৯ মামলার আসামি এক মুক্তিযোদ্ধা ‘জুতার মালা’য় হিরো!
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
সোস্যাল মিডিয়ায় একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায় একজন মানুষকে জুতার মালা পরিয়ে কয়েকজন তাকে এলাকা থেকে চলে যেতে বলছেন। জুতার মালা পরিচিত ব্যাক্তি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মালা গলায় হাঁটছেন, মালা খুলছেন, দুই পাশে দুই ব্যাক্তি তার হাত ধরছেন। ফের মালা পরিয়ে দিয়ে ওই ব্যাক্তি কি যেন বলছেন। অন্যব্যাক্তিরা তাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, আপনি কি আমাদের এলাকায় থাকতে দিয়েছেন? ভাইরাল ভিডিওটি কুমিল্লার চৌদ্ধগ্রামের।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গত রোববার দুপুরের এই ঘটনা লাঞ্ছনাকারিরা ভিডিও ধারণ করার পর রাতে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। ভুক্তভোগী ওই ব্যাক্তির নাম আবদুল হাই ওরফে কানু (৭৮)। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার লুদিয়ারা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল হাই কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও একই সংগঠনের কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার সাবেক সহসভাপতি। ১৫ বছর প্রতিপক্ষকে নানাভাবে জুলুম নির্যাতন করায় তার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা রয়েছে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক চলছে। দেশ ও ভারতের কিছু গণমাধ্যম লাঞ্ছনার শিকার আবদুল হাই ওরফে কানুর নামের আগে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে তুলে ধরার প্রতি জোর দিয়েছেন বেশি। গণমাধ্যমে খবর পড়লে মনে হয় বীর মু্িক্তযোদ্ধা হওয়ায় আবদুল হাইয়ের গলায় জুতার মালা দেয়া অন্যায়; মুক্তিযোদ্ধা না হলে আমজনতার গলায় জুতার মালা দেয়া যায়।
খবরে বলা হচ্ছে একজন বীরমুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে হেনস্তাকরা মেনে নেয়া যায় না। তাহলে কি মুক্তিযোদ্ধা না হলে তার হেনস্তা সমর্থন করতে হবে? চৌদ্দগ্রামের অপ্রীতিকর ওই ঘটনা সমর্থনযোগ্য নয়, তবে কিছু গণমাধ্যমের খবর দেখে মনে হচ্ছে দেশে এই প্রথম কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে অপদস্ত করা হলো। এমন ঘটনা যেন বাংলাদেশে আর ঘটেনি। ১৯৯৯ সালে বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগ কি করেছিল সে দৃশ্য মানুষ কি ভুলে গেছে? আওয়ামী লীগের ১৫ বছর শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে যে ভাবে হেনস্তা করা হয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সে তালিকা করলে পত্রিকার পাতা ভরে যাবে। স্বাধীনতার ঘোষণ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কিভাবে হেনস্তা করে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল? মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকাকে তো বাংলাদেশে মরতেও দেয়নি হাসিনা সরকার। ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনের সঙ্গে কি আচরণ করা হয়েছে? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের ১৫ বছর নানাভাবে হেনস্তা করেছে আওয়ামী লীগ। এমনকি হাসিনা রেজিমে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা হলেই কি তার সাতখুন মাফ?
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একযুগ আগে একটি অনুষ্ঠানের খাবার টেবিল থেকে জামায়াত অনুসারি একজন ব্যবসায়ীকে জোর করে তুলে এলাকাছাড়া করেছিল মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই ওরফে কানু। অতপর জামায়াতের ওই ব্যবসায়ী বহু বছর গ্রামের ফিরতে পারেননি। এমনকি স্থানীয় জামায়াতের কয়েকজন নেতাকে এলাকাছাড়া করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা কানু। তারা হঠাৎ আবদুল হাই ওরফে কানুকে দেখে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে এই অপকান্ড ঘটিয়েছেন। ভিডিওতে দেখা গেছে কানু অনেকটা অপরাধীর মতো বিনাবাক্যে শাস্তি মেনে নিচ্ছেন। যদিও ঘটনাটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ রেজিমে আবদুল হাই কানুদের নির্যাতনের মুখে যারা পড়েছেন তাদের অবস্থা কেউ চিন্তা করছেন? মানুষের প্রতিশোধ স্পৃহা বলেতো একটি কথা রয়েছে। গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগ শাসনামলে মানুষের উপর জুলুমকারী আবদুল হাই কানুর অতীতের অপকান্ড আড়াল করে তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। বীর মু্িক্তযোদ্ধা হওয়ায় তিনি যা খুশি করবেন যাকে খুশি তার ওপর জুলুম নির্যাতন করবেন আর মানুষ মুখ বুঝে সহ্য করবে? ইউটিউবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেছেন, ‘গণমাধ্যমগুলোর খবর পড়ে মনে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাকে জুতার মালা পরানো অপরাধ আর আমজনতার গলায় জুতার মালা পরানো জায়েজ। আওয়ামী লীগ শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পচন ধরেছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা শেখ হাসিনার পা চেটেছেন। তারা হাসিনার কোনো অন্যায়কে সমর্থন জুগিয়েছেন। আওয়ামী লীগ যারা করেছে তার ৯৯ শতাংশ ক্রিমিনাল। তারা ধান্দাবাজী করেছে। অন্যদের মতো মুক্তিযোদ্ধা কানু ক্রিমিনালী করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নামের আগে বীর মু্িক্তযোদ্ধা লেখা হচ্ছে। এটা হাস্যকর। বীরছাড়া কেউ কি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন?’
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই ওরফে কানুর পরিবারের অভিযোগ, লাঞ্ছিতকারীরা সবাই স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। তারা স্কুল মাঠে আবদুল হাইকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিতকরার পর এলাকা ছাড়ার জন্যও হুমকি দিয়েছে। ওই ঘটনার পর আবদুল হাই কানু অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর তাকে ফেনীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে আবদুল হাই কানু ছিলেন নির্যাতনের শিকার। তিনি এক সময় চৌদ্দগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের পক্ষে রাজনীতি করে প্রতিপক্ষ নেতাদের ওপর জুলুম নির্যাতন করেন। ধান্দাবাজী করে পয়সা কামিয়েছেন। তার বাড়ির আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষকে অতিষ্ট করে তুলেছিলেন। জামায়াতের নেতাদের ঘরছাড়া করেন। কিন্তু পড়ে মুজিবুল হকের বিপক্ষে চলে যান। মুজিবুরের বিপক্ষ গ্রুপের হওয়ায় প্রতিপক্ষ্যের লোকদের পিটুনির ভয়ে ফলে গত প্রায় আট বছর এলাকাছাড়া ছিলেন। ওই সময় তাঁর বাড়িঘরে একাধিকবার হামলা চালিয়েছেন মজিবুলের লোকজন। ৫ আগষ্ট হাসিনা পালানোনর পর থেকে তিনি বাড়িতে থাকছেন। গত রোববার দুপুরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরই তাঁকে আটক করেন একদল লোক। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কুলিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। সেখানে তাঁর গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়। লাঞ্ছিতকারীরাই ঘটনাটির ভিডিও ধারণ করে রাতে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ১ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের ভিডিওতে দিয়ে দেখা যায়, দুজন ব্যক্তি জুতার মালা পরা অবস্থায় কানুকে টানাহেঁচড়া করছেন। তাঁকে লাঞ্ছিত করা ব্যক্তিদের একজনই পুরো ঘটনার ভিডিও করেছেন। এ সময় কানু কোনো প্রতিবাদ করেননি বারবার তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার আকুতি জানান।
আবদুল হাই কানুর ছেলে গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, হামলাকারীরা সকলেই স্থানীয় জামায়াত ও শিবিরের চিহ্নিত নেতা-কর্মী। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে লাঞ্ছিত করা হলো, আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে কার কাছে বিচার চাইব?
এ প্রসঙ্গে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাহফুজুর রহমান বলেন, ওসি সাহেব আমাকে বিষয়টি জানিয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনা মেনে নেওয়ার মতো না। আমরা ঘটনাটির খোঁজখবর নিয়ে দেখছি। জামায়াত ও শিবিরের কোনো নেতা-কর্মী এই ঘটনায় জড়িত হয়ে থাকলে আমরা অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ টি এম আক্তার উজ জামান বলেন, ‘ভিডিওটি দেখে আমি ওই ব্যাক্তির সঙ্গে দুইবার কথা বলেছি। তিনি কোনো অভিযোগ করতে রাজি হচ্ছেন না। বলছেন তিনি অভিযোগ করলে এলাকায় থাকতে পারবেন না, আর থানা পুলিশকেও ঝামেলায় ফেলতে চান না। তবে ওসি বলেন, আমরা এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে চৗদ্দগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাকে মানহানির ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ঘটনা তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, আবদুল হাই হত্যাসহ ৯টি মামলার আসামি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সবাইকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে তারা সুবোধ বালকের ভুমিকায় অবর্তীর্ণ হয়েছেন। হাসিনা রেজিমে মানুষের উপর জুলুম নির্যাতন করা আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা। তাকে গ্রেফতার দূরের কথা তিনি মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় তার পক্ষ নিচ্ছে অন্তর্র্বর্তী সরকার! দীর্ঘ ১৫ বছর যারা জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এলাকায় থাকতে পারেননি; ভারতের তাবেদার হাসিনা হটানোর আন্দোলন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের যেন তর সইছে না। এটা ঠিক মুক্তিযোদ্ধারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট সন্তান। কিন্তু তারা যদি অপরাধ করেন? শেখ হাসিনা কি মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসিতে ঝুলায়নি?
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ফরিদপুরের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে মামা-ভাগ্নের লাশ
সিরাজদিখানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ৩ জন টেটা বৃদ্ধ, আহত ১০
হাসিনাকে কি বাংলাদেশে নির্বাসিত করা হবে?
জকিগঞ্জে উপজেলা প্রশাসনের সেবা সহজীকরণ অনুষ্ঠান
লাকসামে বিএনপির আজিম-কালাম গ্রুপ মুখোমুখি: ককটেল বিস্ফোরণ, অস্ত্রের মহড়া
ভুয়া পেইজে ঢাবি প্রশাসনসহ অনেকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, এডমিন ঢাবি ছাত্রদল নেতা
ইটনায় বিএনপির স্বাধীনতার বিজয় উৎসবে নেতাকর্মী ও জনতার ঢল এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপি ৯০ শতাংশ ভোট পাবে: ফজলুর রহমান
ব্যান্ড সঙ্গীত ও বাইকপ্রেমীদের জন্য সুজুকি ও আর্টসেলের নতুন মিউজিক ভিডিও
বিএনপি সকল ধর্ম -বর্ণ-গোত্রের দল : প্রিন্স
বিয়ের করার সময় যে সমস্ত খেয়াল রাখা প্রসঙ্গে।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সূচি প্রকাশ, বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষ ভারত
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা
`আগামী নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করতে হবে'
সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য ও তার স্ত্রী তন্দ্রা ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
‘বিক্ষোভ আর কালো পতাকায়’ রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস বরণ!
ভারতে সাজাভোগ শেষে দেশে ফিরলেন ২৬ নারী-পুরুষ ও শিশু
লৌহজং উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ফরহাদ হোসেন ইমন গ্রেফতার
আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় আরও এক মাস বাড়ল
দূর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে: মেজর হাফিজ
শতভাগ দলীয়করণে ক্রীড়াঙ্গন আজ তলানিতে : আমিনুল হক