সংবিধান সংশোধন ও সংস্কারের ইতিকথা
০৩ জুন ২০২৩, ০৮:২৪ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম
একটি রাষ্ট্র ও জাতির মৌলিক নীতিমালার সমন্বিত নাম সংবিধান। এর ভিত্তিমূলে নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতি, শাসিত হয় দেশ। প্রাচীন ইতিহাসে যখন রাজা, রাজ্য ও রাজধানীর প্রাধান্য ছিল, তখন সংবিধান বা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রক কিছু ছিল না। ফরাসী স¤্রাট লুই ১৪ বলতেন, আমিই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সব কথা ও কাজ হবে রাজা বা স¤্রাট নিসৃত। নাগরিক সাধারন যতই সচেতন হয়েছে, ততই অগ্রসর হয়েছে রাজা-রাজ্য নিয়ন্ত্রনের দাবি। ১৬৮৮ সালে বৃটেনে ঘটে সেই বিখ্যাত ‘গৌরবময় বিপ্লব’। তখন রাজা দ্বিতীয় জনকে অভিযুক্ত করা হয় ‘রাজ্যের সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে’। এভাবে একটি অলিখিত নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের মাধ্যমে গড়ে উঠে বৃটিশ সংবিধান। বিস্ময়ের ব্যাপার, হাজার বছর ধরে এভাবেই টিকে আছে বৃটিশ জাতির শাসন ব্যবস্থা। তবে দিনে দিনে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সমাজে সংবিধান আরও সুন্দর করে, আরও সুউল্লেখিতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরন মার্কিন সংবিধান। ১৭৮৭ সালে একটি সাংবিধানিক সম্মেলনের মাধ্যমে দীর্ঘ আলোচনা সমালোচনার পর এটি গৃহিত হয়। যথারীতি অঙ্গরাজ্যসমূহ কর্তৃক যথাসময়ে এটি অনুমোদিত হয়। সংবিধান সংশোধনীর জন্য কঠিন নিয়ম-কানুন বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে যখন তখন ইচ্ছে করলেই সংবিধান সংশোধন করা না যায়। সে তুলনায় বৃটিশ ধারার সংবিধানগুলো সংশোধন প্রক্রিয়া সহজতর- এরকম বৈশিষ্ট্য আমাদের দেশসহ সর্বত্র লক্ষনীয়। বৃটিশ সংসদীয় ঐতিহ্য নিয়ে যেসব উন্নত রাষ্ট্র কাজ করছে, তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারনে তেমন কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু আমাদের মতো উপনিবেশিক, যেখানে গণতন্ত্র বলতে গেলে এখনও অনুশীলনী পর্যায়ে, সেখানে নানা ধরনের বাঁধা-বিপত্তি ঘটছে। সংবিধানে শাসনের জন্য যে বিধি-বিধান সুনির্দিষ্ট করা আছে, শাসক দলের লোকেরা তার প্রতি নিয়মনিষ্ঠ নয়। তারা যখন তখন সংবিধান পরিবর্তন করছে তাদের প্রয়োজনে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এভি ডাইসি তিনটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এ তিনটি হলো: প্রথমত, পার্লামেন্ট বা সংসদের সার্বভৌমত্ব। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের সর্বোচ্চ মর্যাদা (ঝঁঢ়ৎবসধপু ড়ভ ঃযব ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ) তৃতীয়ত, সংসদীয় গণতন্ত্রের অলিখিত অনির্দিষ্ট নীতিমালার প্রতি অনুগত থাকা। প্রথম ও দ্বিতীয় ধারাটি মেনে চলা হলেও তৃতীয় ধারাটি নিয়ে আমাদের মতো দেশে বিস্তর গোলমাল। এই তৃতীয় ধারার ক্ষেত্রে যেখানে ডাইসি ‘নীতি-নৈতিকতার’ উপর নির্ভরতা দেখিয়েছেন, সেখানে এই ক্ষেত্রেই বেপরোয়া মনোভাব শাসক গোষ্ঠীর। সেটির উৎকৃষ্ট অথবা নিকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের ক্ষেত্রেই রয়েছে। সংবিধানের আরেক বিশেষজ্ঞ বেনথাম উনবিংশ শতাব্দীতে আরও কিছু সাংবিধানিক বিধিবদ্ধতা নির্দেশ করে গেছেন। কিন্তু বৃটিশ সংবিধানেও যে ব্যতিক্রম ঘটছে না তা নয়। বৈশি^ক প্রয়োজনে ১৯৯৭ এবং ২০০১ সালে এ ধরনের সংযোজন ঘটে। এ সময়ে বৃটিশ সংবিধানের বাইরে ইউরোপীয় মানবাধিকার সনদ গ্রহণ করতে বৃটেন বাধ্য হয়। যা হোক, বৃটেনের মতো আমাদের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ শক্ত নয় এবং বৈশি^ক বাধ্যবাধকতাও তীব্র নয়। সুতরাং সংবিধানের সংশোধনীগুলো হতে পেরেছে যেমন খুশি তেমন সাজো করে। এ সংবিধানগুলোর একটি পর্যালোচনা করলে বিষয়গুলো আমাদের সামনে পরিষ্কার হবে।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছে। এ সময়কালে বসা ১০টি সংসদের মধ্যে সপ্তম সংসদ বাদে প্রতিটি সংসদেই সংবিধান সংশোধন হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদকালের সপ্তম সংসদে সংবিধানে কোনও সংশোধন হয়নি। অপরদিকে প্রথম সংসদের মেয়াদকালে সব থেকে বেশি ৪ বার সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছে। ১৭টি সংশোধনীর মধ্যে সব থেকে বেশি ভোট পড়েছে ২০১৪ সালে আনা ষোড়শ সংশোধনীতে। ওই সময় ৩৫০টি ভোটের মধ্যে ৩২৭-০ ভোটে সংশোধন বিল পাস হয়। আর সংসদ নেতা হিসেবে শাহ আজিজুর রহমান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও খালেদা জিয়া পৃথক পাঁচটি সংশোধনী বিল পাসের জন্য সংসদে তোলেন। বাকি বিলগুলো সংশ্লিষ্ট সংসদের আইনমন্ত্রীরাই উত্থাপন করেন। একাদশ, দ্বাদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ সংশোধনীগুলো বিরোধী দলের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল পাস হয় ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই। সংবিধানের প্রথম সংশোধনীটি ছিল যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরে এই সংশোধনীর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা হয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। ২৫৪-০ ভোটে বিলটি পাস হয়। তিনজন ভোটার ওই সময় ভোটদানে বিরত থাকেন। পরে এটি ১৯৭৩ সালের ১৭ জুলাই রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী বিল পাস হয়। এতে সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদে (২৬, ৬৩, ৭২ ও ১৪২) সংশোধন আনা হয়। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বহিরাক্রমণে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার বিধান চালু করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বিলটি সংসদে উত্থাপন করলে ২৬৭-০ ভোটে তা পাস হয়। সংসদের তৎকালীন বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা বিল পাসের সময় সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন। বিলটি পাসের দুইদিনের মাথায় ২২ সেপ্টেম্বর এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণী একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন এবং চুক্তি অনুযায়ী ছিটমহল ও অপদখলীয় জমি বিনিময় বিধান প্রণয়ন করা হয়। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর উত্থাপিত বিলটি ২৬১-৭ ভোটে পাস হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন হয় ১৯৭৪ সালের ২৭ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়। সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালু এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন এই সংশোধনীর মূল কথা। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর সংশোধনীর বিষয়টি উত্থাপন করেন। বিলটি ২৯৪-০ ভোটে পাস হয়। বিলটি পাসের সময় সরকারি দলের সদস্য এমএজি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল ইসলাম সংসদ বর্জন করেন। বিলটি পাস হওয়ার দিন ২৫ জানুয়ারিই তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। পঞ্চম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডকে বৈধতা দানসহ সংবিধানে এর মাধ্যমে “বিসমিল্লাহির-রাহমানির রাহিম” সংযোজন করা হয়। সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান উত্থাপিত বিলটি ২৪১-০ ভোটে পাস হয়। পরে সংশোধনীটি উচ্চ আদালতের রায়ে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অবৈধ ঘোষিত হয়ে যায়। ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর উপরাষ্ট্রপতি আবদুর সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেই সময়ে বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদে তাদের প্রার্থী হিসেবে আবদুস সাত্তারকে মনোনয়ন দেয়। ষষ্ঠ সংশোধনীতে সেই পথটাই নিশ্চিত করা হয়। উপরাষ্ট্রপতি পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের বিধান নিশ্চিত করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান উত্থাপিত বিলটি ২৫২-০ ভোটে পাস হয়। এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ওই বছরের ১০ জুলাই। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসন বহাল ছিল। ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে এইচএম এরশাদের ওই সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া হয়। ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক আইন বলবৎ থাকাকালীন সময়ে প্রণীত সব ফরমান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, নির্দেশ ও অধ্যাদেশসহ অন্যান্য আইন অনুমোদন দেওয়া হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। আইনমন্ত্রী বিচারপতি কে এম নুরুল ইসলাম উত্থাপিত সংবিধান সংশোধনী বিলটি ২২৩-০ ভোটে পাস হয়। ১০ নভেম্বরই এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। ৫ম সংশোধনীর মত ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট এ সংশোধনীকে আদালত অবৈধ ঘোষণা করে। ১৯৮৮ সালের ৭ জুন সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী আনা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদে (২, ৩, ৫, ৩০ ও ১০০) পরিবর্তন আনা হয়। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতিদান করা ও ঢাকার বাইরে ৬টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করার বিধান চালু করা হয়। উধপপধ-এর নাম উযধশধ এবং ইধহমধষর-এর নাম ইধহমষধফবংযর-তে পরিবর্তন করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। সংসদ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ উত্থাপিত এ বিলটি ২৫৪-০ ভোটে পাস হয়। এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় দুইদিন পর অর্থাৎ ৯ জুন। তবে পরবর্তীতে ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠনের বিষয়টি বাতিল করে দেন সর্বোচ্চ আদালত। নবম সংশোধনী আনা হয় ১৯৮৯ সালের ১০ জুলাই। এ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতিকে নিয়ে কিছু বিধান সংযোজন করা হয়। এ সংশোধনীর আগে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি যতবার ইচ্ছা রাষ্ট্রপতি পদের জন্য নির্বাচন করতে পারতেন। এ সংশোধনীর পর অবস্থার পরিবর্তন হয়। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের সঙ্গে একই সময়ে উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, রাষ্ট্রপতি পদে কোনও ব্যক্তির পর পর দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন সীমাবদ্ধ রাখা হয়। উত্থাপনকারী সংসদ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিলটি ২৭২-০ ভোটে পাস হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ১১ জুলাই। দ্বাদশ সংশোধনীর পর এ সংশোধনীর কার্যকারিতা আর নেই। দশম সংশোধনী: এই বিলটি পাস হয় ১৯৯০ সালের ১২ জুন। রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে ১৮০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে সংবিধানের ১২৩(২) অনুচ্ছেদের বাংলা ভাষ্য সংশোধন ও সংসদে মহিলাদের ৩০টি আসন আরও ১০ বছর কালের জন্য সংরক্ষণ করার বিধান করা হয়। আইনমন্ত্রী হাবিবুল ইসলাম ভূঁইয়া উত্থাপিত বিলটি ২২৬-০ ভোটে পাস হয়। এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন হয় ১৯৯০ সালের ২৩ জুন। গণঅভ্যুত্থানে এইচ এম এরশাদের পতনের পর বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিনের দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে ১৯৯০ সালে ৬ আগস্ট একাদশ সংশোধনী পাস হয়। এর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগদান বৈধ ঘোষণা করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাবার বিধান পাস করানো হয় এই সংশোধনীতে। আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ উত্থাপিত বিলটি ২৭৮-০ ভোটে পাস হয়। এ বিলটি সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাস হয়। এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ১০ আগস্ট।১৯৯১ সালের ৬ আগস্টের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৭ বছর পর দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলুপ্ত করা হয়।
সংশোধনীটি উত্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ৩০৭-০ ভোটে বিলটি পাস হয়। একাদশের মত এ বিলটিও সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে পাস হয়। এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর। ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ-নিদর্লীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী জমির উদ্দিন সরকার এই সংশোধনীটি উত্থাপন করেন। এটি ২৬৮-০ ভোটি পাস হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ২৮ মার্চ। উচ্চ আদালতের আদেশে ২০১১ সালে এই সংশোধনীটি বাতিল হয়। ২০০৪ সালের ১৬ মে চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৪৫টি করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি এবং সরকারি ও আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিকৃতি বা ছবি প্রদর্শনের বিধান করা হয়। আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ উত্থাপিত বিলটি ২২৬-১ ভোটে এটি পাস হয়। এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় ১৭ মে। সংবিধান আইন ২০১১ (পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় ২০১১ সালের ৩০ জুন এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন হয় ২০১১ সালের ৩রা জুলাই। এই সংশোধনী দ্বারা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই সংশোধনীর দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বিদ্যমান ৪৫-এর স্থলে ৫০ করা হয়। সংবিধানে ৭ অনুচ্ছেদের পরে ৭ (ক) ও ৭ (খ) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে সংবিধান বহির্ভূত পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পথ রুদ্ধ করা হয়। এই সংশোধনীর বিষয়টি উত্থাপন করেন সেই সময়ের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। বিরোধী দল বিএনপির বর্জনের মধ্যে ২৯১-১ ভোটে বিলটি পাস হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরে ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। ’৭২ এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকে ফিরিয়ে দেওয়ার বিধান পাস করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। এটি উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ৩২৭-০ জনের ভোটে সর্বসম্মতভাবে পাস হয় বিলটি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বিলটির পক্ষে ভোট দেয়। পরে হাইকোর্ট বিভাগ একে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। আপিল বিভাগও ওই রায় বহাল রাখে। তবে, বর্তমানে এই রায়টি রিভিউতে রয়েছে। ৮ জুলাই ২০১৮ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখার প্রস্তাব সম্বলিত সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে। সংসদের ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৯৮-০ ভোটে বিলটি পাস হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ২৯ জুলাই ২০১৮ এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। সংবিধান ও সংবিধানের কার্যকারিতা, সংশোধনীগুলোর বাস্তবতা বোঝার জন্য এই দীর্ঘ সংযোজনের প্রয়োজন ছিল।
‘শাসনতন্ত্র আসমানী কিতাব নহে’ বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট আইউব খান। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের শেষ প্রান্তে জনতার দাবিকে স্বীকার করে তিনি শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান সংশোধন করতে সম্মত হন। কারন তিনি যে সংবিধান দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ প্রকাশিত হয়। ঐ সংবিধান জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়। তবে তিনিও উন্নয়ন দিয়েছিলেন। পালন করেছিলেন উন্নয়নের এক দশক। তার উন্নয়নের গণতন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ অর্থাৎ আদি আসল নির্ভেজাল গণতন্ত্র। যখনই খাঁিট দুধ বলা হবে, তখনই বুঝতে হবে দুধে ভেজাল আছে। আইউব খান সাধারন মানুষের গণতন্ত্র কেড়ে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন আসাধারন তন্ত্র। কতিপয় মানুষের ভোট ছিল। সাধারন মানুষের ভোটাধিকার ছিল না। এখন যেটা গায়ের জোরে চলছে তখন তার সাংবিধানিক বৈধতা ছিল। যখন তিনি সংবিধান সংস্কার করে জনগণের ভোট ফিরিয়ে দিতে চাইলেন ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ এ পৌঁছে গেছে রাজনীতি। আর যদি অতি বুদ্ধিমান আইউব খান জনগণের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করতেন আরও কিছুকাল হয়তো তিনি ক্ষমতায় থাকতেন। আর পাকিস্তানের ভাঙ্গনও অত ত্বরান্বিত হতো না।
বিজ্ঞজনরা বলেন, জনগণ যখন এগিয়ে চলেছে তার সাথে তাল মিলিয়ে সংবিধান যদি চলতে না পারে ‘বিপ্লব হয়ে পড়ে অনিবার্য’। সময় উপযোগী সংস্কার বিপ্লবকে আতœস্থ করে। বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে বা সংশোধন হয়েছে ১৭ বার। কিন্তু জনগণের আশা আকাক্সক্ষার সাথে সংগতি রেখে তা হয়েছে খুব কমই। বরং শাসক শ্রেণীর স্বার্থে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার মানসেই তা করা হয়েছে। এতদ্বেশীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারনে সংতগভাবেই সংবিধান ‘দুষ্পরিবর্তনীয়’ করা হয়েছে। সংবিধানের দশম ভাগের অনুচ্ছেদ ১৪২ (আ) বলা হয়েছে, ‘সংসদের মোট সদস্য সংখ্যা অন্যুন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহিত না হইলে অনুরূপ কোন বিলে সম্মতি দানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না।’ সংবিধান প্রণেতারা ‘দুই-তৃতীয়াংশ’কে কঠিন মনে করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের মনস্তত্ব হচ্ছে যে রাজনৈতিক দল জোটকে তারা ভোট দেয় উজাড় করেই দেয়। তাই সব সময়ই সংশোধনী আনতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেগ পেতে হয়নি। অবশ্য এই সময়ে শাসকদলের জয় পেতে জনগণের ভোটের দরকার হয়নি। ‘আমার ভোট আমি দেবো যাকে খুশি তাকে দেবো’এর বিপরীত ‘আমার ভোট আমি দেবো, তোমার ভোটও আমিই দেবো, যত খুশি দলকে দেবো’। এ নীতির বাস্তব প্রয়োগের কারনে সংবিধানের যখন তখন পরিবর্তনে শাসকদলের অসুবিধা হয়নি।
ভোট থেকে শুরু করে শাসনব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে শুধু কর্তৃত্ববাদী নয় বরং সর্বাত্ববাদী প্রবণতার কারনে ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। শাসকদলের বিগত দেড় দশকের বিভিন্ন পর্যায়ে এ অনুভবের প্রকাশ দেখা গেছে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজের ব্যানারে একটি উদ্যোগ নেয়া হয়। বলা হয়, ‘ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে সংবিধান সংশোধন জরুরী’। (প্রথম আলো, ৬ জানুয়ারি ২০১৫) এরা একটি সংবিধান সংশোধন কমিশন গঠন প্রস্তাব করে। এর আগে ২০১৩ সালে গনতান্ত্রিক আইন ও সংবিধান আন্দোলন নামের ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামক গ্রুপটির বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান প্রচলিত সংবিধানের খোলনইলচা পাল্টে দেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। (প্রথম আলো, ২১ ডিসেম্বর ২০১৬) দেশের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ সংবিধান সংশোধনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেন। (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১১) তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের তিনটি শাখার মধ্যে সাম্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে ভাবতে হবে’। প্রফেসর এমাজ উদ্দিন ৭টি কার্যব্যবস্থার সুপারিশ করেন। এগুলো হচ্ছে: ১. একই সাথে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালনে বিরত থাকা; ২. রাষ্ট্রপতির নামে যেসব কর্মকর্তার নিয়োগ ও পদচ্যুতি ঘটে সেসব পদগুলোর পুরো দায় দায়িত্ব রাষ্ট্রপতিকে দেয়া। এসব পদগুলো হচ্ছে- নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ, কম্পোট্রলার ও অডিটর জেনারেল, বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান-সদস্যবৃন্দ ও উপাচার্যবৃন্দ। এতে কিছুটা হলেও ক্ষমতার ভারসাম্য অনুভূত হতে পারে। প্রফেসর এমাজউদ্দিনের এই প্রস্তাবের সাথে আমি আরেকটু যোগ করতে চাই। যেহেতু রাষ্ট্রপতি বিশ^বিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে কাজ করেন তাই পুরো উচ্চশিক্ষা বিভাগকে তার অধীনে ন্যস্ত করা। ৩. সংবিধানের ৭০ ধারাকে নমনীয় করা। ‘অনাস্থা প্রস্তাব ব্যতীত’ অন্য যেকোন ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা। ৪. রাষ্ট্রপতির প্রথাগত ভাষণ রাষ্ট্রপতিই লিখবেন, ক্ষমতাসীন দল নয়। ৫. ‘জনগণই ক্ষমতার উৎস’ এর প্রয়োগিক যথার্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রেফারেন্ডাম বা গণভোট গ্রহণ। ৬. সংবিধানের ৪৮(৫) অনুচ্ছেদকে পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি যেন জাতীয় সংকটকালে প্রধানমন্ত্রী তথা সরকারকে পরামর্শ দান করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা। প্রফেসর এমাজউদ্দীনের ঐ প্রস্তাব কার্যকর হলে ৪৮(৩) ধারার এই অংশ রহিত করতে হবে যেখানে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শ দান করিয়াছেন কিনা এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছে কোন আদালতে সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করতে পারিবেন না।” এছাড়া রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায়িত করতে ৪৮(৫) ধারার শেষ অংশ সংশোধন করতে হবে। এখানে বলা হয়েছে, “এবং রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করিলে যে কোন বিষয়ে মন্ত্রীসভার বিবেচনার জন্য পেশ করিবেন।’ বিষয়টি ঐচ্ছিকের পরিবর্তে আবশ্যিক করলে এই সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেই রাষ্ট্রপতিকে আরো ক্ষমতায়িত করা যায়। ৭. সপ্তম প্রস্তাবে প্রফেসর এমাজউদ্দিন মূলত ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ এর উন্নয়নের কথা বলেছেন। বিষয়টি সংবিধানে কিভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায় তা পর্যালোচনার বিষয়। কারন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কার্যাবলী- ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ নির্মান করে। আর তা প্রয়োগিকভাবে নির্নয় করা সহজ নয়।
সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন, পরিমার্জন সাধারন বিষয় নয়। এজন্য দরকার গভীর চিন্তা-ভাবনা ও অভিজ্ঞ মতামত। নাগরিক সমাজের তরফ থেকে সংবিধান সংশোধনে যে সংস্কার কমিশনের কথা বলা হয়েছে তা একটি যৌক্তিক প্রস্তাব। বর্তমান সংকট নিরসনে সিভিল সোসাইটির তরফ থেকে অনুরূপ কমিটি গঠন এবং প্রস্তাবনা উপস্থাপন প্রয়োজন। জনমত গঠন, জনমত যাচাই এবং সচেতন নাগরিক সাধারনের অংশগ্রহনের মাধ্যমে এটি একটি আন্দোলনে পরিণত হতে পারে। সংস্কার প্রয়োজনীয়তার সকলেই স্বীকার করেন। শরৎচন্দ্রের সেই গল্পের মতো। সান্ধ্যকালীন বাঘের ছায়া দেখে; সবাই বলছেন- রামদা লাও, শরকী লাও, বন্দুক লাও- লাও তো বটে! কিন্তু লইবে কে? সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবনার উদ্যোগ কারা নিবেন? সংগতভাবেই সরকার। কিন্তু যাদের দ্বারা ভূত ছাড়াবো তাদের পেয়েছে ভূতে। সরকারি দল বিগত দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীন। এর আগের সেনাসমর্থিত তথাকথিত তত্তাবধায়ক সরকারকেও অনেকে প্রকারান্তরে ‘আওয়ামী শাসনকাল’ বলতে চান। সে সময়ের উদ্দিন সরকার (ইয়াজউদ্দিন, ফখরুদ্দিন ও মঈনউদ্দিন) সংস্কারের অনেক প্রস্তাবনা গ্রহণ করলেও- বৈধতা ও ক্ষমতা লিপ্সা আধো পথে ক্ষান্ত করে দেয়। এখন আওয়ামী সরকার ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য শাসন সংস্কার করবে- এ চিন্তা বাতুলতা মাত্র। বরং তারা পারলে আবার বাকশাল কায়েম করে দেয়। নির্বাচন ও জনপ্রতিনিধি আদেশ সংশোধনী-২০০৮ গৃহিত হয় উদ্দিন শাসনামলে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এর বিষয় বৈশিষ্ট্য পাল্টে দেয়। এই সেদিন সংসদে প্রস্তাবনা উত্থাপিত হয়েছে যে, নির্বাচন কমিশন নিবার্চন কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু গোটা নির্বাচনী এলাকা ভোট বন্ধ করতে পারবে না। গাজীপুরে ও গাইবান্ধায় নির্বাচন কমিশন যে সাহস দেখিয়েছে, সেই সাহসের রজ্জু টেনে ধরাই এই প্রস্তাবিত আইনের লক্ষ্য। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনকে যাতে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেজন্য এসব সংশোধনী সরকারের তরফ থেকে আনা হয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বিশ^াস করে। সিভিল সোসাইটি সংবিধান সংশোধনের পক্ষে নাগরিক সমর্থন প্রদান করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতার আরোহনের একমাত্র বাঁধা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলেও অন্য কোন সংস্কার প্রস্তাবে অগ্রসর হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধান সুষ্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও লিখিত উৎকৃষ্ট সংবিধানগুলোর একটি। কিন্তু প্রয়োগিক কার্যকারিতা শুন্য। গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নেই। এরকম অবস্থা কেন? এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: তাত্ত্বিক ও বাস্তবিক- উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। অনেকে নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ বৈশিষ্ট্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আস্থা-বিশ^াসের অভাব ও রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতাকে দায়ি করেন। দেশের প্রধান দু’টো রাজনৈতিক দলই ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ পেয়েও ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। বিএনপি ১৯৯৬ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে। একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে সংযোজন করে। অপরদিকে নিজেদের আন্দোলনের ফলপ্রসু ঐ সংযোজনকে রায়ের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগ তা বাতিল করে। আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র ক্ষমতার সোপানকে নির্বিঘœ করার জন্য এই একক ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশের বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে এরকম বিপর্যয়কারী পদক্ষেপ ও সুদূর প্রসারী পরিবর্তন আর কোন ক্ষেত্রেই ঘটেনি।
বিগত ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আলোচিত-সমালোচিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবনা ছিল এরূপ: ১. বিসমিল্লাহ সংযোজন বিতর্ক; ২. রাষ্ট্রধর্ম; ৩. নাগরিকত্ব; ৪. সংশোধন অযোগ্য বিষয়াবলী; ৫. রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিসমূহ; ৬. উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ইত্যাদি বিষয়; ৭. গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ; ৮. দায়মুক্তি বিধানে ক্ষমতা; ৯. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা; ১০. স্থানীয় শাসন; ১১. সংবিধানের ৭০ ধারা- ‘রাজনৈতিক দল হইতে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোট দানের বিষয়’; ১২. সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ ও বাণী; ১৩. বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন; ১৪. সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগ; ১৫. নির্বাচন ব্যবস্থাপনা- এ বিষয়গুলো কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বা সংস্কার প্রয়াসের অন্তর্ভুক্ত নয়। যে বিষয়গুলো রাজনৈতিক মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও বিতর্কিত হয়েছে- সেগুলোই এখানে উল্লেখ করা হলো। এক্ষেত্রে এ পরিসরে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ সীমিত। তবে দু’একটি বহুল আলোচিত সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে যে মতামত প্রকাশিত হয়েছে তা উল্লেখ করা যায়। উদাহরন স্বরূপ: রাষ্ট্রপতি সর্বসাধারন কর্তৃক নির্বাচিত হবেন বলে যে প্রস্তাব করা হয়েছে মরহুম প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমেদ তার বিরোধীতা করেছেন। তিনি বলেছেন, এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ন ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৫ সালে উত্থাপিত ক্ষমতার ভারসাম্য প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ালে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হবে’। তখন একথাও বলা হয় যে, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে তা রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের সহায়ক হতে পারে। ঐ সময়ে বিবিসি সংলাপে অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম মন্তব্য করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে গণতন্ত্র না থাকলে শুধু সংবিধান সংশোধন করে লাভ হবে না। সংবিধানের আর একটি আলেচিত ধারা ৭০। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতারা সম্ভবত অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এটি সংযোজন করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পরে প্রাদেশিক পরিষদ রীতিমতো ‘হর্স ট্রেডিং সেন্টার’ এ পরিণত হয়। সকাল-বিকাল মন্ত্রীসভার উত্থান-পতন হতে থাকে। ১৯৪৭-৫৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের গণপরিষদ এবং জাতীয় পরিষদেও ঐ একই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। ১৯৩৭-১৯৪৭ পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার শাসন পরিষদে একই দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। অভিজ্ঞতার আলোকে অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ৭০ ধারার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তবে প্রফেসর এমাজউদ্দিন শুধুমাত্র সরকার পতনের প্রেক্ষিতে ৭০ ধারার কার্যকারিতার কথা বলেছিলেন।
একথা অনস্বীকার্য যে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে কমপক্ষে রাষ্ট্রপতির পদকে অর্থপূর্ণ ও মর্যাদামন্ডিত করা প্রয়োজন। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ পাকিস্তানে এবং এই সময়ে নেপালে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য ইতিপূর্বে আলোচিত প্রস্তাবাবলী বিবেচনায় নেয়া যায়। ক্ষমতার স্বাতন্ত্রীকরণের সাথে সাথে আইন-বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে বিভাজন রেখা নিশ্চিত হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বহুল কথিত ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ বা ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত হতে পারে। সংবিধানের যে কোন সংশোধনী হতে হবে জনগণের স্বার্থে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের স্বার্থে। কাউকে ক্ষমতায় আরোহণ বা অবরোহনের জন্য সংবিধান সংশোধন কাম্য নয়। জনগণের কল্যাণ ও ন্যায়বিচার এর স্বার্থেই সংবিধান সংশোধনী বা সংস্কার ঈস্পিত। ইতিপূর্বে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান গ্রুপ’ এর পর্যালোচনায় দেখা গেছে, উপনিবেশিক কাঠামোর উপর নির্মিত এই সংবিধান। ধনিক-বণিক শ্রেণীর স্বার্থ ও সুবিধায় এর ব্যবহার। মৌলিক পরিবর্তন ব্যতীত নেই কোন গত্যন্তর। জনগণের আশা সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হোক সব সংস্কার।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই রাষ্ট্র সংস্কার তথা সংবিধান সংস্কারের দাবি ও আন্দোলন জোরদার হয়ে আসছে। বাস্তব কারনেই আওয়ামী লীগের পক্ষে সেই সংস্কারের সময় ও সুযোগ নেই। সবাই তাকিয়ে আছে ভবিষ্যতের পানে। ২০২৪ সাল পরবর্তী যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে, সেই সংসদের কাছে গণমানুষের প্রত্যাশা অনেক। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রসংস্কার আন্দোলন এতোটাই জোরদার হয়েছে যে, প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল এর সমর্থনে প্রস্তাবনা পেশ করছে। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন সুনির্দিষ্ট ৭ টি ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তাবনা পেশ করেছে। এগুলো হলো: সংবিধান, সংসদ, স্থানীয় সরকার, নির্বাচন, আইন বিচার ও প্রশাসন, মৌলিক অধিকার এবং অর্থনীতি। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষনা করেছে। তাদের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- ‘একটি সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করে বর্তমান অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক গৃহীত সকল অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী ও পরিবর্তনসমূহ রহিত/সংশোধন করা হলো।’ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন করা হবে। পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিশেষত জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে ‘উচ্চ কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন করা হবে। শাসনব্যবস্থার অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংস্কার সাধনে বিস্তারিত কর্মসূচী বিএনপি ঘোষণা করে। তার মানে হচ্ছে এই যে, সংবিধান সংস্কার বা রাষ্ট্র মেরামতের বিষয়টি এখন আর দলীয় বিষয় নয়। এখন এটি জাতীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সিভিল সোসাইটি বিষয়টিতে তুলনামূলকভাবে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। বর্তমান সময় ও জনমতের দাবি এই যে, সকল রাজনৈতিক দল ও বিদ্বৎ সমাজ সংবিধান সংস্কারের উদ্দেশ্যে একটি সমন্বিত কর্মধারা গ্রহণ করবে এবং জাতির আশা আকাঙ্খা বাস্তবায়নে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
লেখক: সাবেক প্রো-ভিসি, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
বিষয় : year
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান