তালাকে এগিয়ে নারীরা
২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম
পাঁচ বছরের এক ছেলে সন্তানের মা সায়মা (ছদ্মনাম)। স্বামীকে তালাক দিবেন এ কারণে যে, তার শারীরীক সমস্যা আছে। স্বামীর কাছ থেকে সুখ-শান্তি মিলছে না। দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যা চলছে। তাতেও তার (সায়মা) সমস্যা ছিল না। যদি তার স্বামী নিজের শারীরীক সমস্যাটা মেনে স্বীকার করে নিতেন তাহলে তিনি তাকে তালাক দিতে চাইতেন না। এমনকি চিকিৎসাও করাচ্ছেন না। এসব কারণে তিনি তার স্বামীকে তালাক দিতে চান।
রনি। থাকেন তেজগাঁও এলাকায়। স্বামী-স্ত্রী দুজনই সরকারি কর্মকর্তা। ছয় মাস আগে মোটরবাইকে এক্সিডেন্ট করেছেন। মেরুদন্ডে খুব ব্যথা পেয়েছেন। হাড় ভেঙে যাওয়ায় হাসপাতালে ছিলেন কয়েকদিন। স্ত্রী তালাক চান। কারণ রনি আগের মতো শারীরীকভাবে সক্ষম না। মেরুদন্ডে ব্যথার কারণে নড়াচড়া করতে হয় সাবধানে। একারণে তার স্ত্রী তালাক চান। অথচ তাদের ঘরে ২টি সন্তান রয়েছে। এখন উভয়পক্ষ মিলে তালাক দিতে চান।
গত এক দশকে বিবাহ বিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এক্ষেত্রে বিচ্ছেদের বেশি আবেদন করছেন শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীরা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয়, মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ ও জীবনযাপন যখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় তখন মধুর সম্পর্ক তালাকের মাধ্যমে ছিন্ন করা হয়। ন্যায়সঙ্গত কারণে তালাক ইসলামে বৈধ। তবে এটি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বৈধ কাজ। কিন্তু দিন দিন তালাকের প্রবণতা বাড়ছে। শিক্ষিত ও অভিজাত পরিবারে তালাকের ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ও পরিবারগুলোতে তালাক এখন সাধারণ ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গত ২০২৪ সালের তালাকের হিসাবে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে স্ত্রী কর্তৃক ৩৯৫ স্বামী কর্তৃক ১৩৭ মোট ৫৩২টি তালাকের ঘটনা ঘটে। ফেব্রুয়ারি মাসে স্ত্রী কর্তৃক ৪৯৮ স্বামী কর্তৃক ১৮৭ মোট ৬৮৫টি। মার্চ মাসে স্ত্রী কর্তৃক ৫২৮ স্বামী কর্তৃক ২১১ মোট ৭৩৯টি। এপ্রিলে স্ত্রী কর্তৃক ৪৭৫ স্বামী কর্তৃক ৬৬ মোট ৫৪১টি। মে মাসে স্ত্রী কর্তৃক ৪৮৬টি স্বামী কর্তৃক ৮০টি মোট ৫৬৬টি। জুন মাসে স্ত্রী কর্তৃক ৪৯১ স্বামী কর্তৃক ২১২ মোট ৭০৩টি। জুলাই মাসে স্ত্রী কর্তৃক ৪২৭ স্বামী কর্তৃক ১৯৬ মোট ৬২৩টি। আগস্ট মাসে স্ত্রী কর্তৃক ৪৫৯ স্বামী কর্তৃক ১৮৮ মোট ৬৪৭টি। সেপ্টেম্বর মাসে স্ত্রী কর্তৃক ৫৮৫ স্বামী কর্তৃক ২৬১ মোট ৮৪৬টি। অক্টোবরে স্ত্রী কর্তৃক ৫৫২ স্বামী কর্তৃক ২৪৪ মোট ৭৯৬টি। নভেম্বরে স্ত্রী কর্তৃক ৪৫৩ স্বামী কর্তৃক ১৯২ মোট ৬৪৫টি। এবং ডিসেম্বর মাসে স্ত্রী কর্তৃক ৪১৫ স্বামী কর্তৃক ১৭৫ মোট ৫৯০টি তালাকের ঘটনা ঘটে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের বরাবর তালাকের আবেদনের সংখ্যাও বাড়ছে। বছরে যে পরিমাণ তালাকের আবেদন করা হয় তার গড়ে ৭০ শতাংশই স্ত্রীদের। স্বামীদের আবেদন কম। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসসিসিতে তালাকের আবেদন করেছেন ৬ হাজার ৩৪৫ জন। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪২৮টি আবেদন করেছেন নারী বা স্ত্রীরা। এক হাজার ৯১৭টি আবেদন স্বামীদের। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) মোট তালাকের আবেদন করা হয়েছে ৭ হাজার ২৪৬টি। বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীদের উচ্চাবিলাসী মনোভাব, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা, ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতে অসামর্থ্য অথবা অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা বা অনীহা ইত্যাদি তথ্য উঠে আসে।
২০২০ ও ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দেশে তালাকের হার অনেক বেড়েছিল। ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশে তালাকের হার ছিল প্রতি ১০ হাজারে যথাক্রমে ৭ ও ৮টি। এই হার ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৫টিতে। ২০২৩ সালে দেশে ১৫ বছরের কম বয়সে বিয়ের হার ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ের সংখ্যা অনেকটা বেড়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের ঘটনা বেশি। দেশে গত বছর ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ের হার ছিল ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামীণ এলাকায় এই হার ৪৪ দশমিক ৪ আর শহর এলাকায় ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২২ সালের তুলনায় দেশে মেয়েদের ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে বেড়েছে।
তালাকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আগের চেয়ে নারীরা স্বাবলম্বী, স্বাধীন মনোভাব। নারীদের উচ্চ বেতনে চাকরি, আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা, নির্যাতন সহ্য না করা এবং প্রতিবাদ করার মনোভাবের কারণে তালাকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে স্বাভাবিক সমাজ ব্যবস্থায় বিরুপ প্রভাব দেখা দিতে পারে। কোন কোন সংসারে সন্তান থাকা অবস্থায়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাকের ঘটনা ঘটে। ওই সংসারের সন্তানটি শিশু অবস্থায়ই অভিভাবক শূন্য হয়ে পরে। এতে করে সে প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠবে। পরবর্তীতে অপরাধী হয়ে সমাজে বেড়ে উঠার আশঙ্কা থেকে যায়। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারায়ও পরিবর্তন ঘটছে অতিদ্রুত। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা। ঢাকায় বিবাহ বিচ্ছেদ করায় পুরুষের চেয়ে এগিয়ে রয়েছেন নারীরা।
২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তালাকের ঘটনা ১৭ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি ১০ হাজারে গ্রামে ১১টি এবং শহরে ৯টি তালাকের ঘটনা ঘটছে। তবে সার্বিকভাবে দেশে বিয়ের হার অনেকটা কমেছে। আর বিয়ের গড় বয়স কিছুটা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর ফলাফল প্রকাশ করে। সেখানে বৈবাহিক অবস্থা, বিয়ের বয়স, তালাক ও বিচ্ছেদের বিষয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কলাবাগান এলাকার এক নারী স্বামীর সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। স্বামী অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কসহ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি তালাকের আবেদন করেন। স্বামীর বিপক্ষে তিনি আবেদনটি করেন। দক্ষিণ বনশ্রী এলাকার আরেক নারী তালাকের আবেদন করেছেন। তিনিও স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়াসহ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। ধানমন্ডি এলাকার এক নারী তালাকের আবেদন করেছেন একই কারণ দেখিয়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন করা এক নারী জানান, তার স্বামীর অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক। এ বিষয়টি তিনি জানলে তাকে বাধা দেন। এতে প্রতিনিয়তই ঝগড়া লেগে থাকে। সংসারে অশান্তি। আর তিনিও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। নিজের ইনকামে চলেন এসব চিন্তা করে তার স্বামীকে তালাকের আবেদন করেছেন।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, গত কয়েক বছরে বাল্যবিবাহ ও মেয়েদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া অনেক বেড়েছে। বাবা-মায়েরা পূর্বাপর চিন্তা না করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য, যৌতুকসহ নানা কারণে তারা সংসার করতে পারেনি। বাল্যবিবাহ বন্ধে পারিবারিক সচেতনতার পাশাপাশি সরকারের প্রচার বাড়ানো জরুরি। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী, নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮। এ বয়সের আগে বিয়ের কারণে অপরিণত বয়সে অনেক মেয়ে মা হন। এতে তার যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়, তেমনি শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার সুযোগও কমে যায়। সরকার দেশে বাল্যবিবাহ রোধে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ কমছে না বরং বেড়েই চলেছে।
ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মাসুম আহম্মেদ ইনকিলাবকে জানান, ইদানিং রাজধানীতে নারীদের পক্ষ থেকে বেশি তালাক দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে অন্যতম কারণ হচ্ছে ‘ইগু’ সমস্যা। ইগু নিয়ে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের মধ্যে বনিবনা হচ্ছে না। গত দু’সপ্তাহে পারিবারিক সমস্যা নিয়ে ৪ জন ক্লায়েন্ট আমার চেম্বারে আসেন। তাদের মধ্যে ৩ জন নারী এসেছেন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তিনটাই ভালোবাসার বিয়ে। এরা উচ্চ শিক্ষিত।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ব্রাইটনের বিপক্ষেও বিপর্যস্ত ইউনাইটেড
‘ন্যায়বিচারকে হত্যা’ করা হয়েছে: পিটিআই
নতুন ভূগর্ভস্থ নৌ ঘাঁটি উন্মোচন ইরানের
রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করছে অনেক আফ্রিকান সেনা
পাওয়ার প্ল্যান্টের ৩৬০ মেট্রিকটন তেল ডাকাতি
বাংলাদেশি কর্মী নিতে প্রস্তুত রাশিয়া: রাষ্ট্রদূত
রাজনৈতিক দলগুলো বেশি কিছু সংস্কার না চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন: প্রেস সচিব
এবার ওলমোর ইনজুরি দুঃসংবাদ বার্সার
কুড়িগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে ইমন ও আলামিন
এসএমই ফাউন্ডেশনের নতুন চেয়ারপার্সন মো. মুশফিকুর রহমান
বিয়ের ওপর কর বাতিলের দাবি
শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে আ.লীগ : মির্জা ফখরুল
নামাজের প্রথম কাতারে জামাত পড়াবস্থায় অজু ভেঙ্গে যাওয়া প্রসঙ্গে।
কয়েক মিনিটে বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারে ভারত: শুভেন্দু অধিকারী
নরসিংদীতে নিখোঁজের ৫ দিন পর নদীতে পাওয়া গেল স্কুল ছাত্রের লাশ
বিএনপি : দেশবাদ যার রাজনীতির মূল কথা
পাহাড়ি উপজাতিরা আদিবাসী নয়
সংস্কার প্রতিবেদন : জাতির নতুন অধ্যায়ে অভিযাত্রা
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিনিয়োগে জোর দিতে হবে
ভারতে ৫ বছর সাজাভোগ করে দেশে ফিরলেন স্বামী-স্ত্রী