আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’
২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম

বাংলা গদ্যে ব্যঙ্গ রচনার যে সূচনা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন- সাহিত্যের এই পথকে মসৃণ করতে যারা কাজ করছেন তাদেরই একজন আবুল মনসুর আহমদ। প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রমথ চৌধুরী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় পাশাপাশি আবুল মনসুর আহমেদের নামটি বাংলা গদ্যে ব্যঙ্গ রচনায় নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল।
বাংলা ব্যঙ্গগল্পের জগতে আবুল মনসুর আহমেদের আয়না একটি কালজয়ী গ্রন্থ। গ্রন্থটি ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়।’আয়না’ গ্রন্থটিতে সাতটি ব্যঙ্গ-গল্প রয়েছে। সাতটি ব্যঙ্গ গল্প ই আমাদের সমাজের দর্পন হিসাবে আমাদের সমাজ বাস্তবতা ও বিশ্বাসকে প্রশ্ন করেছে। আয়না গ্রন্থটির ভুমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন “ এমনি আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায়, কিন্তু আমার বন্ধু শিল্পী আবুল মনসুর যে আয়না তৈরী করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। যে সমস্ত মানুষ হরেক রকমের মুখোশ পরে আমাদের সমাজে অবাধে বিচরণ করছে, আবুল মনসুরের আয়নার ভেতর তাদের স্বরূপ- মূর্তি বন্য ভীষণতা নিয়ে ফুটে উঠেছে।” সমাজের নানা বাস্তবতার রূপ কথা বুনন করেছেন ‘ আয়না’ গ্রন্থ। তিনি বিশ্বাস করতেন,” সাহিত্য মানেই জীবনভিত্তিক সাহিত্য, জীবন মানেই জনজীবন।” আর এই জনজীবনই হলো কাল ও সমাজের জনজীবন। এইগ্রন্থের প্রবন্ধে বাস্তব দৃষ্টান্তভিত্তিক যুক্তিপ্রধান বক্তব্য উপস্থাপনের নানা কৌশলে আবুল মনসুর আহমদ শিল্প সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন।
আয়নায় থাকা সাতটি ব্যঙ্গ-গল্প যথাক্রমে: হুযুর কেবলা,গো-দেওতা কা দেশ, নায়েবে নবী, লীডরে কওম, মুজাহেদীন,বিদ্রোহী-সংঘ ও ধর্মরাজ্য। গল্পগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও পরিহাসপ্রিয়তা। এর মধ্যেই ফুটে উঠেছে সমাজের অন্ধকার দিক। আয়না’র সাতটি গল্পের প্রায় সবগুলোতেই ধর্মকে ব্যবহার করে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে।যে আয়নার নিকটে সমাজের আসল রূপ ও স্বরূপ ধরা পড়ে সহজেই। লেখকের ভাষায়, “ আমি অন্যায় ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যা লিখবো তা হবে আপোসহীন।” তিনি তাঁর সমাজকে ও সমাজের মানুষকে ভালোবাসতেন এবং এর মধ্যকার ব্যাধি তাকে পীড়িত করতো -তাই তিনি কলমের খোঁচায় খোঁচায় সে সব অন্ধকার দিকে তুলে আলোর দিকে নিয়ে এসেছেন। পরিবর্তন করতে চেয়েছেন।
‘আয়না’ ব্যঙ্গ রচনার প্রথম ব্যঙ্গ গদ্যেটি হুযুর কেবলা। এক ভন্ড পীরকে কেন্দ্র করে এ গল্পের কাহিনী গড়ে উঠে।সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু বিখ্যাত উপন্যাস লালসালু মজিদ নামে এক স্বার্থান্বেষী, ভ- ধর্মব্যবসায়ীকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে।ধর্মকে অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষ থেকে মুনাফা হাতিয়ে নেওয়া যেখানে ধর্ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার ছিল উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। ‘হুযুর কেবলা’র পরিধি সেই ধাঁচের। এক শ্রেণির প্রতারক ওঁৎ পেতে থাকে সাধারণ মানুষের মগজ কব্জা করে নিজ স্বার্থ হাসিলে। সাধারণের আবেগকে পুঁজি করে তারা সফলকাম ও হয়। লালসালু উপন্যাসের শিক্ষিত যুবক আক্কাস। ইংরেজিতে পাশ করা আক্কাস গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে মজিদ বাঁধা দেয়। স্কুল প্রতিষ্ঠা গ্রামের মানুষ সচেতন হয়ে উঠবে আর ধর্মব্যবসা রসাতলে যাবে তেমনি প্রতিচ্ছবি আয়নার রচনার হুযুর কেবলা গল্পের। হুযুর কেবলা গল্পে ভন্ড পীরের পাল্লায় পড়েছে গ্রামের শিক্ষিত ছেলে এমদাদ। সে ভন্ড পীরের চালাকি, লোলুপ দৃষ্টির মুখোশ সমাজের কাছে উন্মোচন করতে চাইলে সুস্থ বুদ্ধিমান যুবক এমদাদকে পাগল আখ্যা দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়। গ্রাম বাংলার সহজ সরল চাষা-ভুষা, শ্রমিকদের ধর্ম বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ভন্ড ধর্মব্যবসায়ীরা সমাজকে কীভাবে প্রতারিত করছে তারই আসল রূপ হুযুর কেবলা গল্পটি।
দ্বিতীয় গল্পটি ‘গো দেওতা-কা দেশ’। গল্পে তিনি হিন্দুদের ধর্মান্ধতাকে ব্যঙ্গ করেছেন। গল্পটি লেখকের সময়কালে যেমন প্রাসঙ্গিক বর্তমানে আরো বেশি গ্রহনযোগ্যতা লাভ করেছে। কিছু গল্প যেমন সবসময়ের জন্য সত্য, সময়কে ধারণ করে গো দেওতা-কা দেশ তারই বাস্তব রূপ।
গরু মুসলমানদের জন্য হালাল পশু। ঈদুল আজহা ছাড়াও মুসলমানদের নানা উৎসব, অনুষ্ঠানে গরুর উপস্থিতি থাকে লক্ষ্যনীয়। অন্যদিকে সনাতনধর্মের অনুসারে গরুকে গো মাতা হিসাবে সম্মান করে, পূজা করে থাকে। মুসলমানদের গরু জবাইকে কেন্দ্র করে উগ্রবাদী হিন্দুরা নানা সময়ে মুসলমানদের উপর নিপীড়ন চালিয়েছে, হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত করেছে এবং বর্তমানে তার রেষারেষি বহুগুণে বেড়েছে।
আবুল মনসুর আহমেদ অতীত সমাজের অবস্থাকে গো দেওতা- কা দেশ গল্পের ফ্রেমে বন্দী করেছে এবং একেই ব্যঙ্গ রসের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
আয়নার তৃতীয় গল্পটি নায়েবে নবী। গল্পটিতে ভন্ড মৌলবি সুধারামী সাহেব কীভাবে ধর্মকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করে এবং ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে তারই বাস্তবরূপ প্রকাশ পেয়েছে। লেখক সুধারামীর বাস্তবতা এই ভাবে বর্ণনা করেন, “কোথাও দীর্ঘদিন থাকিতে গেলে তথায় বিবাহ করা সুন্নত। তা না হইলে শহওয়াৎ গালেব হয় এবং নফসে-আম্মারা দেহের মধ্যে শয়তানি ওয়াসওয়াসা ঢালিয়া দেয়। তাই সুধারামী সাহেব কেবল সুন্নতের ইযযত রক্ষা ও শয়তানের বদৃমায়েসির রাস্তা বন্ধ করিবার জন্য ঐ গ্রামের পুত্রহীন এক গৃহস্থের একমাত্র কন্যাকে বিবাহ করেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন।” তাছাড়া নায়েবে নবী গল্পে দেখা যায়, গ্রামের সরদার মৌলবী সুধারামী সাহেব এবং প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলভী গরিবুল্লাহর প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাতের চিত্র।জানাজায় সিনা বরাবর দাঁড়ানোর মতো সাধারণ বিষয় নিয়ে দুই মৌলভীর বাকযুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত জুতা ছুঁড়াছুড়ি, ইমামতি নিয়ে কাড়াকাড়ি, উভয়ের গোপন তথ্য লোকসম্মুখে ফাঁস করে বেইজ্জতি হওয়া। গ্রামের অশিক্ষিত জনসাধারণের কাছে তিনি ধর্মের দোহাই দিয়ে, নিজের করুন অবস্থার বিস্তর বর্ণণা করে নিজের আয়ের সহজ রাস্তা খুলে বসেন।নিজের স্বার্থের প্রশ্ন আসলে ফতোয়া জারি করেন,’এরকম ওয়াদা খেলাফে দোষ নাই।’
“লীডরে কওম, বিদ্রোহী সংঘ এবং মুজাহেদিন” গল্পগুলো সমাজের একখন্ড দলিল। গল্পগুলো হাস্য- রস এবং সামাজিক নাটকীতায় অগ্রসর হলেও এর অন্তর্নিহিত ভাব সমাজের মূলে বরংবার আঘাত করেছে। সচেতন হতে শিখিয়েছে প্রতিনিয়ত এবং সঠিক ধর্মচর্চা করতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
শেষ গল্পটির নাম ধর্মরাজ্য। ভারতবর্ষে হিন্দু- মুসলিম দাঙ্গার কালো রূপের প্রকাশ ধর্মরাজ্য গল্পটি। ইংরেজ আগমনের পূর্বে ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলিম পরষ্পরের মধ্যে মিল মোহাব্বত থাকলে ইংরেজ চক্রাতে তার অবশিষ্ট ও থাকলে না। এদেশে ধর্মীয় সংঘাত বন্ধের নামে তারা আরো উস্কানি ছড়িয়ে দিয়েছে উভয় জাতির মাঝে। ইংরেজদের শোষনে অতিষ্ঠ হয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠলে ইংরেজ শাসককর্তাদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ থাকলে ইংরেজের অশনি সংকেত বেজে যাবে তারাই ফলস্বরূপ ইংরেজরা হিন্দু মুসলমানের মাঝে সূক্ষ্ম চাল দেয়। ধর্মকে তারা ব্যবহার করে এবং সফলও হয়।গল্পে দেখা যায় বাইরের শোরগোলে কথকের ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বেরিয়ে কথক দেখলেন হাজার হাজার মুসলমান ইট,পাটকেল,লাঠি, ছুরি নিয়ে শহরের পশ্চিম অংশে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি কিছু বুঝতে পারলেন না। পরক্ষনেই এক ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে বিষয়টা সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝলেন। হিন্দুরা মসজিদের সামনে গান,বাদ্য বাজনা বাজাইবে তাই রক্ষা করতে সকল মুসলমান রা ছুটে যাচ্ছে। বর্ণপ্রথা ভূলে গিয়ে হিন্দুরা একজোট হয়ে নিজেদের হিন্দুত্ব ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে জীবন দিতেও প্রস্তুত।উভয় দলে দাঙ্গা লাগলে ইংরেজ দূরে দাড়িয়ে মজা দেখতে লাগলো। এভাবেই লেখক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতার মুখোশ উন্মোচন করেছেন।
‘আয়না ‘ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কালজয়ী ও সার্থক গ্রন্থ।সমাজের বাস্তব রূপ আবুল মনসুর আহমেদ বুনন করছেন তৎকালীন সময় প্রেক্ষাপটে। প্রেক্ষাপট লেখকের সময়কালে হলেও বর্তমান ও ভবিষ্যতে র জন্য সমাজের কপটতার মুখোশ উন্মোচনের আর্দশ আয়না হলো আবুল মনসুর আহমেদের “ আয়না” গ্রন্থ।
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত

ওষুধের দাম কমাতে পদক্ষেপ ট্রাম্পের

চীনা বিমানের কাছে পরাস্ত রাফাল সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসির খোরাক ভারত

এরদোগানের সঙ্গে ফোনালাপ পুতিনের

ফের বিটকয়েনের দাম ১ লাখ ৫ হাজার ডলার ছাড়াল

মার্কিন-চীন বাণিজ্যের অবনতি রোধ করতে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ঝুঁকছে নেক্স গ্লোবাল

গাজা যুদ্ধ সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয় : জার্মানি

ইউরোপে বন্দি থেকেও ফিলিপাইনে জয়ী হতে যাচ্ছেন দুতার্তে

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা

ফ্যাসিস্ট এমপি মমতাজ বেগম গ্রেফতার

কোটচাঁদপুরে আম সংগ্রহ শুরু

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অচল: দক্ষিণাঞ্চল অচলের ঘোষণা

সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারী করে প্রজ্ঞাপন

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির এক দশক পূর্তিতে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজন

করিডোর নিয়ে গোটা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ, বিপন্ন হতে পারে সার্বভৌমত্ব: দরকার জাতীয় ঐক্য

সিলেটে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতাকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

মাগুরায় আওয়ামী লীগ এর সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় জামায়াতের শুকরানা মিছিল

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোরআন বিরোধী প্রস্তাব বাতিল করতে হবে

জকিগঞ্জে আ. লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ২৬ নেতা কারাগারে

জেপি মরগান পেমেন্টসের ‘ওয়্যার ৩৬৫’ চালু করলো ব্র্যাক ব্যাংক