স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াই
০৩ জুন ২০২৩, ০৯:০০ পিএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৩, ০১:০২ এএম
পলাশী যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাহিনীর সঙ্গে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজুদ্দৌলার বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কার্যত স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। কিন্তু স্বাধীনতা হরণের অব্যবহিত পরেই শুরু হয় স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের লড়াই। এই লড়াই ছিল সশস্ত্র। একশ বছর ধরে এ লড়াই চলে।
হল ওয়েলের মতে, ১৭৫৮ সালেই ইংরেজের প্রতিষ্ঠিত নবাব মীরজাফর ইংরেজ বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। ইংরেজ দমনে তিনি ডাচদের সাহায্য কামনা করেছিলেন। স্থির হয়েছিল, ডাচরা বাটাভিয়া থেকে সৈন্য পাঠাবে এবং সেই সৈন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে আদৌ চূচড়ার ডাচ ঘাঁটির কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে মীর জাফরের বা তার প্রতিনিধির কোনো সলা-পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত হয়েছিল কিনা তার কোনো বিবরণ আর কোনো লেখায় পাওয়া যায় না। এ কারণে অনেক ঐতিহাসিকই এ ঘটনাকে স্বীকার করতে চান না। তবে মীর জাফরের সেই সময়কার নাজুক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে তার পক্ষে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণের বাস্তবতাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। উল্লেখ করা যেতে পারে, তখন নবাবের বাহিনীতে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। তাছাড়া সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহও সংঘটিত হয়েছিল। সম্ভবত ঐ বছরই দিল্লীর সম্রাট শাহ আলমের বিহার আক্রমণ তার এ উদ্যোগে বাধা সৃষ্টি করেছিল এবং পরবর্তীতেও তিনি আর ঐ উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ পাননি।
১৭৬০ সালে মীর জাফরের জামাতা মীর কাশেম তার বদলে নবাবী লাভ করেন। মীর কাশেমের নবাবী লাভে ইংরেজদের একটা বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। তাদের ধারণা ছিল, মীর কাশেম মীর জাফর অপেক্ষা তাদের বেশি অনুগত থাকবে। কিন্তু আসলে মীর কাশেম ছিলেন স্বাধীনতার এক অমিততেজা সৈনিক। ইংরেজদের সাথে তার সখ্য ছিল লোক দেখানো। তিনি পরিষ্কার উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইংরেজদের এখনই দমন না করতে পারলে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা যাবে না। প্রথমদিকে মেদিনীপুর, ঢাকা, রামগড় প্রভৃতি এলাকায় বিদ্রোহ এবং সম্রাট শাহ আলমের দ্বিতীয়বার বাংলা আক্রমণের প্রস্তুতি তাকে কিছুটা বিচলিত করলেও অচিরেই তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে সৈন্যদের আধুনিক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং বাহিনীকে আরো সুগঠিত করেছিলেন। তার এই রণ প্রস্তুতিই ইংরেজ বাহিনীর পাটনা আক্রমণের মূল কারণ। এরপরই ইংরেজ ও মীর কাশেমের বাহিনীর মধ্যে আরো কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এর মধ্যে বক্সারের যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই যুদ্ধের আগে তিনি দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম ও অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার সাথে চুক্তিতে উপনীত হয়েছিলেন। এই তিন পক্ষের সম্মিলিত বাহিনী বক্সারে ইংরেজ বাহিনীর মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই যুদ্ধেও মীর কাশেমের পরাজয় হয়েছিল। ইতিমধ্যে মীর জাফর ইংরেজদের বদান্যে দ্বিতীয়বার নবাবী লাভ করেন। পরবর্তীকালে ভারতের বিভিন্ন অংশে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংগঠিত করার কাজে মীর কাশেম নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন এবং শেষ পর্যন্ত উদরী রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশেমের পরাজয় ইতিহাসে আরো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তার পরাজয় ছিল সেই সময়কার ইংরেজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের পরাজয়। পলাশী যুদ্ধে ইংরেজরা বাংলায় প্রভুত্ব স্থাপনের যে সূচনা করেছিল বক্সারের যুদ্ধে সেই প্রভুত্ব হয়েছিল আরো সুসংহত। এই সাথে ভারত বিজয়ের সুযোগও বেড়ে গিয়েছিল। বক্সারের যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের একটা শক্তিশালী প্রয়াস।
১৭৬৩ সালে বাংলায় এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। এই বিপ্লবের উদ্গাতা ছিলেন মজনুশাহ। ইতিহাসে তার এ বিপ্লবকে ‘ফকির বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তার মাদারী সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিররা বাংলা থেকে বিহার পর্যন্ত বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া এই বিপ্লবে নবাব সিরাজদ্দৌলাহর সৈন্যবাহিনীর বিতাড়িত সৈনিকরাও অংশগ্রহণ করেছিল। ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত এ বিপ্লব অব্যাহত ছিল। ফকির সেনাদল ১৭৬৩ সালে প্রথম ঢাকার সদরঘাট ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করে তাদের অগ্রাভিযানের সূচনা করেছিল। এই আক্রমণে কুঠির বণিকরা বুড়িগঙ্গা দিয়ে নৌকাযোগে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল। ১৭৬৬ সালে কুচবিহারের দিনহাটায় ফকির এবং সেই সাথে সন্ন্যাসীদের একটি মিলিত বাহিনী বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল ইংরেজ সেনাদল। ১৭৬৭ সালে বিহারের সাংরেসি জেলায় দু’টি যুদ্ধে ফকির বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়েছিল ব্রিটিশ ফৌজ। অনুরূপভাবে ফকির বাহিনী ১৭৬৯ সালে নেপাল সীমান্তের মোরাং অঞ্চলে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে নির্মূল করে দিয়েছিল ইংরেজদের এক বিশাল বাহিনী। ১৭৭২-৭৩ সালের দিকে রংপুরে ফকির বাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ সময় ফকির বাহিনী ইংরেজদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা ছাড়াও ইংরেজদের কুঠি ও জমিদারদের গোলা লুট করে নিরন্ন দরিদ্র মানুষের প্রাণ রক্ষায় এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। ১৭৭২ সালে ফকির বাহিনী রংপুরে যে হামলা চালিয়েছিল তাতে অংশ নিয়েছিল ৫০ হাজার ফকির সেনা। এই সময়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলে ফকির বাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। মধুপুর ও ভাওয়ালের জঙ্গলে ছিল এদের আস্তানা। এরা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, জমিদাররা এদের খাজনা দিতে বাধ্য হয়েছিল। এছাড়া খুলনা, যশোর, ২৪ পরগনা প্রভৃতি অঞ্চলেও ফকির বাহিনীর অভিযান বিস্তার লাভ করেছিল। মোট কথা, সমগ্র বাংলাদেশ ও বিহার ফকিরদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল। ১৭৮৬ সালে ফকির বিপ্লববের মহানায়ক মজনু শাহ ইন্তেকাল করলে এই বিপ্লবী তৎপরতায় ভাটার টান নেমে আসে, যদিও তার অনুসারীরা ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিপ্লবের এই ঝা-া উডডীন রেখেছিলেন।
ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মহীশুরের রাজা হায়দার আলী ও তার পুত্র টিপু সুলতানের অবদান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। মহীশুরে হায়দার আলীর ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধিতে শংকিত হয়ে ১৭৬৬ সালে ইংরেজ, মারাঠা ও নিজামের বাহিনী একযোগে হায়দার আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। এই সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকা হায়দার আলীর বাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করে আত্মরক্ষা করেছিলেন। প্রথম তিনি অর্থের বিনিময়ে মারাঠাদের বশীভূত করেছিলেন এবং নিজামকে ইংরেজ মৈত্রীজোট থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। অতঃপর নিজামকে সাথে নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর মোকাবিলা করেছিলেন ১৭৬৭ সালে। এই যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন এবং নিজাম পুনরায় ইংরেজ পক্ষে যোগদান করেছিলেন। পরে আর একবার মারাঠা-নিজাম ও হায়দার আলীর মৈত্রী গড়ে উঠেছিল এবং তাদের এই মিত্র বাহিনী আর্কটের যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। ১৭৮০ সালে হায়দার আলীর মৃত্যু হয় এবং তার সুযোগ্য পুত্র টিপু সুলতান রাজা হন। তিনিও তার পিতার মত ইংরেজবিরোধী সংগ্রাম ও যুদ্ধ আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৭৮৯ সালে টিপু সুলতান ইংরেজদের মিত্র রাজ্য ত্রিবাংকুর আক্রমণ করলে কর্নওয়ালিস মারাঠা ও নিজামের সাথে মৈত্রী সূত্রে আবদ্ধ হয়ে টিপুর বিরুদ্ধে স্বয়ং যুদ্ধে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। চতুর্থ মহীশুর যুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধে (১৭৯০) শেষ পর্যন্ত টিপুর পরাজয় ও মৃত্যু হয়। পরে মারাঠা, নিজাম ও ইংরেজ-এই তিন পক্ষ মহীশুর রাজ্য নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটা বিরাট অধ্যায় জুড়ে আছে জিহাদ-আন্দোলন। সীমান্ত প্রদেশে মুসলমানদের ও শিখদের নির্যাতন এবং মুসলিম সমাজে নানারকম শিরক-বিদ’আতের বিস্তার সর্বোপরি ইংরেজ আগ্রাসন জিহাদ-আন্দোলন সংগঠনে প্রধান প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী। তার মৃত্যুর পর তারই পুত্র শাহ আবদুল আযীয দেহলবী আন্দোলনের একটি মজবুত ভিত্তি দাঁড় করিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য শিষ্য রায় বেরেলীর সৈয়দ আহমদ শহীদ সমগ্র ভারতে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ব্যাপকভাবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে জিহাদের জন্য মুসলমানদের সংগঠিত করেছিলেন। এই বাংলাদেশের ও প্রায় এমন কোনো এলাকা ছিল না যেখানে জিহাদ আন্দোলনের বাণী না পৌঁছেছিল। বাংলার হাজার হাজার মানুষ জিহাদ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। জিহাদ আন্দোলনের কয়েকজন শীর্ষ নেতাও ছিলেন বাংলাদেশের। ইংরেজদের সাজানো মোকাদ্দমার নথিপত্র অনুযায়ী জিহাদ ঘোষিত হয়েছিল ১৮২৬ সালের ডিসম্বর। ১৮৩১ সালে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহমদ শাহাদত বরণ করার আগ পর্যন্ত মুজাহিদ বাহিনী বহু যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। বালাকোট যুদ্ধের পর আরও কিছুদিন মুজাহিদদের তৎপরতা অব্যাহত ছিল। মুজাহিদরা ভারতের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এলাকাভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সিপাহী বিপ্লব সংগঠন এই মুজাহিদ নেতৃবৃন্দের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কয়েকজন জিহাদী নেতা সিপাহী বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
জিহাদ আন্দোলনের সমকালেই বাংলাদেশে ফরায়েজী আন্দোলন নামে আরেকটি আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহ। প্রথমদিকে এ আন্দোলন ধর্মীয় ভাবধারা ও সংস্কারধর্মী হলেও পরবর্তীতে তা রাজনৈতিক রূপ লাভ করেছিল। ১৮২০ সালে এ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সংস্কারের বাণী পৌঁছানোর পাশাপাশি জমিদার, মহাজন ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের গণপ্রতিরোধ। হাজী শরীয়তউল্লাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এ দেশ শত্রু কবলিত রাষ্ট্র। ইংরেজ ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অবৈধভাবে দেশ শাসন করছে। সুতরাং, তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে দেশ স্বাধীন করা জনগণের একটি বৈধ অধিকার এবং এটি দেশবাসীর একটি পবিত্র দায়িত্ব।’ তিনি আরও ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সমস্ত সম্পদ ও যমীর মালিকানা আল্লাহর।... যমীর ওপর মালিক সেজে কর ধার্য করাও সম্পূর্ণ অবৈধ।’ তার এই বৈপ্লবিক ঘোষণা সারাদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। হাজী শরীয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র মুহসিন উদ্দীন আহমদ দুদু মিয়া এ আন্দোলনের ঝা-া সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মহাবিপ্লব শুরুর পরপরই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। এ সময় তার শরীর ভেঙ্গে গিয়েছিল। তিনি ১৮৬২ সালে ইন্তেকাল করেন।
১৮৩১ সালে বাংলাদেশের ২৪ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরে এক বিরাট কৃষক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর। তিনি ছিলেন হাজী শরীয়তউল্লাহর সমসাময়িক। জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি এক বিরাট বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন এবং যুগপৎভাবে জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি নারিকেল বাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন। এই কেল্লা থেকেই তিনি তার বাহিনী পরিচালনা করতেন। সংশ্লিষ্ট এলাকায় তার ক্ষমতা, প্রতাপ, সুনাম ও জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছিল যে, তিনি একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং এলাকার জনগণ তাকে বাদশাহ বলে অভিহিত করতেন। ১৮৩১ সালেই বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার যুদ্ধে তিনি শাহাদত বরণ করেন এবং ধীরে ধীরে তার সূচিত জিহাদ স্তিমিত হয়ে যায়।
পলাশী যুদ্ধের পর থেকে সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত আরও বহু সংগ্রাম, আন্দোলন ও লড়াই বিভিন্ন এলাকায় হয়েছিল। এ সবের কয়েকটিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ত্রিপুরায় স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শমসের গাজী, সন্দ্বীপের বিপ্লবী আবু তোরাব, নোয়াখালীর লবণ চাষীদের নেতা নওয়াব আলী, রংপুরের কৃষক অভ্যুত্থানের নায়ক নূর উদ্দীন, বরিশালের সুবান্দিয়া বিপ্লবের সংগঠক বোলাকী শাহ। মোটকথা, মুসলমানদের শতাব্দীব্যাপী বিপ্লব, অভ্যুত্থান, আন্দোলন ও লড়াই ১৮৫৭ সালের বিপ্লবকে সম্ভব করে তুলেছিল এবং স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বিপ্লবের বাণী সর্বত্র পৌঁছে দিতে অসাধারণ ভূমিকা ও অবদান রেখেছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অসাধারণ তাৎপর্যময় একটি ঘটনা। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে এটা ছিল প্রথম সর্বভারতীয় প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর ফলে স্বাধীনতা সংগ্রাম জাতীয় স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এক নতুন ধারা ও প্রক্রিয়ার মধ্যে পরিণতির পথে অগ্রসর হয়।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের ব্যর্থতা আরও একটা মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। বিপ্লব ব্যর্থ না হলে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটতো, একশ’ বছরের পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত হয়ে পুনরায় স্বাধীন-সার্বভৌম ভারতের অভ্যুদয় ঘটতো। কিন্তু, বিপ্লব সফল না হলেও আরেক ধরনের বিরাট পটপরিবর্তন ঘটলো। এই পরিবর্তন পরবর্তীকালের স্বাধীনতা সংগ্রাম, আন্দোলন, রাজনীতি ও ঘটনাপ্রবাহের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ১৮৫৭ সালের পর যে পরিবর্তনগুলো দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে উঠলো তার মধ্যে কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা ব্রিটিশ রাজের হাতে চলে যাওয়া, হিন্দু জাতীয় চেতনার উত্থান এবং এর মুসলমানদের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ থেকে সরে আসার প্রেক্ষাপটে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানদের স্ব-সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপমহাদেশের পরবর্তী ইতিহাস এই পরিবর্তনগুলোর ওপর ভিত্তি করেই আবর্তিত ও গঠিত হয়েছে।
১৮৫৭ সালের পূর্ববর্তী একশ’ বছর ভারতীয় মুসলমানেরা স্বাধীনতা পুনঃরুদ্ধারের জন্যে যে সশস্ত্র লড়াই পরিচালনা করেছে তার পটভূমিতেই সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয় সে কথা পা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সিপাহী বিপ্লবের সংগঠকও ছিল মুসলমানরা। ফলে স্বাভাবিক কারণেই বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের উপর অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন নেমে আসে। মুসলমান পরিচয়ই অপরাধের কারণ বলে বিবেচনা লাভ করে। হাজার হাজার মুসলমান সংগ্রামীকে হত্যা করা হয়, হাজার হাজার মুসলমানকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং বিচারের নামে প্রহসন করে তাদের দ্বীপান্তর বা বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। মুসলমানদের সম্পদ-সম্পত্তি লুণ্ঠন করা হয়। এই নিপীড়ন-নির্যাতনের কারণে অনেকে বনে-জঙ্গলে ও বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর আগে ১৭৬৩ সালে কোম্পানির দেওয়ানী গ্রহণ, ১৭৮৩ সালে দশসালা ও ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন, ১৮৩৭ সালে ফার্সির বদলে অফিস-আদালতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন, ১৮৪৭ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট জারি ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিকভাবে মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে নি¤œতম স্থানে নামিয়ে আনা হয়। সিপাহী বিপ্লবের পর যা বাকি ছিল, তা করা হয় অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক। মুসলমানরা যাতে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা করতে না পারে তার ব্যবস্থা করা হয়। এই পর্যায়ে ভারতের শাসন কর্তৃত্ব হস্তান্তরিত হয়ে যায় ব্রিটিশ রাজের হাতে। এই হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে প্রথমত, কোম্পানিকে গণহত্যা, নিপীড়ন ও শোষণের অপরাধ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। দ্বিতীয়ত, ভারতে ইংরেজ অধিকারকে আরো পাকাপোক্ত ও মজবুত করা হয়।
সিপাহী বিপ্লবের পর মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় কোন পর্যায়ে নেমে এসেছিল তার বিবরণ বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। সে বর্ণনা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি অমানবিক। মুসলিম জাতি ও সমাজ এক চরম প্রান্তিক অবস্থানে নেমে আসে। এই সম্পূর্ণ বৈরী অবস্থান ও পরিবেশে মুসলমানদের রক্ষা করা ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ জাগ্রত করার জন্য পরবর্তীতে কয়েকজন শিক্ষিত মুসলমান এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে নওয়াব আবদুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাদের মাধ্যমে ও প্রেরণায় স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন সূর্য উদিত হয়।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
বিষয় : year
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান