আরবি নববর্ষ : তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

Daily Inqilab মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

১৯ জুলাই ২০২৩, ০৮:১৭ পিএম | আপডেট: ২০ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম

মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহ তাআলা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। ইরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয়ই নভোম-ল-ভুমন্ডল সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে মাস ১২টি, এর মধ্যে ৪টি নিষিদ্ধ মাস; এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান’। অন্যত্র মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এগুলোর মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন’। নতুন বছরের সঙ্গে আসে নতুন চাঁদ ও নতুন মাস। নতুন চাঁদে নতুন মাসে রাসুলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করতেন: ‘হে আল্লাহ! তুমি ঐ চাঁদকে আমাদের উপর উদিত কর নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সাথে। (হে চাঁদ) আমার ও তোমার প্রতিপালক আল্লাহ।’। আলোচ্য নিবন্ধে হিজরি বর্ষ সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।

নানান বর্ষ গণনার ইতিকথা: বহু প্রাচীনকাল থেকে সন গণনা প্রচলিত। আরবদের মধ্যে গোত্রগত বিভাজনের কারণে নানান ধরনের বর্ষ গণনা করা হতো। তবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সাল বা বর্ষ ছিল না। বিভিন্ন প্রকারের এসব সনের মধ্যে হযরত নুহ আলাইহিসসালামের বন্যা সন, ইয়েমেনের খ্রিষ্টান বাদশা আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য প্রেরিত হস্তিবাহিনীর নামে আমুল ফিল, আমুল ফুজ্জার, আমুল ফতেহ, হবুতি, লুই এবং খসরু সন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া আরবরা বণিক ছিল বিধায় আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রোমান সনকে অনুসরণ করতো। ব্যাবেলি সন চালু হয় স¤্রাট বুখতে নসরের জন্ম তারিখ থেকে। মিসর ত্যাগ করে বনি ইসরাঈল যেদিন মুক্ত হয়, সে দিন থেকে তাদের সন গণনা শুরু। হযরত ঈসা আলাইহিসসালামের জন্মদিন থেকে খ্রিষ্টাব্দ বা ইংরেজি সনের প্রচলন। গুপ্ত সা¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং উজ্জয়িনীর কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্য খ্রিষ্টপূর্ব ৫২ অব্দে ভারতবর্ষে বিক্রমাব্দ প্রচলন করেন। রোমীয়, ব্যাবেলীয়, ইংরেজি, ইরানি, হিন্দুস্তানি প্রত্যেকটি সনের সূচনাতে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে।

হিজরি বর্ষের প্রবর্তন: হিজরতের ১৭ বছর পর দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তখন অনেক নতুন ভূখ- ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র ইত্যাদিতে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকায় অসুবিধা হতো। আর তখন কুফার গভর্নর ছিলেন হযরত আবু মুসা আল আশয়ারি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।। তাই তিনি প্রশাসনিক কাজের অসুবিধার কথা জানিয়ে সন ও তারিখ নির্ধারণের আবেদন করেন । সে আবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে এবং প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। যেহেতু নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার হিজরতেই ইসলামের পূর্ণতা লাভ, কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র গঠন এবং মানব ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা করে, তাই সে সভাতেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার হিজরতের বছরকে সন গণনার বছর হিসেবে নির্ধারণের জন্য হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পরামর্শ দেন। ঐশীবাণীর আলোকে পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ হিজরি সালের শুরু করার ও যিলহজ্ব মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেন হযরত উসমান গণি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। আর তখন থেকেই ইসলামী বর্ষ বা হিজরি সন গণনার শুরু। আর বর্ষ গণনায় বিভ্রান্ত লক্ষ্য করে স্বয়ং রাব্বে করিম মানব জাতির সংশোধনের জন্য সূরা তাওবার উপর্যুক্ত আয়াত হিজরিতের দশম বর্ষে নাযিল করেন। আয়াতে হিজরি সনের ১ম মাস মহররম, সপ্তম মাস রজব, ১১তম মাস যিলক্বদ আর ১২তম মাস যিলহজ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

হিজরতের দিনক্ষণ: প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরতের ঘটনা মুসলমানদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হিজরত মানে ছেড়ে যাওয়া, পরিত্যাগ করা; দেশান্তর হওয়া ও দেশান্তরিত করা। পরিভাষায় হিজরত হলো ধর্মের জন্য এক স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে চলে যাওয়া। সর্বোপরি মহান আল্লাহ তাআলার আদেশ পেয়ে নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুকাররামা থেকে মদিনা শরীফের উদ্দেশে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ৮ রবিউল আওয়াল মদিনা মুনাওয়ারার পার্শ্ববর্তী কোবায় পৌঁছান তিনি। ২৭ সেপ্টেম্বর মোতাবেক ১২ রবিউল আওয়াল জুমার দিনে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ করেন। তিনি যখন মদিনা শরিফে প্রবেশ করেন, তখন তাঁকে বরণ করার জন্য তাঁর উটের দড়ি নিয়ে আনসারী সাহাবীদের মাঝে টানাটানি শুরু হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘উট ছেড়ে দাও। যেখানে সে বসবে, সেটাই হবে আমার বাসস্থান। তাকে এমনই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ উট বনু নাজ্জার গোত্রের এলাকায় গিয়ে দাঁড়াল। যা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার নানার বাড়ি। এই গোত্রের হযরত আবু আইয়ুব আনসারি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বাড়ির সামনে গিয়ে উট বসে পড়ল। এখানেই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার বাসস্থান নির্ধারণ করা হলো। এখানেই গড়ে উঠেছে মসজিদে নববি ও মদিনাতুর রাসুল বা রাসুলের শহর। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া; জাদুল মাআদ; তারিখুল ইসলাম)

বাংলাদেশে হিজরি সন (নববর্ষ) এর প্রচলন: ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক হিজরি সন প্রবর্তিত হওয়ার এক বছর পরই আরব বণিকদের আগমনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীতে ৫৯৮ হিজরি মোতাবেক ১২০৯ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলার জমিনে মুসলিম শাসনের ইতিহাস সূচিত হয়। ফলে হিজরি সন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভের মাধ্যমে জাতীয় সন গণনায় পরিণত হয়। সন গণনায় দীর্ঘ ৫৫০ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর থাকার পর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের মধ্যমে হিজরি সনের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অবসান ঘটে। জনসংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের সরকারও হিজরি নববর্ষ পালনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসব পালনের নামে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে পশ্রয়দান করছে। কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা জোট-মহাজোট কেউ ইসলামী নববর্ষ হিজরি সন পালনের উদ্যোগ নেয়নি। দেখা যায়নি হিজরি নববর্ষের শুভেচ্ছা পরস্পর বিনিময় করতেও। সংবাদপত্র বের করেনি বিশেষ সংখ্যা, আয়োজন নেই কোনো মিডিয়াতে বিশেষ অনুষ্ঠানের। এ অবস্থায় চট্টগ্রামে হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদের আয়োজনে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে যে অনুষ্ঠান হয়ে আসছে, তা নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ। বিশ্ব শান্তির দূত ও কল্যাণের প্রতীক রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার স্মৃতিবিজড়িত সন গণনার প্রতি সম্মান জানিয়ে ১ মহররম ছুটি ঘোষণা করে সরকারিভাবে হিজরি সন উদযাপনের ব্যবস্থা করা সময়ের দাবী।

লেখক : সহ দপ্তর সচিব, হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বড়দিনের ধর্মীয় ইতিহাস ও তাৎপর্য
ইসলামি অর্থনীতির স্বরূপইসলামি অর্থনীতির স্বরূপ
হাজারো পীর-আউলিয়ার শিরোভূষণ সৈয়দ সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসি (র.)
আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)
ঘুষ : দেয়া-নেয়া দুটিই অপরাধ
আরও
Airtel Wecome Banner

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে ৩শ’ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে ৩শ’ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু

রাজশাহী মহানগরীতে ঘন কুয়াশা

রাজশাহী মহানগরীতে ঘন কুয়াশা

আবারও  ভানুয়াতুতে  দ্বীপপুঞ্জে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প

আবারও ভানুয়াতুতে দ্বীপপুঞ্জে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প

হাজীগঞ্জে ভরাট মিঠানিয়া খালের মুখ, হুমকিতে ফসলি জমি

হাজীগঞ্জে ভরাট মিঠানিয়া খালের মুখ, হুমকিতে ফসলি জমি

রাহাতের সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত দর্শক, বাংলায় বললেন 'আমরা তোমাদের ভালোবাসি'

রাহাতের সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত দর্শক, বাংলায় বললেন 'আমরা তোমাদের ভালোবাসি'

‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’

‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’

যুক্তরাজ্যে ট্রাম্পের বিশেষ দূত হিসেবে মার্ক বার্নেট নিযুক্ত

যুক্তরাজ্যে ট্রাম্পের বিশেষ দূত হিসেবে মার্ক বার্নেট নিযুক্ত

ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার

ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার

ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস

ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস

ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০

ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?

বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত

বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত

হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি

হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি

কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫

কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫

ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি

ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি

উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন

উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন

বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের

বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের

নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত

নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত

সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প

সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প

আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ

আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ