পর্দার আড়ালে বাণিজ্য সচিব!
১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বেসামাল নিত্যপণ্যের বাজার। দামের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা দেশের সাধারণ মানুষ। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ১০০ দিন পেরিয়ে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, তারা আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে দিয়ে পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। অনেক কর ও শুল্ক কমিয়েছি। তারপরও দাম কমেনি, এটি আমার আফসোস। ডিমের দাম কমছে না, পেঁয়াজের দাম কমছে না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। সরকারের পক্ষ থেকে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
পর্দার আড়াল থেকে বাণিজ্য সচিব সিন্ডিকেট জিইয়ে রাখছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের ধীরগতির কারণে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে এবং রাজধানীর বাজারে ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া যাচ্ছে না। বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে বলে জানা গেছে। ফ্যাসিবাদি সরকারের সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর আস্থাভাজন বাণিজ্য সচিব মোহা: সেলিম উদ্দীন। মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকাকালে তাকে পছন্দ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসা হয়। এর আগে তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং পিডিবির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপসহ বিভিন্ন গ্রুপের সাথে গোপন চুক্তি করে তেল বাণিজ্য করছেন সচিব। এ ছাড়া সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল সয়াবিন তেল ও পাম তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছিল। বিশ্ববাজারে গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে সয়াবিন তেল ও পাম তেলের মূল্য বেড়েছে। এর মধ্যে, অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের মূল্য ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং পাম তেলের মূল্য ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়।
বৈঠকের প্রস্তাবে স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য না বাড়িয়ে আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা ও স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছে। অনেক সচিবকে ওএসডি এবং অবসর দেয়া হলেও বাণিজ্য সচিব মোহা: সেলিম উদ্দীন এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। বাজারে পেঁয়াজ থেকে শুরু করে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, আলু কিনতে ভোক্তাকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। তবে দেশের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করার পরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি চাল, পেঁয়াজ ও আলুর বাজার। দাম বাড়ার পেছনে একটি বড় অসাধু সিন্ডিকেট চক্র কাজ করছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতারা এখনো বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছে। মূলত এখনো তারাই কারসাজিতে সক্রিয়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার এখনো সেই সিন্ডিকেটের হদিস খুঁজে বের করতে পারেনি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের বাজার ও রাজনীতিতে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রাজধানীর সবজির বাজারে চরম অস্থিরতা। তদারকির কোনো প্রভাবই নেই; বরং চলছে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বন্যা আর বৃষ্টির অজুহাত। সবজির বাজারের এমন নৈরাজ্যের কারণে জনমনে অসন্তোষ বেড়েই চলেছে। জিনিসপত্রের অভাব নেই কিন্তু দাম বাড়ছেই। বাজার মনিটরিংয়ের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই বলে মনে করছেন ক্রেতারা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বসে প্রতিদিনই আওয়ামীপন্থী অফিসারদের নিয়ে বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানামুখী ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। একই অভিযোগ রয়েছে সচিবসহ আরো কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মোহা: সেলিম উদ্দীনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেনি।
অন্যদিকে প্রতিযোগিতা আইন ২০১২-এর আওতায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন স্থাপন করা হয়েছে। সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা এই প্রতিযোগিতা কমিশনকে দেয়া হয়েছে। তাদের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক জরিমানা করার। কোনো ব্যক্তি প্রতিযোগিতা-বিরোধী চুক্তি সম্পাদন বা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার করলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মুনাফার তিনগুণ অথবা বিগত তিন অর্থবছরের গড় টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করার এখতিয়ার রাখে। একই সাথে বিভিন্ন পণ্যের ওপর প্রতিনিয়ত মার্কেট স্টাডি করাও তাদের দায়িত্ব। কাজেই বাজারে যদি কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজারে প্রতিযোগিতা নষ্ট করে, তবে তা প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের দায়িত্ব মূলত বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের। কিন্তু আওয়ামী সরকারের অনুগত কর্মকর্তাদের এই প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ থাকায় তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। দামের দিক থেকে সেঞ্চুরি করেছে কয়েক ধরনের সবজি। ওসব সবজি স্বাভাবিক সময়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। সবজি ছাড়াও ডিম, আলু, রসুন, পেঁয়াজসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামই আকাশছোঁয়া। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এই মন্ত্রণালয়েল দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কর্মরত পতিত আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজনরা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। সিন্ডিকেটকে সুবিধা করে দিতে ভারসাম্য তৈরি থেকে বিরত থেকেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে কিছু কোম্পানিই পুরো বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। সরকারের ছায়াতলে থাকা এসব সিন্ডিকেট জনগণের পকেট থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এক মাস আগে গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেছিলেন, সিন্ডিকেট শনাক্ত এবং ভেঙে দেয়ার চেষ্টা চলছে। আমরা সবার সহযোগিতা চাই। যদি সিন্ডিকেটের বিষয়ে কোনো তথ্য থাকে, কারা দাম বাড়াচ্ছে এবং একচেটিয়া ব্যবসা করছে তা আমাদের জানান। সরকার অবশ্যই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। বাজারে সরবরাহ থাকলেও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে প্রতি কেজি পেঁয়াজ দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। ৪৮-৫২ টাকার পেঁয়াজ বাজারে এসে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। ২০-২৫ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭৫-৮০ টাকায়। মাসের ব্যবধানে ভোজ্যতেল লিটারে সর্বোচ্চ ২০ টাকার মতো বেড়েছে। আর চাল কিনতে ক্রেতার বাড়তি গুণতে হচ্ছে ২-৬ টাকা। এমনইভাবে প্রতি বছর ভোক্তাকে জিম্মি করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। মুনাফা লুটছে সেই সিন্ডিকেট। অথচ সিন্ডিকেট দমনে ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হয়। ২০১৮ সালে প্রণীত হয় কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণ আইন। কিন্তু এসব আইন প্রয়োগে যে বিচারিক ব্যবস্থা দরকার, সেগুলো অনেক সময় কাজ করে না। গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক কর ও শুল্ক কমিয়েছি। তারপরও দাম কমেনি, এটি আমার আফসোস। ডিমের দাম কমছে না, পেঁয়াজের দাম কমছে না। কোল্ড স্টোরেজে যেসব ব্যবসায়ী আলু সংরক্ষণ করছেন, তারা এখন দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। ওদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে একাধিক পণ্য আমদানিতে শুল্কছাড় দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন উঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। ব্যাংক থেকে যেকোনো পরিমাণ ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করতে পারবেন। তবে বাজারে পণ্যের দাম কমানো যাচ্ছে না; বরং সরকারের দেয়া এসব সুবিধা ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাচ্ছে। ভোক্তা-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায়। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের অনেক সংস্কার কর্মসূচিই বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বাজারে স্বস্তি ফেরাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করার পরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি চাল, পেঁয়াজ ও আলুর বাজার। কারওয়ান বাজারের আড়তদার ময়নাল হোসেন জানান, আলু বীজ তৈরির জন্য সংরক্ষণ করছেন কৃষক। নতুন আলু না আসা পর্যন্ত আলুর দাম বাড়তি থাকবে। আলুর মতো নতুন পেঁয়াজ ওঠার আগেই দাম বেড়েছে মসলা জাতীয় পণ্যটির। গত ৬ নভেম্বর পেঁয়াজ আমদানির ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করা হলেও এর বাজারে প্রভাব দেখা যায়নি। দেশি ও আমদানি করা উভয় ধরনের পেঁয়াজের দামই গত সপ্তাহের তুলনায় ১০-১৫ টাকা বেড়েছে কেজিতে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা কেজি। দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকায়। বাজারে চালের দাম এ সপ্তাহে আর বাড়েনি, কমেওনি। মানভেদে বাজারে প্রতি কেজি নাজিরশাইল, কাটারি, জিরাশাইলসহ সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৮২-৮৫ টাকায়। এ ছাড়া বিআর-২৮ ও ২৯, মিনিকেট, পাইজামসহ মাঝারি মানের চাল ৬৫-৭০ টাকা এবং গুটি, স্বর্ণা, চায়না ইরিসহ মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮-৬০ টাকায়। অথচ চালের দাম কমাতে গত অক্টোবরে দুই দফায় আমদানি শুল্ক সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে আনা হয়। এতে আমদানি খরচ কমেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও খুলে দেয়া হয় আমদানির দুয়ার। কিন্তু এক টাকাও কমেনি চালের দাম। চাল বিক্রেতা মো. আলমগীর বলেন, আগের কেনা চাল বিক্রি শেষ হলে নতুন চাল আসবে। তখন হয়তো দাম কিছুটা কমতে পারে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) থেকে বলা হয়, বর্তমান চালের দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ থেকে ১৩ শতাংশ বেশি। একইসঙ্গে এক মাসের ব্যবধানে আলুর দাম কেজিতে বেড়েছে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত। পাশাপাশি দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কোম্পানি থেকে আমাদের তেল সরবরাহ করছে না। কম করে সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে। এ কারণে বাজারে সরবরাহ কম। খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত তেলের সংকট দেখা দিচ্ছে। সারা দেশে টাস্কফোর্স গঠন করে বাজার তদারকির উদ্যোগ নেয়া হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো যাচ্ছে না। সোমবার দেশের প্রতিটি জেলা পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠনের পরও দাম বাড়ছে। সবজির বাজারেও পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। ভোক্তাদের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বাজার সিন্ডিকেট ভাঙা জরুরি। সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল সিন্ডিকেট ভাঙবে। তবে সেটি দৃশ্যমান নয়। সরকার গঠনের পর চাঁদাবাজি বন্ধ হওয়ায় কিছু পণ্যের দাম কমেছিল। তবে চাঁদাবাজি হাতবদল হওয়ায় ফের পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে পুরোনো সেই সিন্ডকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়েছে পণ্যের দাম।
ভুক্তভোগী জনগণ মনে করেন, করপোরেট হাউজগুলোর নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের সাথে সচিবালয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছানো যেত। তারা দেশের ব্যবসায়ী হলেও, ব্যবসার স্বার্থে তাদের পক্ষ থেকে সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু সরকারের উপদেষ্টাদের তরফে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে জনগণের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে, কারণ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
গত ৩০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরেন ট্রেড ব্যারিয়ারস’ বা বৈদেশিক বাণিজ্যে বাধা-বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু বাধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ঘুষ-দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতাকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে অন্যতম বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দফতর ইউএসটিআর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিদেশি বিনিয়োগ বাধা নিয়ে ২০২৪ জাতীয় বাণিজ্য প্রাক্কল শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ও বাছাই প্রক্রিয়ার কথা বলে থাকে। তবে নিজের শুল্ক মূল্যায়ন নীতি সম্পর্কে এখনো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে (ডব্লিউটিও) অবহিত করেনি দেশটি। এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় ইলেকট্রনিক প্রকিউরমেন্ট পোর্টাল চালু করলেও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদাররা বিভিন্ন দরপত্রে প্রত্যাশিত পণ্যের পুরোনো কারিগরি মান নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এ ছাড়া কারিগরি মান পছন্দের দরদাতাদের কাজ দেয়ার উদ্দেশ্যে নির্ধারণ করা হয় কি না, তা নিয়ে মার্কিন অংশীদারদের সন্দেহ আছে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এতেও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি কোম্পানির দাবি, ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির দরপত্র ঠেকাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বীরা স্থানীয় অংশীদারদের ব্যবহার করে। এমনকি দরপত্র বাছাইয়ে কারচুপির অভিযোগও ওঠে এসেছে। ডব্লিউটিওর সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত চুক্তির অংশীদার নয় বাংলাদেশ। ডব্লিউটিওর এ সংক্রান্ত কমিটির পর্যবেক্ষক হয়নি দেশটি। মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু আইনগত উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশে এর কার্যকর প্রয়োগ অনিশ্চিত। মার্কিন প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, সারা বাংলাদেশেই নকল ও পাইরেটেড পণ্য সহজলভ্য। ভোগ্যপণ্য, পোশাক, ওষুধ ও সফটওয়্যার খাতের পণ্যগুলো বাংলাদেশে নকল হচ্ছে বলে মার্কিন অংশীদাররা অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশে ডিজিটাল বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন বাধার কথা উল্লেখ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (২০১৩ সালে সংশোধিত) কথা বলা হয়েছে। যেখানে উল্লেখ করা হয় এই আইনের মাধ্যমে কীভাবে বাংলাদেশ সরকার তথ্য বা উপাত্ত প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে যেকোনো কম্পিউটার সিস্টেমে প্রবেশ এবং তথ্য আটকানোর কাজ করতে পারে। ডিজিটাল বাণিজ্যে বাধা হিসেবে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) মোবাইল অপারেটরদের রাজনৈতিক কারণে ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২৩ সালে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনসহ রাজনৈতিক কর্মসূচির আগে বিভিন্ন সময়ে ডেটা ট্রান্সমিশন সীমিত করার নির্দেশ দিয়েছে। বলা হয়, বিটিআরসি মোবাইল অপারেটরদের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ভয়েস কল ব্যতীত সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত সমস্ত পরিষেবা ব্লক করার নির্দেশ দিয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে মন্ত্রিসভা থেকে নীতিগতভাবে অনুমোদন পাওয়া ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি বিভাগ) ডেটা সুরক্ষা আইনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। যেখানে শিল্প এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি বিস্তৃত এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা এবং দুর্নীতি দমন আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় না। সুবিধা প্রদান এবং উপহারের অবৈধতা সত্ত্বেও বাণিজ্যিক লেনদেনে ঘুষ এবং চাঁদাবাজি ব্যবসার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ চাওয়ার কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলো লাইসেন্স ও বিডের অনুমোদন পেতে দীর্ঘ বিলম্বের অভিযোগ করেছে। প্রতিবেদনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছেÑ এমন বিষয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রণীত সরকারি চাকরি আইন বিল হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, যেকোনো সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করার আগে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে দুদকের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে। এর পরও দুদক ক্রমবর্ধমানভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করছে। তবে সেখানে বহু মামলাই অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে প্রতিবেদনে বলা হয়।
বিভাগ : জাতীয়