ঈদে মিলাদুন্নবী সা. এর তাৎপর্য
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:২৯ পিএম | আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম
ঈদে মিলাদুন্নবী মুসলমানদের জন্য এমন একটি আনন্দোৎসব, যার কোনো তুলনা হয় না। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর দুনিয়ায় আগমন উপলক্ষে মক্কায় তার জন্মোৎসব পালন করার প্রথাটি শুরু করেন খোদ রসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাদা আবদুল মোত্তালেব। দিবসটির তাৎপর্য সর্ব প্রথম আবদুল মোত্তালেবই বুঝেছিলেন। বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সকল সীরাত গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের সুসংবাদে হযরত আবদুল মোত্তালেব অসীম আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আনন্দ প্রকাশার্থে অনেক লোকের মধ্যে তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী খাবার দাওয়াতের আয়োজন করেছিলেন। হযরত মওলানা সৈয়দ মুফতী মোহাম্মদ আমীমুল এহসান মোজাদ্দেদী বরকতী (রহ.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী, বৃদ্ধ সর্দার আবদুল মোত্তালেব পৌত্রের জন্মের সুসংবাদ শ্রবণ করে গৃহে আগমন করেন এবং নবজাতক শিশুকে খানা-ই-কাবায় নিয়ে যান এবং দোয়া করেন। সপ্তম দিবসে আকীকা করে, ‘মুহম্মদ’ (সা.) নাম রাখেন এবং সমগ্র কোরেশকে দাওয়াত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার এই সন্তান সমগ্র বিশ্বে প্রশংসার অধিকারী হবে।’
হযরত শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (রহ.) এ সম্পর্কে তার বিখ্যাত পুস্তক ‘মা সাবাতা বিসসুন্নাহ’তে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। ১২ রবিউল আউয়াল (সোমবার) রসূলুল্লাহ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন বলে প্রসিদ্ধ বর্ণনায় বলা হয়েছে। এ দিন মক্কাবাসীরা রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মস্থান জিয়ারত করত।
জন্মরাতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (রহ.) বলেন, এই রাত শবে কদর হতে উত্তম। কেননা তাঁর শবে বেলাদত হচ্ছে তার জন্মরাত এবং শবে কদর তাকে প্রদান করা হয়। যে রাত্রটিকে তাঁর আবির্ভাবে সম্মানিত করা হয়েছে এটি শবে কদর অপেক্ষা উত্তম। শবে কদরে শুধু আসমান হতে ফেরেশতারা আগমন করে থাকেন। পক্ষান্তরে জন্মদিবসের রাতে রসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান সত্তার আবির্ভাব ঘটে। জন্মরজনীর শ্রেষ্ঠত্বের আরও একটি কারণ হচ্ছে, শবে কদরের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব শুধু উম্মতে মুহম্মদীর জন্য নির্ধারিত। পক্ষান্তরে বাস্তব ঘটনা হচ্ছে, রসূলুল্লাহ (সা.) -এর মহান সত্তাকে আল্লাহতাআলা সকল জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ নির্ধারণ করেছেন এবং তারই মহান সত্ত্বার গুণাবলির কারণে আসমান, জমিন ও সকল মাখলুকাতকে আল্লাহতাআলা সাধারণ নিয়ামত দ্বারা ধন্য করেছেন। রসূলুল্লাহ (সা.)-কে আল্লাহতাআলা সমগ্র জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন বলে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল লিল আলামীন।’
শায়খ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (রহ.) বলেন, সোয়াইবাকে (রসূলুল্লাহ সা.-এর জন্মের সংবাদ শুনে আনন্দিত হয়ে আবু লাহাব তাঁর দাসীকে) আজাদ করেছিল। এর বিনিময়ে তার প্রতি আল্লাহর আযাব শিথিল করা হয়। তাহলে সে সব মুসলমানের অবস্থা চিন্তা করা যায়, যারা রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মোৎসব উপলক্ষে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করে এবং তার মহব্বত ভালবাসায় ক্ষমতানুযায়ী ব্যয় করে। লেখক তার প্রাণের শপথ করে বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মরজনীতে আনন্দ প্রকাশের কারণে আল্লাহতাআলা তার সাধারণ দয়া অনুগ্রহে আনন্দ প্রকাশকারীগণকে বেহেশতের বাগানে দাখিল করবেন। মুসলমানগণ সব সময় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে আসছেন। মিলাদ মাহফিলের সঙ্গে সঙ্গে দাওয়াত করে থাকেন। তারা আনন্দ প্রকাশ করেন এবং অকাতরে খরচও করেন। এতদ্ব্যতীত জন্মোৎসব উপলক্ষে কোরআন খতম করান এবং নিজেদের আবাসগৃহ সুসজ্জিত করেন। এসব উত্তম কাজের বরকতে ঐ সব লোকের উপর আল্লাহর বরকত-রহমত নাজিল হতে থাকে।
শেখ আবদুল হক মোহাদ্দেস দেহলবী (রহ.) ইবনে জওযীর বর্ণনা উদ্ধৃত করে বলেন, মিলাদ মাহফিল আয়োজনকারীদের জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতা হচ্ছে এই, মিলাদ অনুষ্ঠানকারীরা সারাবছর আল্লাহর আশ্রয়ে নিরাপদে থাকে এবং উদ্দেশ্য ও মকসুদ হাসিলের আনন্দ তাড়াতাড়ি উপভোগ করতে পারে। আল্লাহতাআলা রহমত নাজিল করেন মিলাদুন্নবীর রাতে যারা ঈদোৎসব পালন করে তাদের প্রতি। আর যাদের অন্তরে দুশমনী হঠকারিতা থাকে তাদের অন্তর সে কাজে আরও শক্ত হয়ে যায়। শেখ বলেন, ইবনুল হাজ তার ‘মদখাল’ পুস্তকে উল্লেখ করেছেন, মিলাদুন্নবী মাহফিলে লোকদের বেদাত, কুসংস্কার, অবৈধ কার্যকলাপ, হারাম বাদ্যযন্ত্রের দ্বরা গান বাজানোর বিরোধিতা করেছেন এবং ঐ সকল গান বাদ্য সম্পূর্ণ নাজায়েজ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লামা কুসতুলানী রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাস, এই মতের সমর্থনে লিখেছেন যে, ‘তাঁর জন্ম তারিখের দিন মক্কাবাসীরা নিয়মিত জন্মস্থান জিয়ারত করত।’ এটি ওফাতের পূর্বের ঘটনা। অর্থাৎ- জীবদ্দশায় মক্কী জীবনে মুসলমানগণ হযরতের জন্মস্থানের প্রতি সম্মন প্রদর্শনার্থে এরূপ করত। এই ঘটনা মিলাদোৎসবের এক বড় দলিল। রসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের এসব ঘটনা তার জন্মোৎসব বা ঈদে মিলাদ উদযাপনের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সুতরাং বিশ^নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের পক্ষ হতে তার জন্মোৎসব প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ (সা.)-এর আপন চাচা হজরত আব্বাস (রা.) ইবনে আবদুল মোত্তালেবের একটি ঘটনা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঘটনাটি হাকিমুল উম্মত হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) তার ‘নাশরুত্তীব’ পুস্তকে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি হুজুর (সা.)-এর অনুমতিক্রমে প্রশস্তিসূচক একটি কাসিদায় তার জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। এ সম্পর্কে হজরত থানভী (রহ.) যা বলেছেন তা হলো: রসূলুল্লাহ (সা.) যখন তাবুক যুদ্ধ হতে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন তখন হযরত আব্বাস (রা.) আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল, আমাকে আপনার কিছু প্রশংসা করার অনুমতি দান করুন।’ তিনি ইরশাদ করেন, ‘বল আল্লাহ তোমার জবানের হেফাজত করুন।’ তখন হযরত আব্বাস (রা.) হুজুর (সা.) এর প্রশংসায় আটটি কবিতা সম্বলিত এক কাসীদা পাঠ করেন। এসব কবিতায় হুজুর (সা.)-এর জন্মবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। তিনি স্বয়ং এই কাসিদা শ্রবণ করেন। মূল কাসিদাটি হজরত থানভী (রহ.)-এর উল্লেখিত পুস্তকে উদ্ধৃত হয়েছে।
এই ঘটনা হতে আরো প্রমাণিত হয় যে, রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মোৎসব পালন করার সময় তার জীবনচরিত ও আদর্শ শিক্ষা আলোচনা করা একান্ত আবশ্যক। তবে এরূপ আলোচনা বা মিলাদ মাহফিল কেবল তার জন্মদিবস বা জন্ম মাসেই সীমাবদ্ধ নয়, সর্বদাই তা করা উচিত। আরো উল্লেখযোগ্য, হযরত হাসসান ইবনে সাবেত রা. ছিলেন একজন সাহাবী কবি। তার উপাধি ছিল ‘সায়েরুননবী’। তিনি রসূলুল্লাহ (সা.)-এর উপস্থিতিতে তার প্রশংসায় বহু কবিতা আবৃত্তি করেন। মিলাদুন্নবী উদযাপন উপলক্ষে হুজুর (সা.)-এর জীবনচরিত আলোচনা করার তাৎপর্য এতে সহজেই অনুমেয়। আল্লাহর নামের সাথে যার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, যাঁর স্মরণকে স্বয়ং আল্লাহতাআলা সুমহান করেছেন, ‘মাকামে মাহমুদ’ যাঁকে দান করে আল্লাহ তাঁর মর্যদা সুউচ্চ করেছেন, তাঁর জন্মোৎসব ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করার গুরুত্ব ও প্রয়োজন সর্বাধিক এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর আনুগত্যের সাথে তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের নির্দেশ রয়েছে। তার প্রতি ভালবাসা, আল্লাহর প্রতি ভালবাসা স্বরূপ। যাঁর মধ্যে উত্তম আদর্শ, পবিত্র কোরআন যার মহান চরিত্র এবং যার প্রতি খোদ আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ দরূদ পাঠ করে থাকেন, তার জন্মোৎসব উদযাপন করার সৌভাগ্য আল্লাহর এক মহান অবদান। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের একটি ক্ষুদ্র অথচ মহামূল্যবান আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি।’ (সূরা- ইনশেরাহ, আয়াত- ৪)
এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোরআনের ভাষ্যকারগণ বহু মূল্যবান তথ্য পরিবেশন করেছেন, যা একত্রিত করা হলে এক বিরাট গ্রন্থ হয়ে যাবে। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে মিলাদ মাহফিলের অনুষ্ঠান করা, দান-খয়রাত এবং আনন্দ প্রকাশ করার বৈধতা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের আমল বলে যারা মনে করেন, তারা এর সমর্থনে আল্লামা ইমাম শাহাবুদ্দীন আহমদ ইবনে হাজার আল হায়ছামী শাফেয়ী কৃত ‘আন নেয়ামাতুল কোবরা আলা ফি মওলাদে সাইয়িদিল আনাম’ গ্রন্থে অনেক মূল্যবান মন্তব্য প্রদর্শন করা হয়েছে।
রসূলুল্লাহ (সা.)-কে সোমবারের দিন রোজা রাখা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেন, তোমরা সোমবার রোখা রাখ, কারণ ঐ দিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং ঐ দিন আমার প্রতি কোরআন নাযিল করা হয়েছে। এই হাদীস দ্বারা রসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সহজেই অনুমেয়।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইসলামকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে গোলটেবিল বৈঠকে নেতৃবৃন্দ
ময়মনসিংহে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের দুপক্ষের সংঘর্ষ, আহত ২
নকলায় নদীতে গোসল করতে নেমে শিক্ষার্থীর মৃত্যু
কাল ডিইউজে’র বার্ষিক সাধারণ সভা
ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু ১১, শনাক্ত আরও ১০৭৯
ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় মজলুম জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে : সিলেট জেলা বিএনপির সেক্রেটারি এমরান চৌধুরী
এবার কৃষ্ণসার হত্যা নিয়ে কথা বললেন সালমান খান
শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সচেতনতামূলক ট্রাফিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে-- ডিআইজি ড. আশরাফুর রহমান
চকরিয়ায় বাইক-ডাম্পার মুখোমুখি সংঘর্ষে বায়ো ফার্মার এরিয়া ম্যানেজার নিহত
প্রকাশনা জালিয়াতি করে পদোন্নতির অভিযোগ রাবি অধ্যাপক সাহালের বিরুদ্ধে
সখিপুরে পুকুরের পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু
ইবিতে র্যাগিংয়ের ঘটনা, প্রতিবেদন চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
‘মানুষ একদিন বলবে আ.লীগ নামে কোন দল ছিল না সন্ত্রাসীরাই আ.লীগ’
হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার, বরখাস্ত ডিসি মশিউর ও এডিসি জুয়েল
পান্তকে রেকর্ড দামে কিনে নিল লাক্ষ্ণৌ
তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন
বিএনপি’র জন্য ফাঁকা মাঠ এমন ভাবার কোন অবকাশ নাই: তারেক রহমান
রায়গঞ্জে বাস চাপায় ২ মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু
ঈদগাঁওতে ছোট ভাইয়ের আঘাতে বড় ভাইয়ের মৃত্যু
টেকনাফে সাগরে ভেসে যায় তিন শিশু, মৃত্যু উদ্ধার-১, নিখোঁজ দুই