষিত হও কোনো সম্ভাষণ শব্দ দ্বারা তখন তোমরা সম্ভাষণ জানাও তার থেকে উত্তম (শব্দ বৃদ্ধি করে)সম্ভাষণের মাধ্যমে সম্ভাষণ জানাও অথবা তাই ফিরিয়ে দাও।’ (সুরা নিসা : ৮৬)। সালামের জবাবদানের অনেকগুলো মাসনুন বাক্য রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন হাদীসের আলোকে সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে। নিম্নে সেসকল মাসনুন বাক্যসমূহ বর্ণিত হলো: ১. ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ’ অর্থাৎ ‘আর আপনাদের উপরও শান্তি বর্ষিত হোক’, ২. ‘আলাইকুমুস সালাম’ অর্থাৎ ‘আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক’, ৩.’আলাইকাস সালাম’ অর্থাৎ ‘আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক’, ৪.‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আপনাদের উপরও শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক, ৫. ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু’ অর্থাৎ ‘আপনাদের উপরও শান্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক’, ৬. ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ওয়া মাগফিরাতুহু’ অর্থাৎ ‘আর আপনার উপরও শান্তি, আল্লাহর রহমত, বরকত ও ক্ষমা বর্ষিত হোক’। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে নিজেদের মধ্যে অধিক পরিমাণে সালামের প্রচলন ঘটানোর মাধ্যমে একটি সুন্নাত পুনরুজ্জীবিত করার তাওফীক দান করুন, আমিন।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেষ বিকেলে লুইস-অ্যাথানেজের 'আক্ষেপে' ম্যাচে ফিরল বাংলাদেশে
রানআউট হজ,লুইসের ব্যাটে এগোচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
জমকালো 'কনটেনন্ডার সিরিজ',কে কার বিপক্ষে লড়বেন?
তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল
অবশেষে ২৬ মামলার আসামি কুমিল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী আল-আমিন গ্রেফতার
'জুলাই অনির্বাণ’ এ রক্তপিপাসু হাসিনার নির্মমতা দেখে কাঁদছেন নেটিজেনরা
দেশনেত্রীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসহ সরকারের কাজের পরিধি বিশাল
অদক্ষ ফার্মাসিস্ট দ্বারাই চলছে ফার্মেসি
নির্বাচন কমিশন গঠন : গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু
বেনাপোল দিয়ে যাত্রী পারাপার কমেছে অর্ধেক, রাজস্ব আয় ও ব্যবসা বাণিজ্যে ধস
দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম
মসজিদে পরে এসে ঘাড় ডিঙিয়ে সামনের কাতারে যাওয়া জায়েজ নেই
দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সুন্দর জীবন এবং কৃতজ্ঞতাবোধ
যুগে যুগে জুলুম ও জালিমের পরিণতি
করিমগঞ্জের নাম কি আদৌ শ্রীভূমি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
বিশাল স্বর্ণখনির সন্ধান পেলো চীন
মাছ ধরার নৌকার সঙ্গে ভারতীয় সাবমেরিনের সংঘর্ষ
যৌন পর্যটনের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠছে টোকিও : বাড়ছে ভিড়
‘হাই অ্যালার্টে’ লন্ডন, মার্কিন দূতাবাসের সামনে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ