বইমেলা সামাজিক মাধ্যম অন্তর্গত চেতনা
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:১৯ এএম | আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:১৯ এএম
অমর একুশে বইমেলা বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির অংশ। মানুষকে বইমুখী করতে এই মেলার অবদান স্বীকার্য এই বইমেলার উদ্যোক্তা চিত্তরঞ্জন সাহা সেদিন বুঝেছিলেন বই শুধু ব্যবসায় নয়,মানুষের মনোজগত বিকাশ ও উন্নত রাষ্ট্র গঠনের বড় নিয়ামক। পঞ্চাশ বছর পূর্বে বাংলাএকাডেমীর বর্ধমান হাউসের বটতলায় এক টুকরো চটের উপর মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্ত বাবুর উদ্যোগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন বর্ণ মিছিল প্রকাশনার তাজুল ইসলামসহ প্রমুখ প্রকাশকরাই আরম্ভ করেছিলেন বইমেলা। হালফিল তা বাংলাদেশের ঐতিহ্য। আঁশির দশকের প্রারম্ভে বাংলাদেশে দ্রুতই বিকশিত হয় প্রকাশনা শিল্প। প্রকাশক ও গ্রন্থমনস্কদের বুঝ পরামর্শে বাংলা একাডেমির ভূতপূর্ব মহাপরিচালক কাজী মুহাম্মদ মনজুরে মওলা অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা করে ১৯৮৪ সালে। ২০১৪ সালে একাডেমি প্রাঙ্গনের পাশাপাশি ঐতিহাসিক সোহরাওয়াদ্দী উদ্যানে বইমেলা সম্প্রসারণ করা হয়। তারপর থেকেই পাল্টে যায় মেলার চালচিত্র। এখন দুই চত্বরে বইমেলা বসলেও মূল আকর্ষন সোহরাওয়াদ্দী উদ্যান। যেটাকে আমরা বইমেলা সঙ্গে সাদৃশ রেখে দেশের বিভিন্ন জেলা শহর ও উপজেলায় বইমেলার আয়োজন করা হয়। সোহারাওয়াদ্দী উদ্যান বইমেলার মূল আকর্ষণ হলেও এ বছরই সেখানে হচ্ছে শেষ মেলা, আগামী বছর কোথায় মেলা হবে, প্রসঙ্গে বইমেলার সদস্য সচিব কেএম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, গণপূর্ত কর্তৃপক্ষ বাংলা একাডেমিকে জানিয়েছে মার্চ মাস থেকে সোহাওয়াদ্দী সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলা কাজ শুরু করবে। ফলশ্রুতিতে আগামী বছর থেকে বইমেলা অন্যত্র করতে হবে। তবে বাংলা একাডেমির মাহাপরিচালক কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা জানান, আগামী বছর সোহাওয়াদ্দী উদ্যানে অনুমতি না পেলে একাডেমির সম্মুখের রাস্তায় মেলা অনুষ্ঠিত হবে। দুইতিন বছর পর হলেও আবার সোহাওয়াদ্দী উদ্যানে মেলা হবে। এ বছর সোহারাওয়াদ্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট এলাকা জুড়ে হচ্ছে বইমেলা। বাংলা একাডেমি মাঠে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়াদ্দী উদ্যানে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি ষ্টল বরাদ্দ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এ বছর মেলায় প্যাভিলিয়ন রয়েছে ৩৭টি। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১টি ও সোহাওয়াদ্দী উদ্যান অংশে রয়েছে ৩৬টি। মেলার সোহরাওয়াদ্দী উদ্যানের অংশ জুড়েই রয়েছে বই বিক্রির নামিদামি সব প্রকাশনার ষ্টল-প্যাভিলিয়ন প্রায় ১৫শতাংশের এসব প্রকাশনার উদ্দেশ্যই হচ্ছে বই বিক্রি করা। তবে মেলায় বাংলা একাডেমি অংশে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বেশকিছু ষ্টল। যাদের উদ্দেশ্য বই বিক্রি নয়,তারা মুলত মেলায় এসেছেন দর্শনাথীদের মধ্যে নিজেদের প্রচার ও ব্র্যান্ডিং করতেই। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ের ষ্টল আর রাজনৈতিক ষ্টলের মধ্যেই সীমাবন্ধ হয়ে পড়েছে বাংলা একাডেমি চত্বর। তবে এসব ষ্টলে রয়েছে বিচিত্র বই। ষ্টলের কর্মীরা জানান, একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার মূল মঞ্চ থাকায় কিছু দর্শনাথীর এখানে আগমণ ঘটে। এছাড়া খুব একটা পাঠক-দর্শনাথী এদিকে দেখা যায়না। কবি অরবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ”সোহরাওয়াদ্দী উদ্যানের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস জড়িত। স্থানটি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় আসা-যাওয়ায় সুবিধা হয়।” লিটল ম্যাগ সম্পাদক মোস্তফা মামুন বলেন, ”বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়াদ্দী উদ্যান দুটোই ইতিহাসের অবিচ্ছেন্দ্য অংশ। একটি সঙ্গে ভাষা অন্যটির সঙ্গে স্বাধীনতার স্মৃতি জড়িত।”
সময়ের অভিঘাতে সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষের রুচি ও মূল্যবোধও বদল হচ্ছে। যার সঙ্গে বই মেলার চেতনা ,উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। বইকেন্ধ্রিক একটি সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে বইমেলা যেনো আরও বেশি অবদান রাখতে পারে। সেদিকেও নজর ফেলতে হবে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠাগুলো থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে যাতে বেশকিছু বই পুনমুদ্রিতও হয়েছে। কিন্তু বই আবার বেরুচ্ছে সংকলনগ্রন্থ হিসেবে। এর বাইরে প্রায় সবই নতুন বই। বাংলা একাডেমি প্রতিদিন নতুন বইয়ের যে তথ্য সরবরাহ করে তাতে আছে ২২টি ক্যাটাগরি। এই ২২ রকম বইয়ের মধ্যে সর্বাধিক প্রকাশিত নতুন বই হচ্ছে কবিতার বই। তারপর সংখ্যায় বেশি রয়েছে উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ। সংখ্যায় অধিক বের হলেও কবিতার বইয়ের কাটতি নেই। ্আর কবিতার বই প্রকাশকরা যতো না বের করেন তারচেয়ে প্রকাশ করেন কবিরা স্বয়ং। অধিক পরিমাণ কবিতার বই প্রকাশ পায় কবিদের অর্থনৈতিক প্রণোদনাতেই।
বাংলা একডেমির দেওয়া তথ্যানুযায়ী ২০২০ সাল থেকে নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৪হাজার ৯১৯টি এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে নতুন বই প্রকাশিত হয় ৩৩হাজার ৪১৬টি। যা রেকর্ড পরিমাণ। এত বেশি পরিমাণ নতুন বই প্রকাশ হওয়ার পরেও মানসন্মত বই খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।
চলাচলের নতুন মাত্রা সংযোজন মেট্রোরেলে যাতায়াত সুবিধার কারণে দুর-দুরান্ত থেকে ও মেলায় আগমণ সহজতর হয়েছে। বই মেলার ষ্টল ও প্যাভিলিয়নের খোঁজ দেবে ’বইমেলা কম্পাস’ নামক অ্যাপ। মেলার নির্দিষ্ট ষ্টল ও প্যাভিলিয়নের অবস্থান জানার পাশাপাশি সেখানে যাওয়ার দিকনির্দেশনাও গুগল ম্যাপসের এপিআইযুক্ত অ্যাপটিতে প্রকাশনীর নাম বাংলায় লিখলেই প্রথমে ব্যবহারকারীদের অবস্থান শনাক্ত করে। এরপর সেখান থেকে নির্দিষ্ট ষ্টল বা প্যাভিলিয়নের যাওয়ার দিকনির্দেশনা দেখায়। ফলে মেলার যেকানো স্থান থেকে সহজেই ষ্টল বা প্যাভিলিয়নের নম্বরসহ সেগুলোর অবস্থান জানা সম্ভব। অ্যাপটির মাধ্যমে ষ্টল ও প্যাভিলিয়নের পাশাপাশি বইমেলার তথ্যকেন্দ্র,খাবারের দোকান, টয়লেট নামাজের স্থান,চিকিৎসা কেন্দ্র ও নিরাপত্তা কেন্দ্রের অবস্থানও জানা যায়। ব্যবহারকারীদের অবস্থান পর্যালোচনা করে সহজে মেলায় প্রবেশ ও বের হওয়ার দিকনির্দেশনাও দিতে পারে অ্যাপটি। জানা যায় মেলার সময়সূচিও। গুগল প্লে ষ্টোরে গিয়ে বিনা মূল্যে ষ্টোর করা যাবে প্রাসঙ্গিক অ্যাপ্িট।
ইতোমধ্যে ই-বুক এবং অ্যাপের মাধ্যমে পাঠকদের বই পড়তে ও শোনাতে কর্মরত রয়েছে ৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রথমবার ই-বুক সংস্করণ নিয়ে আসে অনলাইন বইয়ের বড় পরিবেশক রকমারি। প্রতিষ্ঠানটির এ যাবত ৭হাজার ই বুক প্রকাশ করেছে। বইমেলার বাংলা একডেমি প্রাঙ্গনে আরও রয়েছে বইচিত্র, কাব্যিক, শুনবই, বইঘর অডিওবুক ও ই বুকের ষ্টল।
সারা বিশে^ ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের সাহিত্য রস আস্বাদনে এক বিশাল প্ল্যাটফরম ’কাহিনীক’। বাংলাদেশ সরকারের গৃহিত ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ায় কাহিনীক অ্যাপ এক বিস্ময়কর ভূমিকা রাখবে বল ধারনা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ম.হামিদ বলেন,২০২৩ সালের ১৬ডিসেম্বর কাহিনীক অ্যাপটির উদ্বোধন করা হয়। ২৫টি দেশ থেকে মানুষ নিজেদের মুদ্রায় ডাউনলোড করা যাচ্ছিল। এবছর উন্নতি হয়ে ৫০টি দেশ থেকে ডাউনলোড করে উপন্যাস,কল্পকাহিনী, রহস্য,রোমান্স, গোয়েন্দা,প্রেম, রম্যরস,ফ্যান্টাসি, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, নাটক, কবিতা, ঐতিহাসিক, কাহিনি, জীবনী ও বিষয়ভিত্তিক রচনা ভিত্তিক নানান রকম বইয়ের অডিও রয়েছে।অ্যাপটি ডাউনলোড করলে ৯টি বই বিনামূল্যে শোনা যাবে। এরপর নতুন কিছু শুনতে বইয়ের আকারভেদে টাকা দিয়ে অডিও কিনতে হবে।
তরুনদের একটি বড় অংশই আসেন বিভিন্ন ফেসবুক সেলিব্রেটির বই ক্রয় করতে। যাদের বেশিরভাগই মূলত লেখক নন। পছন্দের বই সর্ম্পকে জানতে চাইলে বলেন,আসলে বই তেমন করে পড়া হয়না।প্রিয় একজন ফেসবুক সেলিব্রেটি বই লিখেছেন সেই অনুভূতি থেকে ক্রয় করছি। প্রকাশকদের অভিমত, এই শ্রেনির তরুণ পাঠকরা মূলত বই পড়েননা লেখক পড়েন। আর এ ধরনের পাঠকের কারণে মূলধারার লেখকরা অবহেলিত হচ্ছেন। কারণ যারা সত্যিকারের পাঠক তারা মূল ধারার লেখকের বই ক্রয় করেন এবং পড়েন। আর যারা ফেসবুক সেলিব্রেটিদের বই কেনেন তারা আবেগের স্থান থেকেই কেনেন। বাংলা প্রকাশের প্রকাশক আহসান আল আজাদ বলেন, সেলিব্রেটিদের বই লেখাতে দোষের নয়। তবে সেই বই কতোটুকু মানসম্পন্ন ও গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করবে সেটাই বিবেচনা বিষয়। শধু ফেইস ভেল্যুর কল্যানে বই বিক্রি বৃদ্ধি পেলে আর মূলধারার লেখকদের জ্ঞানগর্ভ বই অবহেলিত হওয়া এ সংস্কতির পরিবর্তন দরকার। এ জন্য প্রয়োজন একটি পাঠাভাস সম্পন্ন জাতি। পরিশেষে বাহ্যিক বৈষম্য শেষ করা কঠিন। তবে মানসিক স্থান থেকে অনুভূতি বিনিময়ের এইযে অবাধ ক্ষেত্র বই মেলা, তাকে আমরা মিলেমিশে নিতেই পারি। যাদের কাছে নেই তাদের পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ফ্যাসিস্ট সরকারের আট বছরের নিষেধাজ্ঞার পর অবশেষে মঞ্চে আসছে থিয়েট্রিক্যাল বাহাস ও কন্ঠনালীতে সূর্য
মিলেছে ‘হারিছ চৌধুরী’র ডিএনএ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের নির্দেশ
নাম পরিবর্তনের দাবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের
গলায় ফাঁস দিয়ে বৃদ্ধের আত্মহত্যা
আইএসের নৃশংসতার বিচারে জাতিসংঘ ব্যর্থ : নাদিয়া মুরাদ
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে হেফাজতের মানববন্ধন
মানিকগঞ্জে হাঙ্গার প্রজেক্টের গণতন্ত্র অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত
এবার ভারতের মালদহে বাংলাদেশিদের জন্য হোটেল ভাড়া বন্ধ ঘোষণা
কিশোরগঞ্জের হাওর-অর্থনীতি বেগবান করতে চলছে কয়েকশ কোটি টাকার প্রকল্প
প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে: অতিরিক্ত সচিব ফাহমিদা খানম
দেশের ৬৯ কারাগারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ, ৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনো পলাতক
পায়রার রাজস্ব আয় বাড়বে তিনগুণ, দেশের অর্থনীতিতে রাখবে বড় ভূমিকা
মমতা ব্যানার্জির মনে গভীর কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদ : রিজভী
কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ : প্রধান উপদেষ্টা
কুড়িগ্রামে সাবেক এমপি পুত্র সবুজ গ্রেফতার
ভারতে ৫.৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প
অমৃতসরে স্বর্ণ মন্দিরে পাঞ্জাবের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিং বাদালের ওপর গুলিবর্ষণ
খুলনায় সন্ত্রাসী হামলায় আহত বিএনপি নেতার মৃত্যু
বাড়তি মেদ কমাতে ‘খাওয়া কমানো’ কতটা কার্যকর
কিশোরগঞ্জে সড়ক সংস্কার দাবিতে মানববন্ধন