সোনার বরণ কন্যার বায়োনিক কর্ণের গল্প
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:৫৭ পিএম | আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ এএম
উনিশ বছরের এক সোনার বরণ কন্যা সুমাইতা তাসনিম খান অর্পা। স্বাভাবিক গড়নের ফুটফুটে শিশু হয়ে মায়ের কোল আলো করে জন্ম নেয়। অর্পার জন্মে রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মা লায়লা খাতুন ও বাবা আব্দুর রাকিব এর মধ্যবিত্ত পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু অর্পার বয়স এক বৎসরের কম থাকতেই তার মায়ের সন্দেহ হয় সে কানে শুনতে ও কথা বলতে পারে না। শুরু হয় চিকিৎসক আর হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। ২০০৬ সালে ১৪ মাস বয়সে একটি হিয়ারিং সেন্টারের পরীক্ষায় বোঝা যায় অর্পা একেবারে সম্পূর্ণ বধির হয়ে জন্মেছে। আকাশ ভেঙে পড়ে মা-বাবার উপর।
পরিবারের শুভানুধ্যায়ী চিকিৎসক ডা. শাহাদত হোসেনের পরামর্শে অর্পাকে দেখানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক, কান ও গলা সার্জন প্রফেসর ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদারকে। তিনি কিছু পরীক্ষা করে অর্পার শ্রবণ বধিরতাকে জন্মগত ও মারাত্মক হিসাবে নির্ণয় করলেন, সিদ্ধান্ত দিলেন কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি করতে। হিয়ারিং এইড ব্যবহারে ওর কোনো লাভ হবে না। ডা. হাসনাত জানান, কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট স্থাপন করলে অর্পা কানে শুনতে ও কথা বলতে পারবে।
সূত্র মতে, কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট একটি ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র এবং একে বায়োনিক কর্ণ বা মিরাকল ইয়ারও বলা হয়। নির্মাতা দেশ ও মডেল ভেদে একটি ইমপ্ল্যান্ট ডিভাইস- এর মূল্য পড়ে দশ থেকে বিশ লাখ টাকা। ভারত বা সিঙ্গাপুরে গিয়ে এই ইমপ্ল্যান্ট স্থাাপনও ভাষা শিক্ষা করতে আরও দশ থেকে বিশ লাখ টাকা খরচ হবে। অনেক হতাশার মধ্যে আশার আলো দেখলো অর্পার পরিবার। কিন্তু বাধা হিসেবে কাজ করছে এতো টাকা কোথায় পাবে। স্বল্প আয়ের চাকুরীজীবী মা ও ক্ষুদ্র পুঁজির ব্যবসায়ী পিতার পক্ষে এই খরচ বহন করা সম্ভব নয়।
২০০৬ সালের আগে সরকারি অর্থ সহায়তায় বিনামূল্যে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করানো যেতো না বাংলাদেশে। তখন এই সার্জারির জন্য হাতে গোনা দু’এক জন শ্রবণ প্রতিবন্ধী পরিবারের নিজ ব্যয়ে বিদেশি সার্জন এনে ঢাকাতে ইমপ্ল্যান্ট স্থাাপন করাতো। আবার কোন কোন শ্রবণ প্রতিবন্ধী পরিবার বিদেশে গিয়ে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট স্থাপন করাতো।
অর্পার বাবা আব্দুর রাকিব বলেন, আমার মেয়ের জন্য ডা. হাসনাত যে চিকিৎসা ও বিস্তারিত সমাধান আন্তরিকভাবে বোঝালেন তাতে আমরা আশ্বস্ত হলাম। চিকিৎসক বললেন, যত কম বয়সে ইমপ্ল্যান্ট করা যাবে শিশু তত ভাল কথা বলতে পারবে। আমরা সংকল্পবধ্য হলাম দ্রুত ইমপ্ল্যান্টের ব্যয় সংগ্রহ করতে। কিন্তু এটা ছিল অনেক কঠিন সংগ্রাম। মেয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে তাই সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা হতো। অবশেষে চার বছর পেরিয়ে ২০০৯ সালে অনেক আত্মীয় বন্ধুর দান ও ঋণে শুধু পনেরো লাখ টাকা মূল্যে একটি কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট ডিভাইস সংগ্রহ করা সম্ভব হলো। চিকিৎসকরা জানালেন, ইমপ্ল্যান্ট সার্জারি ও হাসপাতালের সকল খরচ ফ্রি করা হবে।
অর্পার মা লায়লা খাতুন বলেন, ২০০৯ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার কলাবাগান ইএনটি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে অর্পার ডান কানে সফল অস্ত্রোপচার করে কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট স্থাাপন করা হয়। প্রফেসর ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদারের নেতৃত্বে একটি টিম এই অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করে। এটা ছিল বাংলাদেশি সার্জনদের দ্বারা দেশে প্রথম কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট স্থাাপন তাই দিনটি ঐতিহাসিক। টিমের সদস্য ছিলেন সহকারী অধ্যাপক ডা. জহুরুল হক, সহকারী অধ্যাপক ডা. মোসলেহ উদ্দিন, গবেষণা সহকারী ডা. মোস্তফা রেজা, আবেদনবিদ প্রফেসর ডা. হাসিবুল হোসেন।
এছাড়া সুপারভাইজিং টিমে উপস্থিত ছিলেন ভারতের সার্জন ডা. আশিস কুমার লাহিড়ী ও অডিওলজিস্ট চন্দন সাহা। অস্ত্রোপচারের টেবিলে টেস্ট করে দেখা গেল অর্পার ইমপ্ল্যান্টের সঙ্গে হিয়ারিং নার্ভের সংযোগ হয়েছে এবং তা সঠিকভাবে কাজ করছে। আমাদের কাছে এটা ছিল শুভ ক্ষণ-স্বপ্ন পূরণের দিন। অর্পার জীবনটা পরিবর্তন হয়ে গেল এদিন। আল্লাহকে জানালাম লাখ লাখ শুকরিয়া। অস্ত্রোপাচারের তিন সপ্তাহ পর অর্পার কানের ভিতরের ইমপ্ল্যান্টের সঙ্গে কানের বাইরে একটি সাউন্ড প্রসেসর লাগিয়ে সংযুক্ত ও চালু করা হল-এটাকে বলা হল ‘সুইচ অন’। ঐদিন থেকে তার শ্রবণের বয়স শুরু হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অডিওলজিস্টরা তার কানে শব্দ শোনার মাত্রা নিয়মিত পুনর্বিন্যাস করতে থাকে। আর অর্পাকে ভাষা শিক্ষা দিতে থাকে অডিও-ভারবাল থেরাপিস্টরা। বাড়িতেও কথা বলা ও ভাষা শিখানোর রুটিন দিয়ে দেয়া হল মাকে। থেরাপিস্টরা ও পরিবারের সকলের চেষ্টায়ই অর্পা বছর দেড়ের মধ্যেই অনেক কথা বলতে শিখে গেল। এক পর্যায়ে তাকে মিরপুর বাংলা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পড়াশুনার জন্য ভর্তি করা হল। শুরু হল বায়োনিক কর্ণ-বালিকার বিজয়গাঁথা শিক্ষা জীবন। ২০১৭ সালে পিএসসি পরীক্ষাতে সে জিপিএ-৫ পেয়েছে। আর চলতি বছর অর্পা এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। অর্পা ভালো ছবি আঁকতে পারে।
অর্পার ইমপ্ল্যান্টের সাউন্ড প্রসেসর যা কানের বাইরে থাকে তা একবার অকেজো হলে প্রাইম ব্যাংকের আর্থিক সহায়তাই নতুন একটা কেনা হয় গত সাত বছর আগে। ব্যয়বহুল সাউন্ড প্রসেসরটি বর্তমানে আংশিক অকেজো হয়ে যাওয়ায় তার কানে শুনতে অসুবিধা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিাতিতে জরুরীভাবে একটি আপডেটেড প্রসেসর প্রয়োজন অর্পার।
উল্লেখ্য, অর্পার সফলতাকে উদাহরণ ধরে ২০১০ সাল থেকে সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট কার্যক্রম চালু রেখেছে। আরও পাঁচটি সরকারি হাসপাতালে ইমপ্ল্যান্ট কার্যক্্রম সম্প্রসারিত হয়েছে। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই মহৎ উদ্যোগ থেকে উপকার পাচ্ছে শত শত শ্রবণ প্রতিবন্ধী। অর্পাসহ সকল সীমিত আয়ের পরিবারের কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট গ্রহীতার আজীবন শ্রবণ যাত্রায় একাধিকবার নামমাত্র মূল্যে সাউন্ড প্রসেসর প্রয়োজন। শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের সেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে অন্তভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে ও দেশের অগ্রযাত্রায় কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট গ্রহীতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে সাউন্ড প্রসেসর পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে দেশের বিত্তবান ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
লস অ্যাঞ্জেলেসে এবার ‘আগুন টর্নেডোর’ আশঙ্কা
দেশে এইচএমপিভিতে আক্রান্ত নারীর মৃত্যু
মোংলায় ভটভটি উল্টে ২ জন নিহত, আহত ২
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে ‘শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ প্রকাশ
নাম ভাঙিয়ে তদবির-টেন্ডারবাজি: সতর্ক করলেন সারজিস
গুলশান থেকে ওবায়দুল কাদেরের ‘পালিত ছেলে’ গ্রেফতার
আখাউড়ায় মর্টার সেল উদ্ধার
বায়ুদূষণে আজ সবার শীর্ষে ঢাকা
শৈলকুপায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় বৃদ্ধ নিহত
বাবরের মুক্তির অপেক্ষায় কারাগারের সামনে নেতাকর্মীদের ভিড়
ব্যাংক খাত নিপুন কারিগরের মতো যেভাবে ধ্বংস করেন এসকে সুর
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আজকের বৈঠক বর্জন করবে লেবার পার্টি
দেশে ফিরতে চান মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া অভি
দুর্নীতির মাধ্যমে পুতুলের ডব্লিউএইচও'র পদ পাওয়ার অভিযোগ: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
বাড়িতে ঢুকে সাইফ আলিকে ৬ বার ছুরিকাঘাত, হাসপাতালে ভর্তি
রাজশাহী জেলা ছাত্রদল নেতার পিতা বাচ্চু সরকারের দাফন সম্পন্ন
মোংলায় সড়কের ওপর রাখা পাথরের ধাক্কায় যাত্রীবাহী ভটভটিতে থাকা দুই যাত্রীর মৃত্যু, আহত ৪
গাজায় ঐতিহাসিক পরাজয় ইসরাইলের
১৭ বছর পর আজ দুপুরে কারামুক্ত হচ্ছেন বাবর
দীর্ঘ এক যুগ পর কারামুক্ত হলেন ডেসটিনির চেয়ারম্যান