চট্টগ্রামের মেজবান
০৩ জুন ২০২৩, ০৮:৪৮ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম
মেজবান চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। চট্টগ্রামের মানুষ অতিথিপরায়ণ। নানা উপলক্ষে অতিথি আপ্যায়নে মেজবানির আয়োজন এখানকার সংস্কৃতির অংশ। দেশব্যাপী এ মেজবানের খ্যাতি রয়েছে। মেজবান এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বেশ জনপ্রিয়। চট্টগ্রামের বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেজবানির আয়োজন হয়। ঐতিহ্যের স্মারক এ মেজবান আয়োজনে জৌলুস বেড়েছে। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তবে মেজবানির গোশতের সেই স্বাদ আগের মতই রয়ে গেছে। হোটেল-রেস্তোরাঁয়ও এখন মেজবানির গোশত মিলছে। রসনাবিলাসীরা মেজবানের গোশতের স্বাদ নিতে ছুটে যান এসব রেস্তোরাঁয়।
ঐতিহ্যবাহী মেজবান আদিকাল থেকেই প্রচলিত। ১৫শ’ শতকের কবি বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণ কাব্যগ্রন্থে এ মেজবানির তথ্য মেলে। ১৬শ’ শতাব্দীর সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ কাব্যগ্রন্থে ‘মেজোয়ানি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ভোজনার্থে। প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যে মেজোয়ানি ও মেজবান শব্দ দুটি পাওয়া যায়। মেজবান ফার্সি শব্দ। মেজবান শব্দটির অর্থ অতিথিআপ্যায়নকারী। আর মেজবানি শব্দের অর্থ আতিথেয়তা বা মেহেমানদারী। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মেজবানকে বলা হয় ‘মেজ্জানি’। চট্টগ্রামের বাইরে অন্য জেলায় একে বলা হয় ‘জেয়াফত’। মেজবান সাধারণত কারো মৃত্যুবার্ষিকী, কুলখানি, চল্লিশা, ওরশ, মিলাদ মাহফিল, আকিকা, গায়ে হলুদ, বিয়ে, নতুন বাড়িতে উঠা, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু তথা কোন কাজের শুভ সূচনার সময় আয়োজন করা হয়।
এখন রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও মেজবানির আয়োজন হয়ে আসছে। মেজবানে যেসব খাবার পরিবেশন করা হয় সেগুলো অসাধারণ সুস্বাদু হয়। আর এ কারণেই মেজবানের খাবারের প্রতি সবার আলাদা আকর্ষণ থাকে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার আকর্ষণ থাকে এ খাবারের প্রতি। কোথাও কোনো মেজবান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে বেশ আগ্রহের সাথে সেখানে শরিক হন সবাই। মজাদার সুস্বাদু গরুর গোশত ও গোশত দিয়ে রান্না উপাদেয় খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন অতিথিরা। মূলত গরু জবাই করে মেজবানির আয়োজন করা হয়। তবে কখনো আবার গরুর সাথে মহিষ, গয়াল এবং খাসিও জবাই করা হয়। মেজবানে গরুর গোশত দিয়ে নানা পদের খাবার তৈরি হয়ে থাকে। রান্না করা গরুর গোশত, চনার ডাল, গরুর নলা, মাষকলাই ডাল, গরুর গোশতের কালো ভুনা পরিবেশন করা হয় মেজবানিতে। মোটা চালের গরম ভাতের সাথে ধোঁয়া ওঠা গরম গরম গোশত পরিবেশন করা হয় এ আয়োজনে।
বলা হয়ে থাকে, একসময় এ অঞ্চলের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের জন্য মেজবানির আয়োজন করতেন। দরিদ্র মানুষেরা যাতে একবেলা গোশত খাওয়ার সুযোগ পান সেটাই ছিল মেজবানির মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়া অভিজাত পরিবারগুলোতে নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানে মেজবানির আয়োজন হয়ে আসছে। মেজবানির আয়োজন এলাহি কা-। একসময় মেজবানির দাওয়াত দেয়া হতো গ্রামে ঢোল পিটিয়ে বাঁশি বাজিয়ে। সপ্তাহ ধরে চলত দাওয়াত দেয়া। সেইসাথে মেজবানির আয়োজন। অসংখ্য গরু জবাই করা হতো। বাড়ির আঙিনা কিংবা খোলা মাঠে সামিয়ানা টাঙিয়ে বড় ডেকসিতে রান্না হতো। বহু গরুর গোশতের সাথে পরিবেশন করা হতো হাড় দিয়ে রান্না করা চনার ডাল এবং গরুর নলা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলত খাওয়া-দাওয়া। এখনো সে ঐতিহ্য ধরে রাখা হয়েছে।
প্রাচীনকালে মেজবানির খাবার পরিবেশন হতো মাটির বাসনে। অতিথিরা মাঠে কিংবা উঠানে পাটি বিছিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে বসতেন। এখন এ আয়োজনে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বাড়ির আঙিনার পাশাপাশি কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল এমনকি তারকা হোটেলেও মেজবানির আয়োজন চলছে। খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে রাজকীয় আয়োজনে। তবে গরুর গোশতের সেই স্বাদ, খুশবু আগের মতই রয়েছে। মেজবানির গোশত রান্না করার জন্য ডাকা হয় বিশেষজ্ঞ বাবুর্চিদের। মেজবানির গোশত রান্নায় তারা পারদর্শী। বিশেষ এক ধরনের মসলা ব্যবহার করা হয় মেজবানির গোশতে। আর এ কারণেই স্বাভাবিক গরুর গোশতের চেয়ে মেজবানির গরুর গোশতের স্বাদ হয় অন্যরকম, যা সব শ্রেণি পেশার মানুষকে দারুণভাবে আকর্ষণ করে। মেজবানির গোশত রান্নার সুনাম এখনো অক্ষুণœ রয়েছে চট্টগ্রামে। আর এ কারণে দেশের অন্য কোনো এলাকায় মেজবানির আয়োজন হলে ডাক পড়ে চট্টগ্রামের বাবুর্চিদের। চট্টগ্রামে সারা বছর ধরে চলে মেজবানির আয়োজন। তবে শীতকালে আয়োজন বেড়ে যায়। বিয়ে-শাদী, সামাজিক অনুষ্ঠান ও ওরশে মেজবানির আয়োজন করা হয়। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে পুরো মাস বিভিন্ন এলাকায় গরু, মহিষ জবাই করে দেয়া হয় মেজবানি। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বিশেষ করে নির্বাচনের আগে পরে নেতারা কর্মীদের ভুরি-ভোজনের জন্য আয়োজন করেন মেজবান। ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের জন্য মেজবানির আয়োজন করেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। কর্পোরেট হাউস এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও চট্টগ্রামে তাদের ব্যবসা উদ্বোধনকালে কিংবা নানা উপলক্ষে মেজবানির আয়োজন করেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো মেজবানির এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। ঐতিহ্য মেনে কেউ কেউ আবার মাটির বাসনে মেজবানির খাবার পরিবেশন করেন। মেজবানির গোশতের প্রতি মানুষের আকর্ষণ এখন বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। মেজবানির গোশত পরিবেশন করছে নগরীর বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁ।
কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁয় ঘোষণা দিয়ে সপ্তাহে একাধিক দিন মেজবানির গোশত পরিবেশন করছে। প্রতি রমজানে ইফতারির মেন্যুতেও স্থান করে নিয়েছে মেজবানের গোশত। ইফতার মাহফিলগুলোতে মেজবানির গোশত পরিবেশন করা হচ্ছে। গত এক দশক ধরে মেজবান দিয়ে ইফতার বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চাটগাঁইয়াদের হাত ধরে মেজবান ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। নানা উৎসবে সেখানেও ঘটা করে মেজবানির আয়োজন করা হচ্ছে। মেজবানির মাধ্যমে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে সামাজিক সম্প্রীতি বাড়ছে। আজকের ব্যস্ততম এ সময়েও মেজবান সামাজিক সম্প্রীতির মিলনমেলা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইনকিলাব, চট্টগ্রাম ব্যুরো।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
বিষয় : year
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান