যত শঙ্কা দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে

যে কোনো সুপার সাইক্লোন রুখতে পারবে সুন্দরবন

Daily Inqilab ডিএম রেজা, খুলনা থেকে

১৭ মার্চ ২০২৩, ১০:৪১ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৫:১১ এএম

দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলবাসীর জন্য চরম আতঙ্কের সময় মার্চ, এপ্রিল মে এবং সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাস । এই ছয় মাসকে বাংলাদেশের দুর্যোগ মৌসুম বলা হয়ে থাকে। এ হিসাবে এখন চলছে দুর্যোগ মৌসুম। এই সময়টাতে একের পর এক ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের ঘটনা ঘটে।
ঝড় ঝঞ্ঝার সাথে লড়াই করা উপকূলের মানুষ নিকট অতীতে আম্ফান, সিডর, আইলার মত বড় বড় ঘুর্ণিঝড় দেখেছে। প্রকৃতির কাছে হেরে গিয়ে বারবার তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। যত বড় ঝড়ই হোক সুন্দরবন নিজে বিধ্বস্ত হয়ে বুক পেতে রক্ষা করেছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। ২০০৭ এর ১৫ নভেম্বর সুপার সাইক্লোন সিডর এবং ২০০৯ এর ২৫ মে আইলাতে প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া সুন্দরবন গত এক যুগে আবারও ফিরে পেয়েছে আগের অবস্থা। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবনকে নিয়ে চিন্তা না থাকলেও যত দুঃশ্চিন্তা উপকূলীয় দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে। সংস্কারের নামে অপরিকল্পিতভাবে অর্থ ব্যয় এবং সংস্কারের সময় ব্যাপক লুটপাটের কারণে বাঁধগুলো দুর্যোগ ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্র ও নদনদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় এবং বাঁধের উচ্চতা তুলনামূলকভাবে কমে আসায় যেকোনো দুর্যোগে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। গত কয়েক বছর ধরে নদনদীর পানি বৃদ্ধি পেলে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের প্রধান ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন জানিয়েছেন, বিশ্বের কোথাও আমাদের সুন্দরবনের মত এমন প্রাকৃতিক ঢাল দ্বিতীয়টি নেই। উপকূলে প্রায় ১২০ কিলোমিটার এলাকা বেষ্টনী করে রয়েছে সুন্দরবন। সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তা হচ্ছে গাছগুলো যদি ভেঙে পড়ে যায়, শ্বাসমূলের কারণে তা দ্রুত আবার উঠে দাঁড়াতে পারে। নতুন গাছের জন্ম হয় খুব দ্রুত। অর্থাৎ কোনো কারণে একটি বড় এলাকা বিধ্বস্ত হলে তা আবার পূর্বের অবস্থায় কয়েক বছরের মধ্যেই ফিরে যেতে পারে। বিভিন্ন সময়ে সুন্দরবনে প্রাকৃতিক দুর্যোগে যা ক্ষতি হয়েছে, তা গত কয়েক বছরে অনেকটাই পুষিয়ে নিয়েছে সুন্দরবন। করোনার সময় দু বছর সুন্দরবন লকডাউনে থাকায় বনের আরও বিস্তার ঘটেছে। কাজেই যে কোনো ঝড় সুন্দরবন রুখে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। গত কয়েক বছর ধরে ভারী বর্ষণ হলে সুন্দরবন তলিয়ে যাচ্ছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম প্রধান কারণ। সুন্দরবনের অনেক স্থানে নদী ও খাল ভরাট হয়েছে। যে কারণে জোয়ারে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে জোয়ারের পানি দীর্ঘস্থায়ী পানিবদ্ধতার সৃষ্টি করে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে অতিরিক্ত জলোচ্ছাস হলে তা সুন্দরবনের প্রাণী ও উদ্ভিদকূলের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সুন্দরবনের করমজল কৃত্রিম বণ্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে বলেন, সুন্দরবনের বিশাল বিশাল সুন্দরী, কেওড়া, বাইন, কাঁকড়া গাছ বড় বড় ঝড়কে বাধা দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এর আগে আমরা ২০০৭ এ দেখেছি, সুপার সাইক্লোন সিডরকে সুন্দরবন বুক চিতিয়ে দিয়ে বাধা দিয়েছে। আগামীতেও বড় বড় ঝড় হলে সুন্দরবন তা অনেকটাই রুখতে পারবে বলে আমরা মনে করি।
এদিকে, যে কোনো সুপার সাইক্লোন সুন্দরবন রুখে দিতে পারলেও আশঙ্কা দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে। ২০০৯ সালে ঘুর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের ১৬৫১ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্ত হয়। এ মুহূর্তে সাতক্ষীরার প্রায় ৬২ কিলোমিটার বেঁড়িবাধ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। খুলনায় ঝুঁকিতে রয়েছে ৩৩ কিলোমিটার এবং বাগেরহাটে ঝুঁকিতে রয়েছে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ষাটের দশকে বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। নদ নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে প্রায়শঃ উপকূলীয় জনপদগুলো প্লাবিত হয়। ভেসে যায় মৎস্য ঘের, জমির ফসল। গৃহহীন হয় হাজার হাজার মানুষ। সম্প্রতি দু বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প শেষ করেছে সেনাবাহিনী। প্রকল্পের আওতায় সাইক্লোন আম্ফানের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ১১ দশমিক ৫৩ কি.মি. বাঁধ সংস্কার ও পুননির্মাণ করে সেনাবাহিনী। গত বছর ৩০ মে খুলনার শেষ জনপদ কয়রায় আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বাঁধটি হস্তান্তর করা হয়। এই বাঁধ পুননির্মাণের ফলে দুটি জেলার তিনটি উপজেলার প্রায় ২ লাখ মানুষ পানি মুক্ত হয়েছে। এছাড়াও তাদের ঘরবাড়ি, আবাদী জমি ও মাছের ঘের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে অন্যান্য স্থানে বাঁধ দুর্বল থাকায় এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে উপকূল জুড়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত দুই যুগে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে বাঁধ মেরামতে। কাজের কাজ তেমন হয়নি। সংস্কারের সময় ব্যপক লুটপাট এবং পরিকল্পিতভাবে বাঁধ সংস্কার না করায় এ অবস্থা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাছাড়া, চিংড়ি নির্ভর অর্থনীতির অঞ্চল এই খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার অনেক স্থানে বাঁধ কেটে চিংড়ি ঘেরে নোনা পানি প্রবেশ করানোর কারণে বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
ষাট এর দশকে নির্মিত বেড়িবাঁধ ২০২৩ সালে এসে দেখা গেছে, সে সময় পানির উচ্চতার চেয়ে বাঁধের উচ্চতা ১০ থেকে ২০ ফুট উঁচু ছিল। এখন তা প্রায় সমান হয়ে পড়েছে। নদনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পানির উচ্চতা আগের চেয়ে বেড়েছে। অনেক জায়গায় বাঁধ ক্ষয় হতে হতে উচ্চতা কমেছে। সব মিলিয়ে এখন ভারী বৃষ্টি হলে বা নদীতে ভরা জোয়ার হলে উপকূলের অনেক এলাকাই পানিতে তলিয়ে যায়।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আশরাফুল আলম জানান, বিভিন্ন স্থানে বাঁধ সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে। কোথাও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে দ্রুত তা সংস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিছু কিছু জায়গায় বাঁধা দুর্বল রয়েছে। আগামীতে সেগুলো পর্যায়ক্রমে সংস্কার করা হবে।
এদিকে, দুর্যোগ মৌসুমকে কেন্দ্র করে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের উপকূলে বসবাসকারীদের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। সামান্য মেঘ বা ঝড় বৃষ্টি দেখলেই তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বড় দুর্যোগ হলে সব কিছু ফেলে তাদের সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিতে হয়। ফিরে এসে তারা দেখেন তাদের হালের গরু, ক্ষেতের ফসল, ঘেরের মাছ- সর্বস্ব চলে গেছে নদীতে। বারবার নিঃস্ব হয়ে তারা নতুন করে আবার মাথা তুলে দাঁড়ান, সংগ্রাম করেন। এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলছে তাদের জীবন।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবাই মিলে চেষ্টা করবো: প্রধান উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছে: শফিকুল আলম
হজের বিমান ভাড়া নির্ধারিত টাকার বেশি নিলে ব্যবস্থা : ধর্ম উপদেষ্টা
নির্বাচনের তারিখ নির্ভর করবে জুলাই চার্টারের ওপর: প্রেস সচিব
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নেবেন নাগরিক কমিটির ৪ নেতা
আরও

আরও পড়ুন

বিরলে ট্রেনের ধাক্কায় এক বৃদ্ধের

বিরলে ট্রেনের ধাক্কায় এক বৃদ্ধের

পাপমুক্তির আশায় ইবাদতের মধ্যে দিয়ে সিলেটে শবে বরাত পালিত

পাপমুক্তির আশায় ইবাদতের মধ্যে দিয়ে সিলেটে শবে বরাত পালিত

আয়না ঘরের অভিজ্ঞতা জানালেন তসলিমা নাসরিন

আয়না ঘরের অভিজ্ঞতা জানালেন তসলিমা নাসরিন

গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবাই মিলে চেষ্টা করবো: প্রধান উপদেষ্টা

গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবাই মিলে চেষ্টা করবো: প্রধান উপদেষ্টা

সোয়া এক ঘণ্টা পর ইসলামবাগের আগুন নিয়ন্ত্রণে

সোয়া এক ঘণ্টা পর ইসলামবাগের আগুন নিয়ন্ত্রণে

অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছে: শফিকুল আলম

অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়েছে: শফিকুল আলম

মিয়ানমার জান্তা প্রধানসহ ২৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

মিয়ানমার জান্তা প্রধানসহ ২৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

রাউজানে কলেজ ছাত্রদলের নেতাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা!

রাউজানে কলেজ ছাত্রদলের নেতাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা!

শবে বরাতের রজনীতেও রাতভর মুসুল্লীয়ীনগন এবাদত বন্দেীতে অংশ নেন

শবে বরাতের রজনীতেও রাতভর মুসুল্লীয়ীনগন এবাদত বন্দেীতে অংশ নেন

রামগতিতে করস্থানের জমি নিয়ে দু'পক্ষের মারামারি, ইউপি সদস্যসহ আহত-৬

রামগতিতে করস্থানের জমি নিয়ে দু'পক্ষের মারামারি, ইউপি সদস্যসহ আহত-৬

পীরগঞ্জে ফেনসিডিল সহ একজন আটক

পীরগঞ্জে ফেনসিডিল সহ একজন আটক

ভারত থেকে ১৩,৯৬৮ টন চাল আমদানি, তবুও কমছে না দাম

ভারত থেকে ১৩,৯৬৮ টন চাল আমদানি, তবুও কমছে না দাম

কাপ্তাই ফ্রিংখিংয় বনবিটে রাতে বন্যহাতির তান্ডব অফিস ভাংচুর

কাপ্তাই ফ্রিংখিংয় বনবিটে রাতে বন্যহাতির তান্ডব অফিস ভাংচুর

জর্ডান আর ফিলিস্তিনিদের নিতে পারবে না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

জর্ডান আর ফিলিস্তিনিদের নিতে পারবে না: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ বাজারে শ্রমিকদের সপ্তাহে ১ দিন ছুটির দাবীতে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ

চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ বাজারে শ্রমিকদের সপ্তাহে ১ দিন ছুটির দাবীতে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ

ফরিদপুর নদী বন্দরে অচল অবস্থা পন্যবাহী জাহাজ চলাচল বিঘ্নতা, পদ্মা শুকিয়ে মরা খাল

ফরিদপুর নদী বন্দরে অচল অবস্থা পন্যবাহী জাহাজ চলাচল বিঘ্নতা, পদ্মা শুকিয়ে মরা খাল

পাকুন্দিয়ায় বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু

পাকুন্দিয়ায় বিদ্যুৎ স্পৃষ্টে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু

ধনকুবের ট্রাম্প ও মাস্কের বিরুদ্ধে প্রচারণায় বার্নি স্যান্ডার্স

ধনকুবের ট্রাম্প ও মাস্কের বিরুদ্ধে প্রচারণায় বার্নি স্যান্ডার্স

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির খেলা উপভোগ করবেন যেভাবে

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির খেলা উপভোগ করবেন যেভাবে

দাউদকান্দিতে মাদক ছিনতাই ডাকাতি বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন

দাউদকান্দিতে মাদক ছিনতাই ডাকাতি বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন