চোর-বাটপার-পকেটমাররাই সাজেন কাস্টমার
১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
ফরিদপুর বেইলি ব্রিজের ওপর হাট-বাজার দেখার কেউ নেই। বহু নারী হন ইভটিজিংয়ের শিকার দেখার কেউ নেই। এই পর্বটি গতকাল সোমবার ইনকিলাবে ছাপা হওয়ায় বেশ সাড়া পড়ে গেছে গোটা বাজার এলাকায়। চোর বাটপার ছিনতাইকারী আর পকেটমার সবাই সাজেন কাস্টমার। এমন কোনো দিন নেই যে আজকে ব্রিজের ওপরে বসা হাটে সওদা করতে এসে কেউ বিপদে পড়েননি। তা নারী পুরুষ বৃদ্ধ আবাল বনিতা যে কেউ হতে পারে।
ব্রিজ বাজারের সওদা কিনতে আসা যুবক মো. মতিয়ার ইনকিলাবকে বলেন, সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ব্রিজের উপর অবস্থানরত অসাধু চক্রের সদস্যরা সবাই বিপদগামী। সবাই কম বেশি নেশাও করে। এদের ধারা সংগঠিত কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলেই উল্টো বিপদ বিচারপ্রার্থীর। যেমন আমিও পড়েছি। এক হাজার টাকার মাছ কিনছি ভাল থেকে অথচ ব্যাগের মধ্যে ঢুকানো হয়েছে পচা মাছ। প্রতিবাদ করে লজ্জা পেয়ে বাড়ি গেছি। বিচার দিবো কাকে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক বা বাজারের নেতারা সবাই নিথর।
ফরিদপুর সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজ বিএ পড়ুয়া ছাত্রী সায়লা ইনকিলাবকে বলেন, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ব্রিজের ওপর চলে দফায় দফায় কিশোর গ্যাংয়েরদের মহড়া। তবে তারা বয়সে খুবই তরুণ। এদের গ্রুপে রয়েছে ১০ থেকে ১২ জনের একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। ব্রিজে যারা চুরি ছিনতাই করে তাদের সহযোগী বন্ধুরাই এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। আমি নিজে এদের যন্ত্রণার শিকার।
বাজার এলাকার একজন নরসুন্দর বাবলু শীল ইনকিলাবকে বলেন, ব্রিজের উপরে চোর বাটপার ছিনতাইকারী এবং পকেটমার এরা সকলেই পরস্পর পরস্পরের সহযোগী। যেকোনো কাজ করলেই অর্ধেক অর্ধেক ভাগ। আবার বিপদে পড়লেও এই বন্ধুরাই স্ব-স্বকে রক্ষা করে জনতার হাত থেকে।
তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় ব্রিজের ওপরে কোনো অঘটন ঘটলেও বাজার কমিটির কোনো নেতাকর্মীর কাছেই এর বিচার কেউ দেয় না। কারণ হিসেবে বেরিয়ে আসছে একটি ভয়ঙ্কর তথ্য উপাত্তের ভয়ঙ্করী দৃশ্যের মানচিত্র। সরেজমিনে প্রতিবেদনকালে দেখা গেছে, বিষয়টি এরকম ব্রিজের পশ্চিম পাশে হাজী শরীতুল্লাহ বাজার। এই বাজারের শেষাংশে বায়তুল মোকদ্দম মসজিদ মার্কেট এবং কেন্দ্রীয় মসজিদ। পাশাপাশি দুটি ঐতিহ্যবাহী বাজার আছে এই বাজার নিয়ন্ত্রণে আছেন। কমপক্ষে ৩৫টি ব্যবসায়ী গ্রুপ। এই গ্রুপ নেতারাই বাজার ব্যবসায়ীদের ভাল মন্দ দেখাবাল করেন। দক্ষিণ অংশে ফরিদপুর অঞ্চলের বৃহত্তর যৌনপল্লী। এই যৌনপল্লীটি নিয়ন্ত্রণ করে পাঁচ থেকে ছয় জন মাদক ব্যবসায়ী কাম গডফাদার।
এখানে রয়েছে নেশার বাবা, গাঁজা খাওয়া খাজাবাবা, মাদক সম্রাট ও মাদক সম্রাজী। তাদের ঘরের সন্তানরাই ওপেন বুক ফুলিয়ে ব্রিজের ওপর, মসজিদ গলি, যৌন পল্লীর গলি, রথখোলা গলি, পানবাজার গলি, গুর বাজার গলি, রবিদাস পল্লীর গলি, মাছ বাজার গলি, প্রকাশ্যে শতশত মানুষের মাঝে হাতে পকেটে নিয়ে বিক্রি করে গাঁজা, ইয়াবা। একটু আড়াল করে বিক্রি হয় ফেনসিডিল। সব অবৈধ ব্যবসায়ী এই বেইলি ব্রিজ কেন্দ্রীক। মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা গডফাদারদের আর্শীবাপুষ্ট অপরাধীরা। কারণ তিন শতাধিক যৌন পল্লী ও প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন মাদক ব্যবসায়ীও লাভের মুখ দেখছেন যৌনপল্লী ও বেইলি ব্রিজের ওপর নির্ভর করে।
তারা বেশিরভাগ আলোতে অন্ধকার হয়ে ছড়িয়ে ছিটয়ে থাকেন। সকলেই থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এদের হাত পায়ের উপর নিচ দিয়ে বেড়ে উঠে যৌনকর্মীর ঘরে জন্ম নেয়া অবৈধ সন্তানরা। এখানেও রয়েছে আলাদা গডফাদার। এই গডফাদারদের রয়েছে ১৮ থেকে ২০ জন ছোট ছোট বাচ্চাফাদার। এই বাচ্চা ফাদাররাই নিয়ন্ত্রণ করে কিশোর গ্যাংকে। রথখোলা যৌনপল্লী রথখোলা নদীর পাড়, রথখোলা ব্রিজ, পানবাজার, মাছ বাজার, মসজিদ গলি, হাজরতলার মোড়, রবিদাস পল্লী এবং আশপাশের এলাকা এদের নিরাপদ অভয়ের আশ্রয়স্থল।
এখানে কোনো ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী গডফাদারদের কানে চলে যায়। তারা মিলেমিশে কিশোর গ্যাং এবং বাচ্চাফাদারদের একত্রিত করে লোক দেখানো বিচার করে বা শাষণ করে ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দেয়।
এ কারণে যে কোনো অপরাধ, যে কোনো ঘটনা এবং দুর্ধর্ষ কাজ কাম সবকিছুই পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায় জামেলা ছাড়াই। বিষয়গুলো বাজার কমিটির কোনো নেতার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। আবার পৌঁছালেও বাজারে রাতদিন ব্যবসা করতে হবে। সব সময় চলাচল নিরাপদে চলাচলের জন্য যে প্রত্যেক ব্যবসায়ীর অবস্থান পাকাপোক্ত করে রাখতে ইচ্ছে করেই বৃহত্তর ঝামেলায় জড়ান না। ফলে সব অপরাধীরাই অধরা থেকে যায়। সকল সন্ধ্যা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হয় বেইলি ব্রিজ কেন্দ্রীক।
বিষয়টি আরেকটু পরিস্কার করলে সবার বুঝতে সুবিধা হবে। যেসব কিশোররা বেইলি ব্রিজের উপর সন্ধ্যা থেকে রাত ৯ থেকে ১০টা পর্যন্ত মরা তাজা, রং করা মাছ, টেবলেট দিয়ে ধরা মাছ, রং করা সিংগি মাছ, মিথাইন দেয়া বড় বড় মাছ বিক্রি করে এরা সবাই একটি শ্রেণিবদ্ব। কিশোর গ্যাং এবং এই ক্ষুদে মাছ ব্যবসায়ীরা সবাই সবার আপনজন। এরাই বিভক্ত হয়ে রথখোলা সড়কে এবং ব্রিজের উপর মাদক এবং মাছের ব্যবসা করে। দুই জায়গায়ই অবস্থান নেয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ব্যবসার খাতিরে হোলসেল ব্যবসায়ী, মূল ব্যবসায়ী, ছোট ব্যবসায়ী, কেউ কোনো ঝামেলা জড়াতে চায় না। তাই মুখ বুজে সবকিছু হজম করে নেন। এই বাজারে দু এক মাস পরপরই শোনা যায় বড় বড় চুরির ঘটনা। কারো দোকানের শাটার ভেঙে, কার দোকানের তালা ভেঙে, কারো বা দোকানের উপরের চাল খুলে লক্ষাধিক টাকা, লাখ টাকার বা দামের জিনিসপত্র সবকিছু নিয়ে হজম করে ফেলে এই কিশোর গ্যাং কাম বিপদগামীরা। নিজের চোখে দেখলেও বিচার দেয়ার উপায় নাই। গডফাদারদের আশ্রয় পেয়েই ছিঁচকে চোরাই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।
যেকোনো সময় যখন তখন যেকোনো ব্যবসায়ী হকার বা দূর থেকে আগত ব্যবসায়ীদের গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা বোধ করে না এরাও। তাই মান সম্মান ও লোকলজ্জা এবং ব্যবসা করার ভয়ে নীরবে নিভৃতে সহ্য করে যায়। কিন্তু কিছুই করার থাকে না। এইসব চোর বাটপার, পকেটমার, ছিনতাইকারী ৯০ শতাংশই এই যৌনপল্লীতে বেড়ে ওঠা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
এই বিষয় হাজী শরীতুল্লাহ বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হোসেন হাওলাদার ইনকিলাবকে বলেন, ইতোপূর্বে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক সদর ইউএনও, কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ আমাদেরকে বেইলি ব্রিজের উপরের সব অবৈধ বাজার তুলে দেয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করেছেন। আমরা তাদের কাছে পুলিশের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে পিছনে পড়ে যায়। ব্রিজটি দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হলেও অদৃশ্য শক্তির কারণে আর হয়ে উঠে না। চলবে। আগামীকাল পড়ুন ব্রিজের উপর অবৈধ হাটের হকার ও টো ব্যবসায়ীদের পুর্নবাসন করলেই ব্রিজটি অবৈধ বাজারকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সকল শ্রেণির মানুষ নিরাপদ ও বাধাহীন অবস্থায় ঘরে ফিরতে পারবে। আজই হকার বলুন একটি ইনকিলাব দিতে। (চলবে) আসছে তৃতীয় পর্ব।
বিভাগ : জাতীয়