বিচারহীন মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনা
২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০১ এএম
থামছে না সড়কে মৃত্যু। প্রতিদিন সড়কে ঝরছে তাজা প্রাণ। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য দেশে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এই এক্সপ্রেসওয়েতে দ্রুত গতিতে চলাচল করছে যানবাহন। নির্মাণ করা হয়েছে ফ্লাইওভার। কিন্তু এতোকিছুর পরও কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা। বরং এক্সপ্রেসওয়ে ও ফ্লাইওভারে নিয়মিতই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। বছরে কত মানুষ সড়কে মারা যাচ্ছেন তার সঠিক হিসাব নেই। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর হাতে সড়কে প্রাণহানির যে তথ্য রয়েছে তাতেও বড় ধরনের গড়মিল। সড়কে হতাহতের ঘটনার মামলা, তাতে কত আসামি দণ্ডিত হচ্ছে, সেই হিসাবও নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় আলোচিত মৃত্যু হলেও বিচার হয়না। সড়ক দুর্ঘটনার মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রবণতা কম। ৮০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা মামলা করেন না। সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় বিচার হয় না মনে করে মামলার ঝামেলায় যান না অনেকেই। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে বিচারের জন্য কেউই এগিয়ে আসে না।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানুষের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। প্রতি বছর হাজরো মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো মুখোমুখি হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার। এই দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ছে। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায় মোটরবাইক, অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস এবং অ্যাম্বুলেন্স আরোহী হিসেবে একসাথে পুরো পরিবার বা এক পরিবারের অধিক সদস্য নিহতের প্রবণতা বাড়ছে। গত ৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় শতাধিক পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫ ব্যক্তির প্রাণহানি হচ্ছে। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষ নিহত ও ৩৫ হাজার আহত হন। সড়ক পরিবহন আইন আছে এবং প্রচারণাও যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু কেন সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়কে প্রাণহাণি কমছে না। সড়ক দুর্ঘটনা বিশেষ করে মোটর সাইকেলের দুর্ঘটনা অন্যতম। এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্য সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, সড়কে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত সমাজের উচ্চপর্যায়ের বিচার হয় না। বুয়েটের একজন মারা গেলো। একটা ধারণা যে সমাজের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যারা আছেন তাদের বিচার হয় না, জবাবদিহিতা হয় না। এখানে সাধারণ মানুষদের জীবনটাই আসলে যায়। এই চিত্র আমাদের সমাজে আছে। এটার পরিবর্তন দরকার। সবাইক বিচারের আওতায় আনা দরকার। এখানে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। উন্নয়ন নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। এখন রাস্তায় বের হয়ে মানুষ মারা গেলে সেটাকে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলা হচ্ছে। কারণ এটা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে হচ্ছে। এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করে রাখা হয়েছে রাস্তায় মানুষ বের হলে মানুষ মারা যেতে পারে। এখানে ব্যবস্থাপনাতেই সমস্যা রয়েছে। যে ধরনের প্রতিষ্ঠান সড়কের নিরাপত্তা দিতে পারে সেটাই তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশে মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণে কোনো আইন প্রয়োগ নেই। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সরকারের আর্থিক নীতিতে এই দুই চাকার যানবাহনের ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে। সড়কে মোটরসাইকেলের আধিক্যের কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। চার চাকার যানবাহনের তুলনায় দুই চাকার যানবাহন ৩০ গুণ বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ। এ ছাড়া বিশৃঙ্খল যানজটও দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। টু-হুইলারগুলি ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণহীন। ফলে গাড়িগুলো চালানোর সময় চালকেরা ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। স্পিড ব্রেকার এবং ছোট গর্তও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এই সব রাইডারের চালকরা বয়সে তরুণ। ফলে খুব নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালনায় তারা অভ্যস্থ। দুর্ঘটনায় পতিত হলে এইসব হালকা গাড়ির চালক ও আরোহী বড় গাড়ীর চাপায় মারা যায়।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। গণপরিবহন ৫৩ শতাংশ যাত্রী বহন করে, আর ব্যক্তিগত যানবাহন ১১ শতাংশ যাত্রী বহন করে। অথচ ব্যক্তিগত যানবাহন ৭০ শতাংশ সড়ক দখল করে চলে। ৩০ শতাংশের কম জায়গায় চলে গণপরিবহন। এটি সাধারণ মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, গত নভেম্বর মাসে দেশে ৪১৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৯৭ জন নিহত, ৭৪৭ জন আহতের তথ্য পাওয়া গেছে। এই মাসে রেলপথে ৬৪টি দুর্ঘটনায় ৭৯ জন নিহত, ৪৩ জন আহত হয়েছে। নৌ পথে ৭টি দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত, ২৯ জন আহত এবং ২ জন নিখোঁজ রয়েছে। সড়ক, রেল ও নৌ-পথে সর্বমোট ৪৮৬ টি দুর্ঘটনায় ৫৮২ জন নিহত এবং ৮১৯ জন আহত হয়েছে। এই সময়ে ১৬৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৯২ জন নিহত, ১১১ জন আহত হয়েছে। যা মোট দুর্ঘটনার ৪০.২৪ শতাংশ, নিহতের ৩৮.৬৩ শতাংশ ও আহতের ১৪.৮৬ শতাংশ। এই মাসে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে ঢাকা বিভাগে, ১০৬ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১২৯ জন নিহত ও ২৬৪ জন আহত হয়েছে, সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে, ২৬ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত ও ৪৫ জন আহত হয়েছে।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পূর্বাচলের তিনশ’ ফিট এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় বুয়েটের এক ছাত্র নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ২ জন। একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয় একটি প্রাইভেটকার। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান মোটরসাইকেল আরোহী বুয়েট ছাত্র মোতাসিম মাসুদ। আহত হন মেহেদী খান ও অমিত সাহা নামে আরও দুজন। রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন সাংবাদিক কাওসার মাহমুদ। গুলিস্তান থেকে ফ্লাইওভারে উঠে কিছু দূর যাওয়ার পর একটি সিএনজি পেছন দিক থেকে তার মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দেয়। এতে ছিটকে পড়ে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আহত হন। দুর্ঘটনায় তার বাম পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙে গেছে। ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে সড়ক দুর্ঘটনায় ইসমাইল হোসেন জমাদ্দার নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় তার বন্ধু মনির হোসেন নামে আরও একজন আহত হয়েছেন। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের বিভিন্ন স্থানে আলাদা পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৬ জন গুরুতর আহত হয়েছে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন বলেন, বিআরটিএ ও পুলিশ সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হিমশিম খাচ্ছে। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। ফুটপাথ দখলমুক্ত করার পরই আবার দখল হয়ে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশন বলেছে তারা সকালে দখল মুক্ত করলে আবার বিকালে আবার বেদখল হয়। তাহলে এমন দখল মুক্ত করে কিছু হচ্ছে না। এটা যেন সাস্টেইন করে সেটা করতে হবে। কোনো পুরাতন বাস রাখা হবে না। সময় দেওয়া আছে, এর মধ্যে ব্যবস্থা নেন। সড়ক ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে স্থায়ী পরিকল্পনা করা হচ্ছে। পরিকল্পিত সমাধান করার চিন্তা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নির্ভুল পরিসংখ্যান তৈরি করা উচিত। যাতে দুর্ঘটনার ধরনও জানা যায়। কারণ ও ধরন নির্ভুলভাবে জানতে পারলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। তথ্যই বলে দিচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কতটা বেড়েছে। নির্ভুল পরিসংখ্যান থাকলে দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। যেমন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান বলছে, এই দ্বিচক্রযানটি নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু এগুলো বেসরকারি সংগঠনের তথ্য। সরকারি সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে পরিকল্পনা করা ও ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হতো।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের কোন ঘটনা আলোচিত হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্তরা আইনের আশ্রয় নেন না। একদিকে ট্রাফিক আইনের দুর্বল ব্যবস্থা এবং আইন প্রয়োগের শিথিলতা। অন্যদিকে, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রভাবশালী হওয়ায় সাধারণ যাত্রীরা তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে সাহস করেন না। অথবা কেউ যদি মামলা করেন তার দীর্ঘসূত্রিতার কারণেও অনেকে বিচার চাইতেও আগ্রহী হয় না। যে সমস্ত সড়ক দুর্ঘটনা হয়, তার ৮০ শতাংশই কিন্তু আপোষ নিষ্পত্তি হয়ে যায়। যে ২০ শতাংশ মামলায় পর্যন্ত গড়ায়, তারও ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে আসামীরা খালাস পেয়ে যায়। যার কারণে কেউ মামলা করতে আগ্রহী হয় না।#
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার
ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস
ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?
বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত
হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি
কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫
ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি
উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন
বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের
নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত
সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প
আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ
মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা
জামালপুরে দুই ইজিবাইকের চাপায় সাংবাদিক নুরুল হকের মৃত্যু
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের সামরিক সদর দফতরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি
ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২
নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়
ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে