চাষের কৈ-পাঙাশ-তেলাপিয়া কিনতেও হিসাব করতে হচ্ছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম ও বিআইডিএস’ গবেষণায় ভয়াবহ চিত্র

দুর্বিষহ জীবনে নিম্নবিত্ত

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

০৯ জুন ২০২৩, ১১:৩৪ পিএম | আপডেট: ১০ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম

দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো; যা নিম্নআয়ের ভোক্তাদের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ছে খরচ। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে, সবই খাদ্যপণ্য কিনতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার জন্য খরচ করার মতো টাকা তাদের হাতে থাকছে না। খরচের চাপ সামাল দিতে তারা কম খাচ্ছেন। নি¤œ আয় ও সীমিত আয়ের মানুষ রুই-কাতল মাছ কেনা ভুলে গেছে। তারা কম দামের চাষের পাঙাশ-তেলাপিয়া-কৈ মাছ খেতেন। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন পাঙাশ-তেলাপিয়া কিনতেও ক্রেতাদের হিসাব করতে হচ্ছে।
নি¤œ আয়ের মানুষের টিকে থাকই দায় হয়ে গেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, অস্বাভাবিক ডলারের দাম, দেশের অভ্যন্তরে সব ধরনের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এ চাপ বাড়িয়েছে। আমদানি, উৎপাদন খরচ ও পরিবহন খরচ বাড়ায় দফায় দফায় দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাজারে জেঁকে বসেছেন সিন্ডিকেটকারীরা। সরকার কোনোভাবেই পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, মসলা, সবজির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
রাজধানী ঢাকার নিম্নআয়ের মানুষ বলছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের জীবন ওষ্ঠাগত। সংসার চালাতে পারছেন না। খাদ্যপণ্য কিনতেই আয়ের সব টাকা চলে যাচ্ছে। অন্য মৌলিক চাহিদা যেমন- বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার খরচ কমাচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ি ও শনির আখড়া মাছের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি কই মাছ (চাষের) বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা, শিং মাছ (চাষের) ৫০০ টাকা, পাবদা (চাষের) ৪০০ টাকা, কাতল ৪০০ টাকা, রুই ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা, পাঙাশ (চাষের) ২০০ টাকা, কাচকি মাছ ৩৫০ টাকা, চিংড়ি আকার অনুযায়ী ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, টেংরা ৬৫০ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ ২৫০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে শোল মাছ প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, ছোট বোয়াল ৬০০, বাইম মাছ ৭০০ টাকা ও রূপচাঁদা প্রতি কেজি ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানী যাত্রাবাড়ি এলাকায় দুই সন্তান নিয়ে বসবাস করেন সাবিনা আক্তার। তিনি বলেন, গরু-খাসির গোশত অনেক আগেই কেনা বাদ দিয়েছি। এখন ডিম-দুধও খাওয়া যাচ্ছে না। গত মাসে ছেলের একটা টিউশনি কমিয়ে দিয়েছি। গত ঈদে কারও কোনো পোশাক কেনা হয়নি। এভাবে আরো কয়েকমাস চললে যে বাসায় থাকছি, সেটাও ছাড়তে হবে। কম ভাড়ার বাসা খুঁজতে হবে। চাষের কই, তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস মাছ কিনতাম; এখন সেটাও আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। তিনি বলেন, ছেলেটা বাড়তি আয়ের জন্য টিউশনি শুরু করেছে। তারপরও সংসার চলছে না। দ্রব্যমূল্য বাড়ায় প্রতি মাসে খরচ ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করবো কীভাবে?
সাবিনা আক্তারের বয়ানের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) জরিপের তথ্য। গত মার্চে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাজারে দিনের পর দিন জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলেছেন নিম্নআয়ের মানুষ। তারা বাধ্য হয়েই কম খাচ্ছেন। গত ছয়মাসে ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার গোশত খাওয়া কমিয়েছেন। ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার মাছ কম খাচ্ছে।
সানেমের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্নআয়ের পরিবারে খরচ বেড়েছে গড়ে ১৩ শতাংশ। এ সময় তাদের আয় বাড়েনি। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবার খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিচ্ছে। অর্থাৎ আগের চেয়ে কম দামের খাবার কিনে খাচ্ছে। সারাদিন না খেয়ে থাকছেন- এমন দরিদ্র মানুষের হার ১৮ শতাংশ।
দেশের ৮ বিভাগের নিম্নআয়ের ১৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ করেছিল সানেম। জরিপ প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, মাছ-গোশত ছাড়াও অন্যান্য খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও লাগাম টেনেছে দরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। প্রায় ৪৬ শতাংশ পরিবার ডাল, ৫৭ শতাংশ পরিবার আটা ও ৩৭ শতাংশ পরিবার ভাত কম খাচ্ছে।
সংস্থটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, আমরা দেখেছি, সংসারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় পরিবারগুলো স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ে কাটছাঁট করছে। অনেকে জমি বিক্রি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া আমিষে কাটছাঁটের কারণে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে। এসব সমস্য দীর্ঘমেয়াদি। শুধু ওই পরিবারের জন্য নয় বরং দেশের জন্যও। এদিকে সরকারের নজর দেওয়া জরুরি। মূল্যস্ফীতি হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জন্য করের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম ধরন। দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষা দিতে হলে বিকল্প উৎস প্রয়োজন। খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। আরও বিস্তৃত করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা।
গত ১৮ মে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয় গত বছর রাজধানী ঢাকা শহরের মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই ছিল নতুন। তবে ঢাকায় ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ৪.৩ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে অতিদারিদ্র্যের হার কমেছে ৩.২ শতাংশ।
বিআইডিএস দুই হাজার ৪৬টি খানার ওপর জরিপ করে এই গবেষণা তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, করোনা মহামারির সময় ঢাকায় দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল। পরে তা ধীরে ধীরে কমে আসে। করোনার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালে দরিদ্র মানুষের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ৩৩.৬০ শতাংশ। করোনার পর গত বছর (২০২২) তা বেড়ে ৩৮.৫৬ শতাংশ হয়েছে। অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে করোনার আগে আত্মকর্মসংস্থানের হার ছিল ১৫.৪৭ শতাংশ। করোনার পর তা বেড়ে ৩৩.২১ শতাংশ হয়েছে। পাশাপাশি ২০১৯ সালে দরিদ্র খানা বা পরিবারের মধ্যে ৩৯.২৯ শতাংশ এমএফএস (মোবাইলে আর্থিক সেবা) ব্যবহার করত। করোনার পর, অর্থাৎ ২০২২ সালে তা বেড়ে ৭৮.৭৮ শতাংশ হয়েছে।
বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন জানান, মোট দরিদ্রের প্রায় ৫০ শতাংশ নতুন দরিদ্র, যারা নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে নেমে গেছে।
যাত্রাবাড়িতে বাজার করতে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাছের বাজার এখন উচ্চবিত্ত মানুষের বাজার। মাছের দাম দিন দিন যে হারে বাড়ছে তাতে আর কিছু দিন পর নিম্ন আয়ের মানুষ মাছের বাজারে যেতে সাহস করবে না। মাছ কেনা সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের। এক সময় পাঙাশ ও তেলাপিয়া মাছ ছিল গরিবের মাছ, কিন্তু এখন এই দুই মাছের কেজি পৌঁছেছে ২০০ টাকায়। এই মাছ কিনতেও এখন হিসাব করতে হচ্ছে। বাজার করতে আসা শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা স্বল্প আয়ের মানুষ। তাই আমরা মাছ বাজারে পাঙাশ ও তেলাপিয়ার মতো মাছ সাধারণত কিনে থাকি। কিন্তু বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী সেই সব মাছ কেনার সক্ষমতা হারাচ্ছি। এভাবে মাছের দাম বাড়তে থাকলে গরু ও খাসির গোশতের মতো মাছ খাওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে আমাদের।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

লক্ষ্মীপুরে রঙ-কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে শিশুখাদ্য, ২ ফ্যাক্টরি সিলগালা

লক্ষ্মীপুরে রঙ-কেমিক্যাল মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে শিশুখাদ্য, ২ ফ্যাক্টরি সিলগালা

উৎসব মুখর পরিবেশে পালিত হলো জাবির ৫৪ তম দিবস

উৎসব মুখর পরিবেশে পালিত হলো জাবির ৫৪ তম দিবস

কুষ্টিয়ায়  স্কুল কমিটি নিয়ে বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষ, আহত ৩০

কুষ্টিয়ায় স্কুল কমিটি নিয়ে বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষ, আহত ৩০

জুলাই বিপ্লবে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ির চাকার পিষ্ট হয়ে নিহত মাহবুব আলমের পরিবারের পাশে তারেক রহমান

জুলাই বিপ্লবে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ির চাকার পিষ্ট হয়ে নিহত মাহবুব আলমের পরিবারের পাশে তারেক রহমান

ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন ষড়যন্ত্রকারী বিএনপির  ক্ষতি করতে পারবে না : আমিনুল হক

ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন ষড়যন্ত্রকারী বিএনপির  ক্ষতি করতে পারবে না : আমিনুল হক

যায়যায়দিন পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক হলেন খুরশীদ আলম

যায়যায়দিন পত্রিকায় নির্বাহী সম্পাদক হলেন খুরশীদ আলম

বিধ্বংসী শতকে লিটনের জবাব, ঝড়ো সেঞ্চুরি তানজিদেরও, বিপিএলে রেকর্ড

বিধ্বংসী শতকে লিটনের জবাব, ঝড়ো সেঞ্চুরি তানজিদেরও, বিপিএলে রেকর্ড

ফরিদপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন দিনে মোট ১১ জন নিহত, আহত ৩৫

ফরিদপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন দিনে মোট ১১ জন নিহত, আহত ৩৫

চলমান সংস্কার গতিশীল করতে হবে, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে : মান্না

চলমান সংস্কার গতিশীল করতে হবে, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে : মান্না

ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান: বিপিজিএমইএ

ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান: বিপিজিএমইএ

পাটগ্রাম সীমান্তে বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে বিএসএফের গুলি, আহত ১

পাটগ্রাম সীমান্তে বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে বিএসএফের গুলি, আহত ১

ওসি মুহিবুল্লাহকে বাঁচাতে স্বজনদের মানববন্ধন

ওসি মুহিবুল্লাহকে বাঁচাতে স্বজনদের মানববন্ধন

ব্র্যাক ব্যাংকের টপ টেন রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড জয় ২০২৪ সালে ১.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স সংগ্রহ

ব্র্যাক ব্যাংকের টপ টেন রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড জয় ২০২৪ সালে ১.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স সংগ্রহ

শেখ হাসিনা ভারতের সাথে বৈষম্যমৃলক চূক্তি করেছিলেন-মৌলভীবাজারে সারজিস আলম

শেখ হাসিনা ভারতের সাথে বৈষম্যমৃলক চূক্তি করেছিলেন-মৌলভীবাজারে সারজিস আলম

শেখ হাসিনার চোখ ছিল শুধু ঢাকা থেকে টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত : সারজিস

শেখ হাসিনার চোখ ছিল শুধু ঢাকা থেকে টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত : সারজিস

স্বাধীন সামরিক বাহিনী সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব

স্বাধীন সামরিক বাহিনী সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব

চকরিয়ায় পুলিশ-সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি: বসতবাতিতে আগুন, ওয়ার্ড মেম্বারসহ আহত ২

চকরিয়ায় পুলিশ-সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি: বসতবাতিতে আগুন, ওয়ার্ড মেম্বারসহ আহত ২

শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর সদস্যদের অপসারণে আইনি নোটিশ

শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর সদস্যদের অপসারণে আইনি নোটিশ

সউদী-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক হজ চুক্তি স্বাক্ষরিত

সউদী-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক হজ চুক্তি স্বাক্ষরিত

ব্যবসা গুটিয়ে নিতে এক্সিট পলিসি চান ব্যবসায়ীরা

ব্যবসা গুটিয়ে নিতে এক্সিট পলিসি চান ব্যবসায়ীরা