তিন হাজার কোটি টাকা গিলছে কোচিং সেন্টার
২২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৪ এএম
বছরে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে ১০৯ কোচিং সেন্টার। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে কোচিং সেন্টারগুলো। কোনো বিধিবিধান তোয়াক্কা করছে না। বলতে গেলে প্রশাসনের নাকের ডগায় গজিয়ে ওঠে এসব প্রতিষ্ঠান। চটকদার বিজ্ঞাপনে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে শিক্ষা বিক্রিই শুধু নয়-একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া পরীক্ষার্থী সরবরাহসহ শিক্ষাকেন্দ্রীক নানা অপরাধমূলক তৎপরতাও চালাচ্ছে কথিত এসব কোচিং সেন্টার। বিপরীতে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ও কর্মকর্তারা গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ৫ বছর আগে কোচিং সেন্টারগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ঢাক- ঢোল পেটানো সেই অনুসন্ধান নিয়ে একজন পরিচালকসহ অন্তত ২০ জন দুদক কর্মকর্তাকে কয়েক বছর ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়। এ সময়ের মধ্যে ঢাকার অন্তত ৩০টি কোচিং সেন্টারের রেকর্ডপত্র হস্তগত করে সংস্থাটি। করা হয় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদও। দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক নাসিম আনোয়ারের তত্ত্বাবধানে পৃথক ৩টি টিম এ অনুসন্ধান চালায়। কর্মকর্তারা গলদঘর্ম হন। কিন্তু অনুসন্ধান প্রতিবেদন অনুযায়ী কমিশন কোনো আইনগত ব্যবস্থাই নেয়নি।
তৎকালীন সহকারী পরিচালক (বর্তমান উপ-পরিচালক) মো. আব্দুল ওয়াদুদ, উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলাম এবং উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম এসব টিমগুলোর নেতৃত্ব দেন। সহকারী পরিচালক মো. ফজলুল বারী, উপ-সহকারী পরিচালক মেফতাহুল জান্নাত, রাফী মো. নাজমুস সাদাত, আতাউর রহমান সরকার, রেজাউল করিম, আ ক ম শাহ আলম, খন্দকার নিলুফা জাহান, সহকারী পরিচালক নূর ই আলম, উপ-সহকারী পরিচালক একরামুর রেজা এবং মানসী বিশ^াস এ টিমে যুক্ত ছিলেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রটি তখন জানায়, মালিবাগ চৌধুরিপাড়া নিবাসী জনৈক আবদুর রহমান বিশ^াস ২০১৭ সালের নভেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগটি আমলে নিয়ে কমিশন অনুসন্ধানের জন্য সংস্থার ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে পাঠায়। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সারাদেশে অবৈধ কোচিং বাণিজ্য এখন তুঙ্গে। বছরে কমপক্ষে ৩ হাজার ২ শ’ কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য চলছে। শিক্ষার জন্য বছরে এ অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হচ্ছে অভিভাবকদের। শুধু রাজধানী নয়-প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কোচিং সেন্টাগুলো শাখা-প্রশাখা খুলে বসেছে। এসব সেন্টারে পাঠদান করছেন প্রশিক্ষণ ও মানহীন শিক্ষকরা। কোচিং বাণিজ্য আইনত নিষিদ্ধ হলেও কার্যত প্রকাশ্যেই চলছে এগুলোর তৎপরতা। এ জন্য তারা কোম্পানি আইনে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধনও নিচ্ছে। খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও বাসা-বাড়িতে সাইনবোর্ডবিহীন কোচিং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যাচে ব্যাচে শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়ছে। এসব কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের প্রতি যৌন হয়রানির মতো ঘটনাও ঘটছে। একই সঙ্গে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষার্থী সরবরাহ এবং মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অসদুপায় অবলম্বনে সহযোগিতার অভিযোগ ছিল কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে। মেডিক্যাল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেশের বহু জায়গায় ব্যবসা পেতে বসেছে একাধিক কোচিং সেন্টার। ‘দ্য রিকগনাইজ নন-গভর্নমেন্ট সেকেন্ডারি স্কুল টিচার্স টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন্স-১৯৭৯’ আইনকে বুড়োআঙ্গুল দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বেআইনি কোচিং চালাচ্ছে। প্রতিপালন করছে না হাইকোর্টের নির্দেশনাও। একাডেমিক, বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি, মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্যাডেট কলেজে ভর্তি, বিসিএস, আর্মি-নেভি-বিমানবাহিনীতে চাকরির নামে ভাগে ভাগে প্রতিষ্ঠানগুলো। একই কোচিং সেন্টার বিষয়বস্তু ভেদে ভিন্ন ভিন্ন কোচিং করাচ্ছে।
দুদক তার অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, শুধু বিশ^বিদ্যালয়ের কোচিং বাণিজ্য করছে ৩৩ কোচিং সেন্টার। এর মধ্যে রয়েছে, ইউসিসি, ইউনিএইড (কিরণ, কবির, সুমন), ইউনিএইড (মনির, মল্লিক, জহির), ফোকাস, সানরাইজ, গার্ডিয়ান, ডিভাইন, এনইডিসিসি (জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়), সাইফুর’স, ইপিপি (শুধু ক-ইউনিট), ডিইউসিসি, ডি-হক স্যার, লীডস, হোপ, আইকন প্লাস, ভয়েজ, মেরিন, আইকন, কোয়ান্টা, দুর্বার, প্যারাগন, অ্যাডমিশন এইড, প্রাইমেট, প্লাজমা, এইউএপি, সংশপ্তক, এফ্লিক্স, এডমিশন প্লাস, এডমিয়ার, ইউএসি, ইউরেনাস, পিএসি এবং ইঞ্জিনিয়ার্স।
মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কোচিং রয়েছে ১৪টি। এগুলো হচ্ছে, উদ্ভাস কোচিং, রেটিনা, সানরাইজ, পিএসি, কর্নিয়া, ডিএমসি, মেডিকো, দি রয়্যাল, গ্রহণী মিশন এইড, থ্রি-ডক্টর্স, ফেইম, প্রাইমেট, প্লাজমা, এভিস এবং মেডি কেয়ার। প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের কোচিং সেন্টার রয়েছে ৫টি। এগুলো হচ্ছে, উদ্ভাস, সানরাইজ, পিএসি, ওমেকা এবং মেরিন। এছাড়া ১৮টি একাডেমিক কোচিং সেন্টারের মালিক-কর্মকর্তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, সানরাইজ, ডিভাইন, উদ্ভাস, ম্যাবস, অপরাজিতা, আইডিয়াল একাডেমি, রিয়াল, সেন্ট তেরেসা, ফেইম, মবিডিক, ক্রিয়েটিভ, উদ্দীপন, ই-হক, বিইউপি, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড, দূরন্ত এবং অভিযাত্রিক।
ইংরেজি ও বিভিন্ন ভাষা শেখার কোচিং সেন্টার রয়েছে ১৯টি। এগুলো হচ্ছে, সাইফুরস, এফএম মেথড, ইংলিশ ওয়ার্ড, ব্রিজ কাউন্সিল, সুগন্ধা, হোপ, টার্গেট, নজরুল, ওয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, হিলস, এজিসিসি, ওরি, গ্লোবাল, লিডার, ইংলিশ সেন্টার, এলফিক্স, বিজয়, সিডি মিডিয়া এবং লিবার্টি ইংলিশ। বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির কোচিং করাচ্ছে ১৪টি কোচিং সেন্টার। এগুলো হচ্ছে, কনফিডেন্স, বিকন, ওরাকল, বিসিএস আপগ্রেড, ওয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ইউনিটি, গ্লোবাল প্রফেশনাল একাডেমি এবং ডিফেন্স গাইড। মেরিন টেক্সটাইল ও ক্যাডেট কোচিংয়ের জন্য রয়েছে ৬ প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে ই. ম্যাক, ভয়েজ, মিরপুর ক্যাডেট কোচিং (ফার্মগেট শাখা), মেরিন গাইড, অ্যাডমিয়ার এবং বর্গ।
অভিযোগের এসব তথ্য আমলে নিয়ে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর অনুসন্ধান অনুমোদন করে ইকবাল মাহমুদ নেতৃত্বাধীন কমিশন। একই বছর ২৯ নভেম্বর দুদকের দক্ষ ও চৌকস ১৩ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় তিনটি টিম। টিমগুলো ২৬ ডিসেম্বর কোচিং সেন্টারগুলোর ৯ ধরনের রেকর্ডপত্র চেয়ে পৃথক চিঠি দেয়। তথ্যগুলো হচ্ছে, কোচিং সেন্টারের কোম্পানি সংক্রান্ত মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলস, সার্টিফিকেট অব ইন করপোরেশন, কর্মরত শিক্ষকদের ঠিকানাসহ শাখাভিত্তিক নামের তালিকা, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি প্রদান সংক্রান্ত রেজিস্ট্রার, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাচ, মাস ও বছরভিত্তিক সংখ্যা এবং তাদের কাছ থেকে গৃহীত কোচিং ফি’র মাসভিত্তিক বিবরণ, কোচিং সেন্টারের মালিক/পরিচালকদের নামীয় ব্যাংক হিসাব বিবরণী, কোচিং সেন্টারের আয়কর নথির রিটার্ন ও ভ্যাট প্রদান সংক্রান্ত কাগজপত্র, মালিক-পরিচালকদের ব্যক্তিগত আয়কর নথির রিটার্ন, ২০১৭ সালে কোচিং করা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা মানি রিসিট, বেতন আদায় রেজিস্ট্রার, কোচিং সেন্টারগুলো প্রধান কার্যালয়, সকল শাখা, ভবন ভাড়া চুক্তি, ক্রয় দলিল এবং কোচিং সেন্টার মালিকদের পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি।
দুদক টিমের এ চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে ওই বছর ২৯ ডিসেম্বর কিছু রেকর্ডপত্র নিয়ে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে হাজির হয় ৩০ কোচিং সেন্টার। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই পরবর্তীতে আরো কাগজপত্র দিয়ে যাবেন মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অনুসন্ধানগুলো মামলায় পরিণত হয়নি। অনুসন্ধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওই অভিযানটি ছিল ‘অভিযানিক প্রক্রিয়া’য়। অভিযান শেষে কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরে সুপারিশ পাঠায়। সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বদলি করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানান, কোচিং সেন্টারের মালিকদের বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্জিত সম্পদ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তর তথা মানিলন্ডারিংয়ের রেকর্ডপত্র দুদক কর্মকর্তাদের হস্তগত হয়। কিন্তু ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বে তৎকালীন কমিশন জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা অনুমোদন করেনি। ফলে কোচিং সেন্টার বিষয়ক অনুসন্ধানের মাধ্যমে কোচিং সেন্টার মালিকদের শুধু হয়রানি করার অভিযোগ উঠে। আর অনুসন্ধানটি পরিণত হয় প-শ্রমে।
এ বিষয়ে দুদকের সাবেক প্যানেল আইনজীবী ব্যারিস্টার আকবর আমীন বাবুল বলেন, অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ তোলা হলেও বেসরকারি ব্যক্তি পর্যায়ের মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ দুদকের এখতিয়ারভুক্ত নয়। তা জেনেও দুদক কেন এই অনুসন্ধানের পেছনে এতোগুলো কর্মকর্তাকে ব্যস্ত রাখল এটি বোধগম্য নয়। কমিশন এমনটি করতে পারে না। এর মধ্যে তৎকালীন ভিন্ন কোনো ইনটেনশন ছিল কি না, সেই প্রশ্ন এখন তোলাই যেতে পারে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ছাগলনাইয়ায় দুই হাত কাটা যুবকের লাশ উদ্ধার
কোর্ট রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি লিটন, সম্পাদক মামুন
খুবি কেন্দ্রে ঢাবি ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্নের লক্ষ্যে নানা সিদ্ধান্ত
ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের আদেশ স্থগিতে ১৮টি রাজ্যের মামলা
টেলিকমে অপ্রয়োজনীয় লাইসেন্স বাতিল করা হবে : বিটিআরসি চেয়ারম্যান
ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাইভেট কারচালক নিহত
খালেদা জিয়ার নাইকো মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য
আনিসুল হকের আয়কর নথি জব্দ
সাবেক ক্রিকেটার দুর্জয়ের সম্পদ জব্দ, ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের আদেশ
বন্দরে বকেয়া বেতন দাবিতে পারটেক্স শ্রমিকদের অবস্থান কর্মসূচি
অবৈধভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে ইস্ট এশিয়ান ইউনিভার্সিটি : ইউজিসি
ধামরাইয়ে ৩ দিনেও সন্ধান মেলেনি ইজিবাইক চালকের
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিন পালিত
গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমুক্ত সমৃদ্ধশালী দেশ গড়তে প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা -নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক
বিদ্যুৎ উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দিল পবিস কর্মীরা
উত্তরা উলামা আইম্মা পরিষদের কমিটি গঠন
ডাকাতির ভিডিও ভাইরাল হলেও অধরা রূপগঞ্জের রুবেল
সিনিয়র-জুনিয়র সংঘাতের দায়ে অভিযুক্ত দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার
পদ্মা ব্যাংকের ১২২তম পরিষদ সভা অনুষ্ঠিত
ভারতের ছত্তিশগড়ে বন্দুকযুদ্ধে ২০ মাওবাদী নিহত