২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা
১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ এএম
ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরসহ দেশের সকল নদনদীতে ২২ দিন ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। গতকাল শনিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হয়ে আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা। মা ইলিশ রক্ষায় ইলিশের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজনন সময় বিবেচনা নিয়ে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমাকে ভিত্তি ধরে বেঁধে দেওয়া এই সময়ের মধ্যে কেউ ইলিশ মাছ ধরতে পারবেন না। এ সময়ে সাগর ও নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ শিকার, মজুত ও পরিবহন দ-নীয় অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। আইন অমান্যকারীকে অন্তত সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদ- অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে।
এদিকে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময় জেলেদের মাছধরা থেকে বিরত রাখতে জেলেদের জন্য ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্ধ করেছে সরকার। এসব চাল ইতিমধ্যে ইউনিয়নে ও পৌরসভায় পৌঁছে গেছে। শিগগিরই এ চাল যথাযথভাবে জেলেদের মাঝে বন্টন করা হবে। গত ২২ সেপ্টেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আক্তারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির সভায় নিষেধাজ্ঞার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এসময় ফরিদা আক্তার বলেন, বাংলাদেশে ইলিশ মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈজ্ঞানিকভাবে এ মাছ সংরক্ষণের দিন নির্ধারণ করা হয়। ইলিশ মাছ সুরক্ষায় বিজ্ঞানীরা পূর্ণিমা ও আমবস্যার সঙ্গে মিল রেখে করে থাকেন। বৈঠকে যে তারিখটা নির্ধারণে সবাই একমত হয়েছি সেটা হলো ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন সব ধরনের ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুদ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যারা আছে- নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, র্যাবসহ যারা জড়িত তারা সবাই নজর রাখবে কোথাও থেকে ইলিশ যেন কেউ সংরক্ষণ, আহরণ, পরিবহন ও বিপণন করতে না পারে।
বাংলাদেশে ২০০৩ সাল থেকেই জাটকা রক্ষায় কর্মসূচি শুরু হয়। পরে ২০০৮ সাল থেকে প্রথম আশ্বিন মাসে পূর্ণিমার আগে ও পরে মোট ২২ দিন মা-ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তখন থেকেই এর সুফল পাওয়া যায়।
বিগত কয়েক বছর ধরে মৎস্য বিভাগের সময়পোযোগী এমন সিদ্বান্তে বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। তবে নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে বেকার হয়ে পড়বে উপকূলের জেলেরা। ফলে কারণে অভাব-অনটন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। যদিও এই সময় প্রত্যেক জেলে ২৫ কেজি করে ভিজিএফের চাল পাবেন। তবে সরকার এই ২২ দিনের অবরোধের জন্য জেলে প্রতি ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ করেছে তা নামে মাত্র প্রহসন ছাড়া কিছুই নয় বলে জানিয়েছেন জেলেরা।
এদিকে স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে/ নোয়াখালী জেলা ও কলাপাড়া (পটুয়াখালী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, প্রতিবছর এসময় হলে সরকার ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করার জন্য মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। এ সময় মা ইলিশ ছোট নদীতে এসে ডিম ছাড়ে। সরকার এ বছর ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দিয়েছে। এ সময় কোস্ট গার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নদীতে ও সাগরে পাহারায় থাকবে।
হাতিয়া সূর্যমুখী ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন জানান, হাতিয়াতে ২০টি ঘাটে প্রায় ২ লাখ মানুষ এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এদের মধ্যে কেউ ট্রলার মালিক, কেউ মাছ ব্যবসায়ী ও কেউ আছেন ঘাট শ্রমিক হিসেবে। এদের সবার জীবিকা নির্বাহ হয় নদীর মাছ শিকার করে। নদীতে মাছ পাওয়া না গেলে এদের সবাইকে অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও জেলেরা সরকারের এ আদেশ পালন করবে। ইতোমধ্যে অনেকে ঘাটে জাল নৌকা নিরাপদভাবে বেঁধে রাখছে।
সূর্যমুখী ঘাটের এমভি মায়ের দোয়া ট্রলারের মাঝি নুরুল ইসলাম জানান, গত শুক্রবার সকালে সাগর থেকে মাছ শিকার করে ঘাটে ফিরে এসেছেন। আগামী ২২ দিন ঘাটে থাকতে হবে। এজন্য ট্রলারের ১৮ মাঝি মাল্লা সবাইকে হিসাব বুঝিয়ে দিয়েছেন। ট্রলারটি পাহারায় দু’জন থাকবেন। অন্য মাঝি মাল্লারা বাড়িতে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকবেন।
কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, কলাপাড়া উপজেলায় নিবন্ধনধারী জেলেদের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩ শত ৫ জন। অবরোধ চলাকালীন সময় এই জেলেদের জন্য বরাদ্ধ সরকার প্রদত্ত ২৫ কেজি চাল ইতিমধ্যে ইউনিয়নে ও পৌরসভায় পৌঁছে গেছে। শীঘ্রই এ চাল যথাযথভাবে জেলেদের মাঝে বন্টন করা হবে। এই নিষেধাজ্ঞা পালনে উপজেলার মৎস্য বন্দর আলিপুর-মহিপুরের জেলেরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।
বঙ্গোপসাগর তৎসংলগ্ন সমুদ্রে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়াতে জেলেরা পড়বেন অস্তিত্ব সঙ্কটে। একদিকে বছরে দুই বার নিষেধাজ্ঞা। অপরদিকে এই বছর ভরা মৌসুমেও সাগরে মাছের আকাল পড়েছে। ঋণের বোঝা এবং ধার দেনায় জর্জরিত হয়ে জেলেরা রয়েছে চরম বিপাকে। ফলে পেশা বদলের উপক্রম এখানকার জেলেদের। দীর্ঘ দিন কর্মহীন সময় পার করবেন তারা। তবে সরকার এই ২২ দিনের অবরোধের জন্য জেলে প্রতি ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ করেছে তা নামে মাত্র প্রহসন ছাড়া কিছুই নয় বলে জানিয়েছেন জেলেরা।
জেলে সোহরাফ জানান, ‘ছেলে মেয়েদের নিয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। এনজিওর লোন টাহার ঋণ লইয়া মানষিক দুশ্চিন্তায় মোর চোঁহে ঘুমে ধরে না। আর মহাজনের দাদনের টাহা কেমনে পরিশোধ করমু। এহন হতাশ অইয়া গেছি। ২২ দিনের অবরোধে মাত্র ২৫ কেজি চাল যা দিয়া দশদিনও সংসার চলেবে না।’ সফিক মাঝি বলেন, ট্রলারে কাজ করে গত বছর ৬০ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে, তা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। আবার ২২ দিনের অবরোধ আসলে এই ঋণ পরিশোধতো দূরের কথা ঋণের বোঝা আরো বেড়ে যাবে।
অনেক জেলে অভিযোগ করে বলেন, অবরোধকালীন সময়ে প্রতিবছর ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের পানিসীমানায় মাছ ধরলেও কোনো ভূমিকা দেখা যায়না প্রশাসনের। তা না হলে আমাদের জালে চাহিদানুযায়ী মাছ ধরা পড়ত। তারা আরো দাবি করে বলেন, সরকার বছরে দুই বার অবরোধ না দিয়ে বছরে একবারসহ ভারতের সময়সীমার সাথে মিলিয়ে যেনো নিষেধাজ্ঞা (অবরোধ) দেয়া হয়।
বাবা-মায়ের দোয়া ফিস পান্না হাওলাদার জানান, পটুয়াখালীর সবচেয়ে বড় দুটি মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুর। এখান থেকে কোটি কোটি টাকার মাছ চালান হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে গত কয়েক বছর যাবৎ বছরে দু’বার নিষেধাজ্ঞা, বৈরি আবহাওয়া, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি। সব মিলিয়ে এই পেশা এখন হুমকির মুখে।
মহিপুর আড়ৎদার মালিক সমিতি সভাপতি মো. দিদার উদ্দিন আহম্মেদ মাসুম বলেন, সরকার সমুদ্রে মাছের প্রজনন বৃদ্ধি ও জেলেদের স্বার্থে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। তবে সেটা যদি মৎস্য পেশাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে তাহলে অতি সম্প্রতি এই পেশায় সঙ্কট দেখা দিবে। এছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন সময় এখনো থেকে দেড় মাস বাকি। তাই আমাদের দাবি এই অবরোধ পিছিয়ে দেওয়া হোক।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, নিষেধাজ্ঞা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার লক্ষে ইতিমধ্যে পোস্টারিং, ব্যানার, সচেতনতামূলক সভা ও মাইকিংয়ের কাজ সমাপ্ত করা হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে ইলিশ প্রজনন মৌসুমে মৎস্য শিকারের নিষেধাজ্ঞার ধারাবাহিকতায় সাগরে বেড়েছে ইলিশসহ নানা প্রজাতির মাছ। অবরোধ সফল করতে জেলেদের নিয়ে উঠান বৈঠকসহ চলছে ধারাবাহিক গণসংযোগ। সমুদ্রসহ স্থলভাগে সক্রিয় রয়েছে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
নারায়ণগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. ফজলুল কাবীর বলেন, প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও ২২ দিনের জন্য আমরা ইলিশ মাছ সংরক্ষনের জন্য এই কার্যক্রমটি চালু করেছি। সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করার জন্য ইতোমধ্যে মৎস্য বিভাগ, উপজেলা-জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে আমরা বৈঠক করেছি। নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র এ বিষয়ে চোখ, কান খোলা রাখছি। এরপরও যারা আইন অমান্য করবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা মৎস অফিসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক এস এম আশিকুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জের বন্দর, সোনারগাঁ, আড়াইহাজারে সভা ও লিফলেট বিতরণ করেছি। জেলেরা যাতে এই ২২ দিনে ইলিশ মাছ না ধরেন সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছি। এছাড়াও জেলেদের এই সময়গুলোতে কিছু গিফট দেওয়া হয়েছে। বাজেট অনুযায়ি এক হাজার নিবন্ধিত জেলেদের ২৫ কেজি করে ভিজিএফের চাল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমরা চেষ্টা করবো শুধু মাছ ধরা নয়, নদী থেকে ভোক্তা পর্যন্ত যাতে মা ইলিশ রক্ষায় ও জাটকা সংরক্ষণ করা যায় সেই লক্ষে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করবো।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
‘রাষ্ট্রের সকল স্তরে ইসলামী সংস্কৃতির অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে’
মেট্রোকে থামিয়ে ফাইনালে রংপুর
৪৩ বছর পর কুয়েতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী
আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করি, হাসিনার ভরসা ভারতে: দুলু
মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল, কানাডায় কি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন ট্রুডো?
পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য নিয়ে এবার এলো জাহাজ
ভারতের সেবাদাসী হাসিনাকে পুনর্বাসনে এবার জঙ্গি মিশনে তারা!
মাহফুজকে উপদেষ্টা থেকে বাদ দেওয়া উচিত? যা বললেন ড. জাহেদ
৬ বছরের মধ্যেই চীনের হাতে হাজার পরমাণু বোমা! উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের
বিগত সময়ে দলীয় স্বার্থ উদ্ধারে বড় ধরনের অপরাধ করেছে পুলিশ, এ জন্য আমরা লজ্জিত: আইজিপি
ব্রাহ্মণপাড়ায় পাঁচ দিনেও খোঁজ মিলেনি নিখোঁজ সোহাগের
কসবায় পাহাড় কাটার অপরাধে ২ জনের অর্থদণ্ড
নরসিংদীতে মাকে কুপিয়ে হত্যা, ছেলে গ্রেপ্তার
চট্টগ্রামকে বিদায় করে টিকে রইল খুলনা
পলাতক ১৯ বাংলাদেশি নাবিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
ফ্রিজে রাখা বাসি ভাতে উপকার দ্বিগুণ!
আ.লীগ দেশটাকে গোরস্থানে পরিণত করেছিল : জামায়াত আমির
সেনবাগে মর্মান্তিক মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় ভাগ্নে নিহত : মামা আহত
কুষ্টিয়ায় সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় গৃহবধুকে নির্যাতন
রাজশাহীর বাগমারায় পুকুর থেকে ভ্যান চালকের লাশ উদ্ধার