খুলনা শিপইয়ার্ড
০৩ জুন ২০২৩, ০৮:১১ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম
খুলনা শিপইয়ার্ড এখন নৌনির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান। এখানে ছোট থেকে বড় মাপের যুদ্ধ জাহাজ, মাঝারী মাপের ড্রেজার, কন্টেইনার নৌযান, অয়েল ট্যাংকার এবং কার্গো ভ্যাসেল ছাড়াও যাত্রীবাহী নৌযান, সার্ভে ভ্যাসেল, সাবমেরিন টাগ, ল্যান্ডিং ক্রাফট, সার্চ এন্ড রেসকিউ ভ্যাসেল, ল্যান্ডিং ক্রাফট ট্যাংক, ফায়ার ফাইটার ভ্যাসেল ও পন্টুন পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে। এমনকি এ প্রতিষ্ঠানটিতে ইতোমধ্যে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জন্য অত্যাধুনিক গবেষণা জাহাজও তৈরি হয়েছে। নদীমাত্রিক বাংলাদেশের নৌপথে ভ্রমণে প্রমোদতরী নির্মাণও করতে যাচ্ছে খুলনা শিপইয়ার্ড। দেশের একমাত্র অত্যাধুনিক মেরিন রাবার ফ্যাক্টরি স্থাপনের মাধ্যমে নৌশিল্প খাতে রাবার ভিত্তিক সব ধরনের সরঞ্জাম তৈরি করছে খুলনা শিপইয়ার্ড। সেখানে কাঁচামাল হিসেবে দেশে উৎপাদিত রাবার ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে দেশে রাবার উৎপাদন বৃদ্ধিসহ এ শিল্প কিছুটা আলোর মুখ দেখতেও শুরু করেছে।
করোনা মহামারির তিন অর্থবছরে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়েছে খুলনা শিপইয়ার্ড। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে পদ্মার ভাঙন থেকে শরিয়তপুরের নড়িয়া এলাকা রক্ষায় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ করে এনেছে। পাশাপাশি কীর্তনখোলার ভাঙন থেকে বরিশাল বন্দর রক্ষার প্রকল্পও শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
তৎকালীন শিল্প মন্ত্রী খান আবদুস সবুর খানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জার্মানির ব্যবস্থাপনায় শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের মালিকানায় রূপসা নদীতীরে খুলনা শিপইয়ার্ডের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। পরবর্তীতে জার্মান ও যুক্তরাজ্যের যৌথ ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পরে কিছুদিন লাভজনকভাবে পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে অব্যাহত লোকসানে পড়ে। এরশাদ সরকার খুলনা শিপইয়ার্ডটি বন্ধ ঘোষণা করে বিরাষ্ট্রীয়করণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ লক্ষ্যে কয়েকবার দরপত্র আহবান করেও ক্রেতার অভাবে তা বিক্রী করা সম্ভব হয় না। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠানটিকে নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের এক দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শতাধিক কোটি টাকা লোকসান ও দায়দেনাসহ ঐ বছরের ৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে খুলনা শিপইয়ার্ড নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর পরে প্রতিষ্ঠানটিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সব অব্যবস্থাপনা ও লোকসানের অভিশাপ অতিক্রম করে অগ্রযাত্রা শুরু হয় নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন খুলনা শিপইয়ার্ডের। বিগত তিন অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার স্টিল সামগ্রী ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, আন্তর্জাতিক মানদ-ে যেকোন দেশের উন্নয়নে কত স্টিল সামগ্রী ব্যবহৃত হয় তা অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৩০ জন সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে ১ হাজার ৭শ বেসামরিক কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারী নিরলস পরিশ্রম করে শুধু বিশেষায়িত নৌযান নির্মাণ ও মেরামতেই নয়, অটোমোবাইল ট্রান্সপোর্ট মেরামত এবং নদ-নদীতে ড্রেজিং ও ভাঙন প্রতিরোধের কাজ করছেন। এছাড়াও ১০ টন পর্যন্ত গান মেটাল ও হোয়াইট মেটাল ঢালাই, যেকোন নৌযানের নকশা, স্টিল স্ট্রাকচারের ফেব্রিকেশন ও নকশা প্রণয়নসহ নৌযানের মেরামতও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করছেন।
ইয়ার্ডটি ইতোমধ্যে যুদ্ধ জাহাজসহ প্রায় ৮শ বিভিন্ন ধরনের নতুন নৌযান নির্মাণ ও আড়াই হাজার নৌযানের মেরামত সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন করেছে। খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত সবগুলো যুদ্ধ জাহাজই দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষাসহ চোরাচালান প্রতিরোধ এবং সমুদ্র বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষায় নজরদারী করছে। উপকূল রক্ষী বাহিনী কোস্ট গার্ডের জন্যও খুলনা শিপইয়ার্ড ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক বিশেষায়িত নৌযান নির্মাণ সম্পন্ন করেছে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলভাগে আইনশৃংখলা রক্ষার পাশাপাশি মৎস্য সম্পদসহ আমাদের ব্লু ইকনোমির পাহারাদারের সঠিক দায়িত্ব পালন করছে।
খুলনা শিপইয়ার্ডে প্রায় ৩শ’ ফুট দৈর্ঘ্যরে ৭শ’ টন উত্তোলনক্ষম ১০টি ট্র্যাকের স্লিপওয়ের সাথে জেটিতে একই সাথে ৮টি নৌযান বার্থিং বা নোঙরের ক্ষমতা রয়েছে। বছরে ৪ হাজার টন লৌহজাত সামগ্রী তৈরি করার ক্ষমতা সম্পন্ন এ ইয়ার্ডে বিভিন্ন ক্ষমতার একাধিক ওভারহেড ক্রেনসহ মোবাইল ক্রেন এবং ফর্ক লিফটারও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে অত্যাধুনিক সহায়ক যন্ত্রপাতিসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব ‘ফেব্রিকেশন সেড’ গড়ে তোলায় সময় বাঁচিয়ে দ্রুত যেকোন নৌযানের নির্মাণ কাজ শেষ করার দক্ষতা অর্জন করেছে।
খুলনা শিপইয়ার্ডকে ইতোমধ্যে প্লাটারসপ, ফেব্রিকেশন সেড, মেরিন ওয়ার্কসপ, ইলেকট্রিক্যাল ও রেডিও ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়ার্কসপ, ফাউন্ডেরি সপ, কার্পেন্ট্রি সপ ছাড়াও ডকিং সেকশনগুলো অত্যাধুনিক মেশিনারিতে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ৩৩ মিটার উচ্চতা, ১শ’ মিটার লম্বা দ্বৈত ট্রাক সমৃদ্ধ ফেব্রিকেশন সেডে ২০ টন ক্ষমতার দুটি ওভারহেড ক্রেন রয়েছে। খুলনা শিপইয়ার্ডের অত্যাধুনিক রাবার ফ্যাক্টরিতে রাবার আইটেম তৈরির জন্য নিজস্ব ডিজাইন হাউজ, মোল্ড ফেব্রিকেশনের জন্য অত্যাধুনিক সিএনসি মেশিন, প্রোডাকশনের জন্য রোলিং, নিডার এক্সট্রুডার মেশিন, ফেব্রিক্সযুক্ত রাবার শিট প্রস্তুতের জন্য ক্যালেন্ডার মেশিন, মেটালযুক্ত রাবার আইটেম প্রসেসিংয়ের জন্য ব্লাস্টিং মেশিন, ভালকানাইজিংয়ের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হাইড্রোলিক প্রেসসহ সব ধরনের যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া সেমি ফিনিশড রাবার প্রোডাক্ট ও ফিনিশড প্রোডাক্টসমূহের সর্বোচ্চ গুণগতমান নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন ধরনের টেস্ট ইক্যুইপমেন্টসহ পূর্ণাঙ্গ একটি ‘রাবার টেস্ট ল্যাব’ও স্থাপন করা হয়েছে। খুলনা শিপয়ার্ডের রাবার ফ্যাক্টরি ইতোমধ্যে বিশ^মানের একটি মেরিন রাবার উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে মোংলা বন্দরের জেটির জন্য সাফল্যজনকভাবে ‘রাবার ফেন্ডার’ উৎপাদন ও সংযোজন করা হয়েছে, যা দেশের কোন সমুদ্র বন্দরের জেটির জন্য তৈরি প্রথম রাবার ফেন্ডার।
খুলনা শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর এম শামসুল আজিজ জানান, সততা ও দেশপ্রেম থাকলে যেকোন প্রতিষ্ঠানই সাফল্যের অগ্রযাত্রায় যুক্ত হতে পারে। খুলনা শিপইয়ার্ড তার অন্যতম দৃষ্টান্ত। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কর্মী নিরলসভাবে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে বলেই সব ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে এখন প্রতিবছরই নতুন সাফল্য গাঁথা তৈরি হচ্ছে। কমোডর আজিজ বলেন, খুলনা শিপইয়ার্ড গতানুগতিক নৌযানই নয়, ইতোমধ্যে অনেক বিশেষায়িত নৌযান নির্মাণেও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। নিকট অতীতেও এসব নৌযান দেশের বাইরে থেকে আমদানির কোনো বিকল্প ছিল না।
লেখক: বিশেষ সংবাদদাতা ও ব্যুরো প্রধান, বরিশাল, দৈনিক ইনকিলাব।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
বিষয় : year
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান