তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি
০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২২ এএম | আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:২২ এএম

পানির অভাবে ধু ধু বালু চরে পরিণত হয়েছে সর্বগ্রাসী খরস্রোতা তিস্তা। এতে করে তিস্তা তীরবর্তী এলাকার জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়েছে। পানির অভাবে ইতোমধ্যে লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলায় মরু প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। থমকে গেছে মাঝি-মাল্লার কর্ম ব্যস্ততা। তিস্তার উজানে বাঁধ দিয়ে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় তিস্তার এমন দুরাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তায় পানি না থাকায় নদী কেন্দ্রীক কয়েক লাখ মৎস্যজীবী ও মাঝি কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন নদী বিশেষজ্ঞ ও তিস্তা পারের মানুষ।
একসময় তিস্তায় ভরা যৌবন ছিল। পানিতে ভরা ছিল নদী। সারা বছরই স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। শুধু তিস্তা নয়, উত্তরাঞ্চলের ছোট বড় অন্তত ১৬ থেকে ১৭টি নদী ছিল পানিতে ভরপুর। পানিতে টইটম্বুর ছিল এ অঞ্চলের খাল-বিল। এ অঞ্চলের হাজার হাজার জেলে এসব খাল ও বিলে মাছ আহরণ করে সেগুলো বিক্রি করে জীবন-যাপন করত। এখন নদীতে পানি নেই, খাল-বিলেও পানি নেই। অনেক নদীর অস্তিত্বও নেই। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে এসব নদী। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন অসংখ্য জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন। এদের কেউ পেশা বদলিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। কেউবা পূর্বের পেশাকেই আঁকড়ে ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। জানা গেছে, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সর্বগ্রাসী এই তিস্তা নদী। যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার।
প্রতিবেশী দেশ ভারত তিস্তার ১০০ কিলোমিটার উজানে গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ছে আমাদের দেশের উত্তর জনপদের ৬টি জেলায়। ভারত তার নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারপর বাংলাদেশকে পানি দিচ্ছে। বর্ষাকালে ভারত অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যা হয়। পক্ষান্তরে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী পানি মেলে না। এভাবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হলেও সুফল মেলেনি। তিস্তা নদীর এই করুণ দশার জন্য দীর্ঘ সময় ঝুলে থাকা পানি চুক্তিকে দায়ী করেছেন সাধারণ মানুষ। ভারতের পানি প্রত্যাহারের ফলে সমগ্র তিস্তা এবং তার শাখা-প্রশাখা খাল, বিলগুলো এবং জলাশয়গুলো শুকিয়ে মরুভ‚মিতে পরিণত হয়েছে।
তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি কপাট এখন বন্ধ। ব্যারেজের উজানে যতটুকু পানি মিলছে তার বেশিরভাগই সেচ কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে ব্যারেজের ভাটি এলাকায় এখন পানি নেই। ফলে ভাটি এলাকা এক প্রকার মরুভ‚মিতে পরিণত হয়েছে। গোটা নদীর বুকে শোভা পাচ্ছে ধু ধু বালুচর। এসব চরে তিস্তা লোকজন কিছু রবিশস্য চাষ করলেও সেগুলোতেও পানির অভাবে ভালো ফলন পাচ্ছে না।
তিস্তা তীরবর্তী লোকজন জানায়, আগে নদীতে সারা বছরই পানি থাকত, আমরা মাছ ধরতাম, ভালোভাবে খেতে-চলতে পারতাম। হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরে এ নদীতে। মানুষ পারাপার করে অনেক মাঝি জীবিকা নির্বাহ করত। এখন নদীতে পানি নেই, মাছও নেই।
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, কৃষি কাজের জন্য পানি সরাতে তিস্তা ব্যারেজ এর উজানে আরো দুটি খাল খননের উদ্দেশ্যে প্রায় ১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে কাজ শুরু করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলায় অধিক কৃষি জমি সেচের আওতায় আসবে। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার খাল খনন প্রকল্পের মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি আরো বেশি করে প্রত্যাহার করবে। এতে করে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানি কতটুকু থাকবে তা সহজেই অনুমেয়। কারণ শুস্ক মওসুমে উত্তরাঞ্চলে ৮ জেলায় এমনিতেই তিস্তা নদীতে পানি থাকে না। ভারতের এই প্রকল্পের কারণে তিস্তায় পানি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। তিস্তাসহ উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোয় মরু পক্রিয়া শুরু হবে। পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ সেচ বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী তিস্তা থেকে পানি নিতে কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন ও তিস্তার বাম তীরে ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পৃথক অন্য ১টি খাল খনন করা হচ্ছে। এ দুটি খাল খনন হলে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১ লাখ কৃষক সেচের সুবিধা পাবেন।
জানা গেছে, ভারতের গজলডোবায় তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পটি চালু করা হয় ১৯৭৫ সালে। এই প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে বাঁচতে বাংলাদেশ ১৯৮৯ সালে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধার দোয়ানিতে তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প চালু করে। কিন্তু ভারত কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে পশ্চিমবঙ্গের সরকার আবার খাল খননের উদ্যোগ নেয়। এমনিতেই ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে দোয়ানিতে তিস্তা বারেজের ভাটিতে একদম পানি নেই। নদীর ভাটি এলাকা একেবারেই শুকিয়ে গেছে। এমন কী তিস্তা সেচ প্রকল্পের পানির রিজার্ভেও তেমন পানি নেই। রিজার্ভ অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। এ অবস্থায় আরও দুইটি নতুন খাল খনন করে পানি প্রত্যাহার করলে ভাটি অঞ্চলে তিস্তা নদী মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যাবে। বিশেষ করে রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম জেলার অন্তত ১৪৫ কিলোমিটার এলাকা মরুভ‚মিতে পরিণত হয়ে যাবে। দেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের আশপাশের এলাকায় ধু ধু বালুচরে পরিণত হবে এবং এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র ধ্বংসের মুখে পড়বে।
ইতোমধ্যে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় তিস্তা নদীর উপর নির্মিত তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও গংগাচড়ার মহিপুর সেতু সবটাই এখন দাঁড়িয়ে আছে ধু ধু বালুচরের উপর। ব্রিজ থাকলেও নিচে হেঁটেই চলাচল করছে মানুষ জন। ব্র্রীজের নিচে চরে বেড়াচ্ছে গরু-মহিষ। ছেলেরা ক্রিকেট ও ফুটবল খেলছে ব্রীজের নিচের চরে। বিভিন্ন স্থানে তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরগুলোতে বাদাম, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া ও আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ হলেও সেচের অভাবে সেগুলো থেকে ভালো ফলন পাচ্ছেন না কৃষকরা। প্রথমদিকে চারা এবং গাছ অত্যন্ত ডগডগে হলেও মাঝদিকে এসে পানির অভাবে অনেক স্থানেই মরে যাচ্ছে গাছ। অধিক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করে সেচ দিয়ে চাষাবাদ করতে হচ্ছে কৃষকদের।
তিস্তা ব্যারেজের নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছেন, নদীতে মাত্র ৪ থেকে ৫ হাজার কিউসেক পানি রয়েছে। যা সিলড্রাপ ও ক্যানেলগুলো ভরে রাখা হয়েছে। পানি কম থাকায় ব্যারেজের সবগুলো গেট বন্ধ রাখা হয়েছে। এর চেয়েও যদি পানি কমে যায় তবে সেচ প্রকল্প সচল রাখা কষ্টকর হয়ে যাবে।
নদী বিশেষজ্ঞ, তিস্তা তীরবর্তী লোকজনসহ উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার লোকজনের দাবি, ভারতের নদী আগ্রাসন ও তিস্তার মরুকরণের হাত থেকে বাঁচতে হলে অবিলম্বে তিস্তা মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অন্যথায় খুব শিগগিরই উত্তরের এই ৫ জেলা মরুভ‚মিতে পরিণত হবে এবং এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র হারিয়ে যাবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

কুমিল্লার সাবেক এমপি শফিউদ্দিন শামীমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

ইসরাইল নৃশংসতার সর্বোচ্চ সীমাও অতিক্রম করেছে : কর্নেল অলি

আবেদ আলীর বাড়ি-ফ্ল্যাট-জমি জব্দ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

পুরান ঢাকায় আগুনে একজনের মৃত্যু

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কে ব্যবসায়ীরা চিন্তিত : আইসিসিবি সভাপতি

আরব আমিরাত ও তুরস্ক সফরে যাচ্ছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট

পহেলা বৈশাখ পান্তা-ইলিশ খাওয়া আমাদের সংস্কৃতি না -প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা

আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার বৈঠক

ঢাকায় মার্কিন নাগরিকদের চলাচলে সতর্কতা জারি

ইসরাইল নৃশংসতার সর্বোচ্চ সীমাও অতিক্রম করেছে : কর্নেল অলি

গণজাগরণ মঞ্চের নেপথ্যের নায়কদের সচিব করার প্রস্তাব

ওয়াকফ বিল ইস্যুতে সারজিস : মোদিকে ছুড়ে ফেলার বিকল্প নেই

উদ্যোক্তাদের জন্য ৮০০-৯০০ কোটি টাকার তহবিল আসছে

গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর গণহত্যা-মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ

গাজার পক্ষে ড. ইউনূসের বিবৃতি

শুল্ক ৩ মাস স্থগিত চেয়ে ট্রাম্পকে চিঠি দিলেন ড. ইউনূস

জনসমর্থন হারাচ্ছেন ট্রাম্প

নিরাশা নয়, আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা মুমিনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন-১

বিক্ষোভে উত্তাল সারাদেশ

টঙ্গীতে পোশাক শ্রমিককে ছুরিকাঘাতে হত্যা