আশুরার মর্মকথা

Daily Inqilab এ.কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী

২৮ জুলাই ২০২৩, ০৮:১৫ পিএম | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০২ এএম

বিশ্ব মুসলিম মিল্লাতের বছরের প্রথম মাস আল মুহররম। এই শব্দটি আসলে গুণবাচক বিশেষণ, নামবাচক বিশেষ্য নয়। ইসলামের আগমনের বহু পূর্ব হতে প্রাচীন আরবে বছরের প্রথম দুই মাস ছিল যথাক্রমে সাফার ও সাফার। আল মুহররম ও সাফারের পরিবর্তে আল সাফারাইসি এই দ্বিপাক্ষিক রূপের ব্যবহার দেখে তা সহজেই অনুভব করা যায়।

আরবের বর্ষপঞ্জির ইতিহাস গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করলে দেখা যায়, প্রাচীন আরবে বছরের প্রথম অর্ধাংশে তিনটি মাস ছিল। যথা: সাফার, রবি ও জুমাদা। এই তিনটি মাসের প্রত্যেকটিতে দুটি করে মাস ছিল। যেমন প্রথম সাফার, দ্বিতীয় সাফার, প্রথম রবি, দ্বিতীয় রবি, প্রথম জুমাদা, দ্বিতীয় জুমাদা। যেহেতু দুই সাফারের পরে দুই রবি ও দুই জুমাদা ছিল এবং দুই সাফারের প্রথমটি অলক্ষণীয় পবিত্র মাসগুলোর (আশহুরুল হুরুম) অন্যতম মাস ছিল বলে এর গুণবাচক অ্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল ‘আল মুহররাম’। যুগ ও কালের ক্রমধারায় আল মুহররম আখ্যাটিই প্রথম সাফারের পরিবর্তে ধীরে ধীরে বছরের প্রথম মাসের নাম হয়ে গেছে। আর সাফারের সানী মাসটি সাফার নামে আখ্যায়িত হয়েছে। তবে বছরের শেষ অর্ধাংশের মাসগুলোর নাম পূর্ববৎই রয়ে গেছে। যথা: রাজাব, শাবান, রামাদান, শাওয়াল, জুলকাদা, জুলহিজ্জা। জুলহিজ্জা মাসও অলক্ষণীয় পবিত্র মাসগুলোর (আশহুরুল হুরুম) অন্যতম হওয়ায় অধি বছর ছাড়া অন্যান্য বছরে চারটি অলক্ষণীয় পবিত্র মাসের তিনটি একাধিক্রমে আসত। যেমন- জুলকাদা, জুলহিজ্জা ও মুহররম। আর রজব মাসটি পৃথকভাবে আসত, যা অদ্যবধি একই রকম আছে।

মহান রাব্বুল আলামীন, চন্দ্রকেই সময়ের পরিমাপক রূপে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে: তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং এর মনযিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এটা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এই সকল নিদর্শন বিষদভাবে বিবৃত করেন। (সুরা ইউনুস: আয়াত-৫)।

এই আয়াতে কারিমায় চাঁদের জন্য মানযিল শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী জ্যোতির্বিজ্ঞানে চান্দ্র মাসকে ২৮টি মানযিলে ভাগ করা হয়েছে। চান্দ্রমাসের এই মানযিলকে বাংলা ভাষায় তিথি বলা হয়।

তবে চান্দ্র বছরকে সৌর বছরের সাথে একই পর্যায়ে আনায়ন করার জন্য অধি বছর সূত্রে একটি মাসকে বর্ধিত করা হতো। বর্ধিত এই মাসটিকে জুলহিজ্জার পরে সংযুক্ত করার নিয়ম ছিল। কিন্তু এই বর্ধিত মাসটি অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাস হতো না। এর ফলে মুসলিম জ্ঞানী চিন্তাবিদগণ এরূপ গর্হিত মাস বৃদ্ধি করাকে সংশ্লিষ্ট মুহররম (অলঙ্ঘনীয় পবিত্র) মাসের নতুন করে সাফার নাম দেওয়ার শামিল বলে উল্লেখ করেন। এর দ্বারা আল মুহররম (অলঙ্ঘনীয়, পবিত্র মাসকে) লঙ্ঘনীয় মাসে পরিণত করা হয়। এটা আল্লাহপাকের প্রদত্ত বছর গণনার নির্দেশের পরিপন্থী। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে: আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে মাস বারটি। তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস (যুলকাদা, যুলহিজ্জা, মুহররম ও রাজাব) এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে। যেমন তারা তোমাদের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ করে থাকে এবং জেনে রেখ, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। এই যে মাসকে পিছিয়ে দেয়া কেবল কুফুরীকে বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফিরদের বিভ্রান্ত করা হয়। তারা একে কোনো বছর বৈধ করে এবং কোনো বছর অবৈধ করে, যাতে তারা আল্লাহ যেগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন, সেগুলোর গণনা পূর্ণ করতে পারে। তাদের মন্দ কাজগুলো তাদের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে। আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। (সুরা তাওবা: আয়াত ৩৬-৩৭)। এই আয়াতে কারীমার দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, বছর গণনায় বর্ধিত মাসের কোনো স্থান নেই।

এতো কিছুর পরও প্রাথমিক যুগে বর্ধিত মাস প্রবর্তন করে চান্দ্র বছরকে সৌর বছরের সমপর্যায়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই অপচেষ্টা আদৌও ফলবতী হয়নি। কারণ এই যে, প্রাচীন আরবে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত অভাব ছিল প্রচুর, সে যুগে শীতকালীন অর্ধ বছর আরম্ভ হতো আল মুহররম মাস দ্বারা। প্রথম ছয় মাসের নাম দেখলে তা সহজেই বোঝা যায়। ইয়াহুদি বছরের ন্যায় আরব বছরও শরৎকালে আরম্ভ হতো।

আল কোরআনের ৯নং সূরা তাওবাহ-এর ৩৭ নং আয়াতে বর্ধিত মাস যুক্ত করার রীতি চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর মুসলিম বছরের সমস্ত ঋতুতেই ঘুরে ফিরে আসে। কারণ, বারটি চান্দ্রমাসে সর্বদাই তিনশত চুয়ান্ন বা তিনশত পঞ্চান্ন দিন পাওয়া যায়। যেমন বর্তমানে পাওয়া যায় এবং ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম হবে না।

আল মুহররম মাসের দশম দিবসকে আশুরা বলা হয়। হাদীস শরীফে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় হিজরত করার পর ইহুদিদের নিকট হতে জানতে পারলেন যে, এই আশুরার দিন হযরত মুসা (আ.) জালিম কাফের ফেরাউনের বন্দিদশা হতে ইসরাইলি-বংশধরদের উদ্ধার করেছিলেন এবং ফেরাউন সসৈন্যে সাগরে ডুবে মরেছিল। এ কারণে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় স্বরূপ হযরত মুসা (আ.) এই দিনে রোজা পালন করেছিলেন এবং একই কারণে ইহুদিরাও আশুরার দিন রোজা রাখে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: তোমাদের অপেক্ষা হযরত মুসার সাথে আমাদের সম্পর্ক অগ্রাধিকারমূলক এবং নিকটতম। তখন হতে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে আশুরার রোজা রাখলেন এবং এইদিনে উম্মাতগণকে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। হাদীস শরীফে এতদসংক্রান্ত আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা পাওয়া যায়। যথা: (ক) রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে আশুরার রোজা পালনের আদেশ দান করেছেন এবং তাদেরকে উৎসাহিত করেছেন। (খ) কতিপয় সাহাবী-রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আরজ করলেন, ইহুদি ও খ্রিস্টানরা আশুরাকে বড় মনে করে। উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকলে আমি আল মুহররমের নবম দিনও রোজা রাখব। (গ) পরবর্তীতে রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পর হতে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবীগণকে আর আশুরার রোজার আদেশ করতেন না, নিষেধও করতেন না। (ঘ) অবশ্য তিনি নিজে রমজানের রোজার অনুরূপ গুরুত্বসহকারে বরাবর আশুরার রোজা পালন করতেন। (ঙ) তিনি বলেছেন: রমজানের রোজার পর সর্বাপেক্ষা আফজল মুহররমের এই রোজা। বস্তুত আশুরার উল্লেখ দশই মুহররম অর্থে সুপ্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। যার আবহ এখান পর্যন্ত একইভাবে অব্যাহত রয়েছে। কতকগুলো ইসলামী অনুষ্ঠান ও রীতি প্রাচীন আরবদের বিশেষত হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধরদের মধ্যে তারই নির্দেশে প্রবর্তিত হয়েছিল। যার ফলে আশুরার মর্যাদা বহুগুণে বর্ধিত হয়েছিল। তবে, এই দিনে শুহাদায়ে কারবালার রূহের মাগফেরাত ও মানজেলাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে মুসলিম মিল্লাত দোয়া ও মোনাজাত করে থাকেন। এটা বড়ই বরকতময় কাজ।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বৈশাখের কালো ঘোড়া
কালবৈশাখী
বৈশাখ
আচানক এইসব দৃশ্য
ভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকিভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকি
আরও
X

আরও পড়ুন

লৌহজংয়ে বিএনপির পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা

লৌহজংয়ে বিএনপির পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা

নতুন বছরের প্রথমার্ধে এর মাধ্যমে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে আসবে - প্রিন্স

নতুন বছরের প্রথমার্ধে এর মাধ্যমে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে আসবে - প্রিন্স

আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গ্রেপ্তার

আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গ্রেপ্তার

কুমিল্লায় ক্রেতা-বিক্রেতার কলরবে মুখরিত পহেলা বৈশাখের মাছের মেলা

কুমিল্লায় ক্রেতা-বিক্রেতার কলরবে মুখরিত পহেলা বৈশাখের মাছের মেলা

টানা দুই দিন সংঘর্ষ, ১৪৪ ধারা জারি রাজৈরে

টানা দুই দিন সংঘর্ষ, ১৪৪ ধারা জারি রাজৈরে

নির্বাচনের রোডম্যাপের সমাধান হবে আলোচনার মাধ্যমে: মির্জা ফখরুল

নির্বাচনের রোডম্যাপের সমাধান হবে আলোচনার মাধ্যমে: মির্জা ফখরুল

মহেশখালীতে ছাত্রলীগ নেতার হাতে বিএনপির কর্মী খুন -রাজনীতি নিয়ে কথা কাটাকাটি

মহেশখালীতে ছাত্রলীগ নেতার হাতে বিএনপির কর্মী খুন -রাজনীতি নিয়ে কথা কাটাকাটি

কিশোরগঞ্জে আনন্দ আয়োজনে বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন

কিশোরগঞ্জে আনন্দ আয়োজনে বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন

প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাহরাস্তিতে জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা আটক

প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাহরাস্তিতে জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা আটক

সুনামগঞ্জে নানান আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

সুনামগঞ্জে নানান আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

আটঘরায় সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক নিহত আহত ২ জন

আটঘরায় সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক নিহত আহত ২ জন

নববর্ষে বিএনপির আকাঙ্খা দ্রুত ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া-কাজী শিপন

নববর্ষে বিএনপির আকাঙ্খা দ্রুত ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া-কাজী শিপন

ইসরায়ীলের সুবিধাভোগী ছিল স্বৈরাচারী আ‘লীগ- নববর্ষে বিএনপি নেতা মাহবুব চৌধুরী

ইসরায়ীলের সুবিধাভোগী ছিল স্বৈরাচারী আ‘লীগ- নববর্ষে বিএনপি নেতা মাহবুব চৌধুরী

ড. ইউনূসের অনাড়ম্বর আয়োজনে নববর্ষের শুভেচ্ছা, মুগ্ধ নেটিজেনরা

ড. ইউনূসের অনাড়ম্বর আয়োজনে নববর্ষের শুভেচ্ছা, মুগ্ধ নেটিজেনরা

দুমকীতে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে গাছ উপরে পড়ে আহত-২

দুমকীতে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে গাছ উপরে পড়ে আহত-২

দুই পক্ষের সংঘর্ষে এএসপিসহ অর্ধশত আহত, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ

দুই পক্ষের সংঘর্ষে এএসপিসহ অর্ধশত আহত, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ

ভারতীয় দুম্বা এবং ছাগল আটক করলো সিলেট বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়ন

ভারতীয় দুম্বা এবং ছাগল আটক করলো সিলেট বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়ন

মাগুরার শ্রীপুরে যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

মাগুরার শ্রীপুরে যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

মনোহরগঞ্জে মাদরাসার ছাদে শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

মনোহরগঞ্জে মাদরাসার ছাদে শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

দুই পক্ষের সংঘর্ষে এএসপিসহ অর্ধশত আহত, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ

দুই পক্ষের সংঘর্ষে এএসপিসহ অর্ধশত আহত, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ