বাংলাদেশের অবাধ নির্বাচনের যুক্তরাষ্ট্রের বার্তায় অভিন্ন অবস্থানে ভারত

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

২১ আগস্ট ২০২৩, ০৮:০৫ পিএম | আপডেট: ২২ আগস্ট ২০২৩, ১২:০৩ এএম

 

শেখ হাসিনা এখনও ভারতের প্রিয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন কৌশলগত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নয়াদিল্লির এসব উদ্বেগের সমাধান না হলে ভারত এবারও শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাবে এমনটা নাও হতে পারে। যদিও আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের অনেকগুলো ইচ্ছা পূরণ করেছে। এরমধ্যে আছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে পণ্য চলাচলের অনুমতি দেয়া। তবে নয়াদিল্লির জন্য এখন সব থেকে বড় উদ্বেগ হলো- চীনের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠতা। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই একটি ফ্যাক্টরই ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক করেছে। এই খবর দিয়েছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার গ্রুপের আরেকটি পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ। তিনদিন আগে আনন্দবাজার ‘হাসিনাকে দুর্বল করলে ক্ষতি সবার, বার্তা আমেরিকাকে’ এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সুত্রবিহীন রিপোর্টটি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। এই প্রতিক্রিয়া মিইয়ে যাওয়ার আগেই দ্য টেলিগ্রাফ অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে খবর দিয়েছে। আনন্দবাজারের রিপোর্টের সঙ্গে আকাশ-পাতাল তফাৎ রয়েছে। ঢাকার বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই।

খবরে বলা হয়, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে আগামী মাসে দিল্লি সফরে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এই সফরের সময় ভারত তাকে দুটি স্পষ্ট বার্তা দিতে পারে। এগুলো হচ্ছে, বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে এবং তার দল আওয়ামী লীগকে সব চীনপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাদের বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের বেছে নিতে হবে।

দ্য টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, শেখ হাসিনার প্রতি এই জোড়া বার্তা প্রসঙ্গে ভারতের নিরাপত্তা এস্টাব্লিশমেন্টের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই ঘটনা বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের বিষয়ে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক ঐকমত্যের ইঙ্গিত দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের (ভারত ও মার্কিন) নিরাপত্তা বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে ধারাবাহিক আলোচনা হয়েছে।

এসব বৈঠক হয়েছে ভারত ও এই অঞ্চলের অন্য কয়েকটি দেশে। অতীতে (২০১৪ ও ২০১৮) বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বড় ধরনের মতপার্থক্য ছিল। তবে এবার দুই দেশ ঐক্যমতে পৌঁছেছে বলে মনে হচ্ছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জি-২০ সম্মেলনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দিল্লিতে থাকবেন তখন তাকে এই দু’টি বার্তা দেয়া হবে।

যদিও শেখ হাসিনা দাবি করে আসছেন যে, তার অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। তবে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ নয়াদিল্লি বাংলাদেশের এসব বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে কখনও কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৯৬ শতাংশের বেশি আসনে জয় পাওয়ার পর শেখ হাসিনাকে প্রথম অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অর্থাৎ, নির্বাচনের ফলাফল যতক্ষণ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষে থাকবে ততক্ষণ ভারত এর সুষ্ঠুতা নিয়ে চিন্তা করবে না। শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লি সর্বদা তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র হিসাবে বিবেচনা করে।

ঢাকার এক কৌশলগত সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বলেন, শেখ হাসিনা এখনও ভারতের প্রিয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন কৌশলগত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নয়াদিল্লির এসব উদ্বেগের সমাধান না হলে ভারত এবারও শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাবে এমনটা নাও হতে পারে। যদিও আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের অনেকগুলো ইচ্ছা পূরণ করেছে। এরমধ্যে আছে, ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের দমন এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে পণ্য চলাচলের অনুমতি দেয়া। তবে নয়াদিল্লির জন্য এখন সব থেকে বড় উদ্বেগ হলো- চীনের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠতা। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই একটি ফ্যাক্টরই ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক করেছে।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার আলোচনা নিয়ে সূত্রগুলো আরও যা জানিয়েছে তা নিচে উল্লেখ করা হলো: এক. উভয় দেশই বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোতে (সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে) চীনপন্থী এবং ইসলামপন্থীদের ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অবিলম্বে এই অবস্থা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে দেশ দুটি। দিল্লি সফরের সময়ে শেখ হাসিনার কাছে এ নিয়ে উদ্বেগ জানাতে সম্মত হয়েছে ভারত। দুই. উভয় পক্ষই দ্ব্যর্থহীনভাবে একমত হয়েছে যে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শেখ হাসিনার সফরে ভারত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তিনি. ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মত হয়েছে যে, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো প্রশ্নই উঠে না, কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে এ ধরনের কোনো বিধান নেই। যদিও বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের অন্যতম প্রধান দাবি এটি। চার. উভয় পক্ষে সম্পূর্ণ ঐক্যমত রয়েছে যে, শেখ হাসিনা সরকারকে দুর্নীতি এবং ব্যাংক খেলাপিদের দমন করার জন্য দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সমস্যাটি মোকাবেলা করতে হবে যা সাধারণ বাংলাদেশীদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। পাঁচ. ভারতীয় কর্মকর্তারা মার্কিন কর্মকর্তাদের বুঝিয়েছেন যে, বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার যে এজেন্ডা যুক্তরাষ্ট্র হাতে নিয়েছে তা দেশের ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোটকে নিয়ে আসবে। এতে এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে এবং ভারতের নিরাপত্তা হুমকি বৃদ্ধি পাবে। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে জামায়াত-ই-ইসলামিকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে তা নিয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা আপত্তি জানিয়েছেন। উলটো জামায়াতকে একটি কট্টর মৌলবাদী সংগঠন বলে তুলে ধরেছে ভারত। ছয়. নয়াদিল্লির প্রতিনিধিরা মার্কিন কর্মকর্তাদের বলেছেন যে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে জো বাইডেন প্রশাসন কর্তৃক ঘোষিত ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পূর্বে এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ করা উচিত।

অতীতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থানে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। তবে সূত্রগুলো বলছে, শুধুমাত্র সে কারণেই এবারের নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের ঐক্যমত গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঢাকা থেকে একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করবে। ফলে রাজনীতিতে অনাগ্রহী তরুণ প্রজন্ম দেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে উৎসাহিত হবে। আবার ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য দিয়ে নয় বরঞ্চ জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করলে তা আওয়ামী লীগকেও শক্তিশালী করবে। সর্বশেষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে শেখ হাসিনা এই পরামর্শগুলো মানবেন কি-না সেটাই এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার

সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার

উন্মুক্ত মঞ্চে তরুণদের উচ্ছ্বাস

উন্মুক্ত মঞ্চে তরুণদের উচ্ছ্বাস