বিচারালয়কে যেন রাজনীতিকরণ না করা হয় -প্রধান বিচারপতির প্রত্যাশা

ভেতরে সংবর্ধনা বাইরে বিক্ষোভ

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১০ এএম | আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১০ এএম

বিচারক ও আইনজীবীদের সম্মিলিত দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই কেবল সুবিচারের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। তবেই বিচার বিভাগের মর্যাদা অক্ষুণœ থাকবে। আমি চাইবো বিচার বিভাগ ও বিচারালয়কে যেন কোনোভাবে রাজনীতিকরণ করা না হয়। এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের উদ্যোগে দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের এই বিচার অঙ্গন পারস্পরিক সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসায় আলোকিত হোক এটিই আমার প্রত্যাশা। একটি কথা একটু অপ্রিয় হলেও বলতে চাই, কোন বিষয়ে ভালোভাবে না জেনে বা যথেচ্ছভাবে বিচারক ও আদালত সম্পর্কে কটু মন্তব্য মোটেই সভ্যতার ইঙ্গিত বহন করে না। সাবেক প্রধান বিচারপতি জনাব হাবিবুর রহমানের ভাষায় আমিও উচ্চারণ করতে চাই, কোনো বিচারকই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। সভ্য জগতে সভ্য সমালোচনার একটা অবকাশ রয়েছে। বিচারকের রায়ের সমালোচনা করার অধিকার বাকস্বাধীনতার এক অংশ বলে আমি মনে করি। আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সংবিধানে এই বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে যে মুক্ত সাংবাদিকতার পরিবেশ বিরাজ করছে তার ভাবমূর্তি অক্ষুণœ রাখার জন্য যথেচ্ছা সমালোচনার পরিবর্তে জেনে-শুনে, ওয়েল ইনফর্মড (তথ্য সমৃদ্ধ) হয়ে সমালোচনা প্রয়োজন। তবে কেউ যদি স্বাধীনতার অপব্যবহার করে তা সংবাদ মাধ্যমই হোক, আইনজীবীই হোক বা যে কেউ হোক তাকে শায়েস্তা করার জন্য আদালতের হাত যথেষ্টই লম্বা।

নবীন আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, পরিশ্রম পেশার সবচেয়ে বড় মূলধন। নবীন আইনজীবীদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। অর্থ উপার্জনের প্রতি মোহ অনেক সময় তরুণ আইনজীবীদের বিভ্রান্ত ও অনৈতিক আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। নতুন আইনজীবীদেরকে অর্থকড়ির এই সহজ মোহ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে হবে। তাদের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে যে, সততার সঙ্গে লিগ্যাল প্রাক্টিসে লেগে থাকলে আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিতভাবে আসবে। এই পেশায় শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই।

অধস্তন আদালত ও বিচারকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আপনাদের সাধ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অসহায় মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণ যেন নিশ্চিত হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্ব পালনের প্রকৃতি ও বিশালতায় আমাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও বিচারক হিসেবে আমাদের কারও মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা সকলেই বিচারক।

তিনি বলেন, অধস্তন আদালতসমূহকে আমি বিচার বিভাগের ‘প্রেস্টিজ পয়েন্ট’ বলে মনে করি। সম্মিলিতভাবে বিচারক হিসেবে আমাদের সকলের সুনাম সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে অধস্তন আদালতের ওপর। কেননা, প্রাত্যহিক কাজে সবচেয়ে প্রান্তিক জায়গা থেকে একজন বিচারপ্রার্থী শুরুতেই যে আদালতের দারস্থ হন সেটি হলো জেলা পর্যায়ের কোন আদালত। তাই জেলা পর্যায়ের আদালতসমূহে আমার যে সহকর্মী বিচারকবৃন্দ কর্মরত আছেন তাদেরকে বলবো, তারা যেন কখনোই সময়ের অপচয় না করে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে কাজ করেন।

তিনি আরও বলেন, বারের বিজ্ঞ সদস্যবৃন্দ, আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ ও বিচারপ্রার্থী জনগণের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, বিচারকের চরিত্রের সঙ্গে অহেতুক তাড়াহুড়া, হঠাৎ ধৈর্য হারানো, আইনজীবীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, আদেশ ও রায় লেখার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি আচরণ কখনোই আশা করা যায় না। তাই সচেতনভাবে এসব পরিহার করে চলতে হবে। অধস্তন আদালতের বিচারকবৃন্দের অসুবিধাসমূহও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে বারের বিজ্ঞ সদস্যবৃন্দ ও অন্যদের প্রতি আহ্বান জানাবো তারা যেন বিজ্ঞ বিচারকদের দায়িত্বপালনের প্রতি সবসময় সহায়তামূলক সাহায্যের মনোভাব অক্ষুণœ রাখেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, মানব সমাজ ও বিচারপ্রার্থীদের কল্যাণে এবং দ্রুত ও দুর্নীতিমুক্ত সুবিচার নিশ্চিতকরণে নিবেদিত হওয়ার মাধ্যমে মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি একজন বিচারক বা আইনজীবীর ভালোবাসা মূর্ত হতে পারে। আর এর মাঝেই আমরা পেতে পারি আমাদের কর্মজীবনের সার্থকতা। সংবিধানের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিচার প্রশাসনকে রাখতে হবে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, স্বাধীন এবং সোশ্যাল জাস্টিস তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একটি দুর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা দেশ ও জাতির জন্য গর্বের। আমার দায়িত্ব পালনকালে আমার সতীর্থ বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ এবং আপনারা বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দের সুচিন্তিত পথ ধরে একটি দুর্নীতিমুক্ত বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।

সাক্ষী সুরক্ষা আইন নিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, সাক্ষী ও ভিকটিমদের সুরক্ষার জন্য দেশে এখনো কোনো আইন প্রণীত হয়নি। স্থানীয় প্রভাব ও ভীতিতে আক্রান্ত সাক্ষীরা সমন জারির পরও আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসে না। এলেও ভয়ে সাক্ষীরা আদালতে সত্য গোপন করেন। ফলে মামলার বিচার প্রলম্বিত হয়। অনেক সময় সাক্ষীর হাজিরা নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট বিচারকের কলম কার্যকরভাবে সচল হয় না। বছরের পর বছর প্রলম্বিত হয় বিচার। সাক্ষীরা হয়ে পড়েন অনাগ্রহী। এসব অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। এজন্য সবার সক্রিয় ভূমিকা অনিবার্য।

আইনের শাসন প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, যে সমাজে আইনের শাসন যতোটা দৃঢ় সেই সমাজ ও রাষ্ট্র ততোবেশি সভ্য ও মানবিক। সমাজ ও রাষ্ট্রের গুণগতমান উন্নয়নে বিচার বিভাগের রয়েছে অপরিহার্য ভূমিকা। বিচারকের কর্তব্য ও আচরণ সম্পর্কে যে সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ধারণা আমরা দেখি তা সব সভ্য সমাজে ও রাষ্ট্রে অভিন্ন ও ধ্রুব হিসেবেই বিরাজমান রয়েছে।

ন্যায় বিচারের অঙ্গীকার করে প্রধান বিচারপতি বলেন, পবিত্র কোরআন শরিফে সূরা নিসার ৪:৫৮ আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানত তার মালিককে ফিরিয়ে দিবে আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচার করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আমি যেন আল্লাহ তায়ালার এই নির্দেশ থেকে কখনো বিস্মৃত না হই।
এদিকে নতুন এ প্রধান বিচারপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠান যখন চলছিলো তখন কোর্ট কম্পাউন্ডেই চলছিলো প্রধান বিচারপতির সমালোচনায় মুখর মুহুর্মুহু শ্লোগান। সরকারবিরোধী আইনজীবীদের মোর্চা ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফ্রন্ট (ইউএলএফ)র ব্যানারে আইনজীবীরা সংবর্ধনা বর্জন করে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এ সময় তারা কালো পতাকা প্রদর্শন করেন। সমাবেশে বক্তারা বলেন, প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগীয় প্রথা ও আচরণবিধি লংঘন করে সংবর্ধনা নিয়েছেন। এ কারণে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বর্জন করেছে ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফ্রন্ট। ছাত্রলীগের নেতাদের থেকে তিনি ফুল নিয়েছেন। এমনকি বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামিরাও তাকে ফুল দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রাঙ্গণে এ বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইউনাইটেড ল’ইয়ার্স ফ্রন্টের কনভেনর সিনিয়র অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, কো-কনভেনর অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রূহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব, অ্যাডভোকেট শাহ আহমদ বাদল, অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল প্রমুখ বক্তৃতা করেন। বক্তারা বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে যতোদিন পরিচালিত না হবে ততোদিন আমাদের আন্দোলন চলবে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

চার দিনের সফরে সোমবার সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা
নতুন দেশ গঠনে আনসার ভিডিপির প্রশিক্ষিত তরুণরা বড় শক্তি : আদিলুর রহমান
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী: সরকারের নতুন পদক্ষেপে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ সম্ভাবনাময়
স্বৈরাচার মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বিএনপি সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে চায়: আমিনুল হক
পাহাড় কাটা প্রতিরোধে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসানের কঠোর বার্তা
আরও

আরও পড়ুন

‘ন্যায়বিচারকে হত্যা’ করা হয়েছে: পিটিআই

‘ন্যায়বিচারকে হত্যা’ করা হয়েছে: পিটিআই

নতুন ভূগর্ভস্থ নৌ ঘাঁটি উন্মোচন ইরানের

নতুন ভূগর্ভস্থ নৌ ঘাঁটি উন্মোচন ইরানের

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করছে অনেক আফ্রিকান সেনা

রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করছে অনেক আফ্রিকান সেনা

পাওয়ার প্ল্যান্টের ৩৬০ মেট্রিকটন তেল ডাকাতি

পাওয়ার প্ল্যান্টের ৩৬০ মেট্রিকটন তেল ডাকাতি

বাংলাদেশি কর্মী নিতে প্রস্তুত রাশিয়া: রাষ্ট্রদূত

বাংলাদেশি কর্মী নিতে প্রস্তুত রাশিয়া: রাষ্ট্রদূত

রাজনৈতিক দলগুলো বেশি কিছু সংস্কার না চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন: প্রেস সচিব

রাজনৈতিক দলগুলো বেশি কিছু সংস্কার না চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন: প্রেস সচিব

এবার ওলমোর ইনজুরি দুঃসংবাদ বার্সার

এবার ওলমোর ইনজুরি দুঃসংবাদ বার্সার

কুড়িগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে ইমন ও আলামিন

কুড়িগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে ইমন ও আলামিন

এসএমই ফাউন্ডেশনের নতুন চেয়ারপার্সন মো. মুশফিকুর রহমান

এসএমই ফাউন্ডেশনের নতুন চেয়ারপার্সন মো. মুশফিকুর রহমান

বিয়ের ওপর কর বাতিলের দাবি

বিয়ের ওপর কর বাতিলের দাবি

শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে আ.লীগ : মির্জা ফখরুল

শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে আ.লীগ : মির্জা ফখরুল

নামাজের প্রথম কাতারে জামাত পড়াবস্থায় অজু ভেঙ্গে যাওয়া প্রসঙ্গে।

নামাজের প্রথম কাতারে জামাত পড়াবস্থায় অজু ভেঙ্গে যাওয়া প্রসঙ্গে।

কয়েক মিনিটে বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারে ভারত: শুভেন্দু অধিকারী

কয়েক মিনিটে বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারে ভারত: শুভেন্দু অধিকারী

নরসিংদীতে নিখোঁজের ৫ দিন পর নদীতে পাওয়া গেল স্কুল ছাত্রের লাশ

নরসিংদীতে নিখোঁজের ৫ দিন পর নদীতে পাওয়া গেল স্কুল ছাত্রের লাশ

বিএনপি : দেশবাদ যার রাজনীতির মূল কথা

বিএনপি : দেশবাদ যার রাজনীতির মূল কথা

পাহাড়ি উপজাতিরা আদিবাসী নয়

পাহাড়ি উপজাতিরা আদিবাসী নয়

সংস্কার প্রতিবেদন : জাতির নতুন অধ্যায়ে অভিযাত্রা

সংস্কার প্রতিবেদন : জাতির নতুন অধ্যায়ে অভিযাত্রা

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিনিয়োগে জোর দিতে হবে

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিনিয়োগে জোর দিতে হবে

ভারতে ৫ বছর সাজাভোগ করে দেশে ফিরলেন স্বামী-স্ত্রী

ভারতে ৫ বছর সাজাভোগ করে দেশে ফিরলেন স্বামী-স্ত্রী

চার দিনের সফরে সোমবার সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

চার দিনের সফরে সোমবার সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা