মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা

Daily Inqilab মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি

১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়। কিন্তু এই বিজয়ের জন্য পথচলা ছিল কঠিন ও দুরূহ। জানতে ফিরে যেতে হবে পেছনে। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলে পাকিস্তানিরা তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় বর্বর গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ পাকিস্তানের বর্বর হানাদারদের পরাজিত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। ‘জয় বাংলা’ সেøাগানে মুখরিত হয়েছিল সারাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত ‘যৌথ বাহিনীর’ নিকট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়। এই বিজয় এক দিনে আসেনি। একটানা ৯টি মাস সশস্ত্র যুদ্ধই শুধু নয়, তারও আগে ১৯৪৮ থেকেই নিতে হয়েছে দীর্ঘ রাজনৈতিক এবং মানসিক প্রস্তুতি।

বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। পাঁচ হাজার বছর আগেও এ ভূখণ্ডের অধিবাসীদের বীরত্ব সম্পর্কে সমীহ করা হতো। মহাবীর আলেকজান্ডারের সঙ্গীরা এই বীর জাতির শৌর্যবীর্যের প্রশংসা করেছেন। আড়াই হাজার বছর আগে রোমান কবি ভার্জিলের কবিতায় গাঙ্গেয় বদ্বীপের অধিবাসীদের বীরবন্দনা প্রকাশ পেয়েছে। সেই প্রাচীনকালে বাঙালি বীর বিজয় সিংহ শ্রীলঙ্কা জয় করে দূর দেশেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের কৃতিত্ব দেখান। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে বাঙালি বার্মা এবং উত্তর আফ্রিকার রণাঙ্গনে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে তাদের বীরত্বের প্রমাণ রেখেছে। তারপরও বলা যায়, ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা এ ভূখণ্ডের মানুষের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। এদেশের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য বিদেশি হানাদাররা বারবার হানা দিয়েছে। বৈদেশিক আধিপত্যে এক পর্যায়ে বাঙালি তার স্বকীয় মর্যাদাই হারিয়ে ফেলতে বসেছিল।

বাঙালি মুসলমানদের অগ্রণী ভূমিকায় ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও শুরুতেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয় পদ্মা মেঘনা যমুনা বুড়িগঙ্গা পারের মানুষ। সংখ্যালঘু পশ্চিম পাকিস্তানিরাই এদেশের ভাগ্য-বিধাতা হয়ে ওঠে। শোষণ ও নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় বাঙালিরা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালির সাহসী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব বঙ্গের বাঙালিরা যে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পাকিস্তানি উপনিবেশের শোষণে পড়েছিল, সেটা ১৯৪৭ সালেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পাকিস্তানের নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। তৎক্ষণাৎ আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ করি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানিদের এ ইচ্ছা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জাতিকে একটু একটু করে প্রস্তুত করতে হয়েছে। এক দিনে হুট করে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে নেমে যায়নি জাতি। এ জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে রাষ্ট্র পরিচালনা, ১৯৫৬ সালে আবারও নির্বাচনে জয়লাভ, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল ল-এর বিরোধিতা, ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে অরক্ষিত রাখায় প্রতিবাদ, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ঘোষণা এবং আন্দোলন, ১৯৬৮-এর আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার, ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভের রক্তস্নাত এবং সাহসী পথ ধরেই দীর্ঘ ২১ বছরের ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের’ মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে তৈরি করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। সত্তরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতির রায় মেনে নিতে চায়নি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ১৯৭০-এর নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত বাংলার তথা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানিদের নির্বাচনে প্রদত্ত জনগণের রায় মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। ঐতিহাসিক এ জনসভায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়Ñ তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালির বুকে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র বোনা হয়ে যায় সেই দিনই। সেদিন থেকে আর বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। আর সে কারণেই ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নামে বাঙালি নিধন শুরু হলেও রুখে দাঁড়াতে সময় নেয়নি বীর বাঙালি। ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠে মুক্তির যুদ্ধে শামিল হয় সমগ্র জাতি।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভেতর দিয়েই জাতি পেয়ে যায় সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। সেদিনই স্থির হয়ে যায় বাঙালির ভাগ্য। পাকিস্তানি শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্তির পথ যেন খুঁজে পায় বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ যার ফলে আমরা দেখি একাত্তরে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরই যেন হয়ে উঠেছিল একেকটি দুর্গ। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গুটিকয়েক রাজাকার, আলবদর, জামাতি ছাড়া কাউকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয়ে যুদ্ধে গিয়েছিল বাঙালি। স্বীকার করতে হয়েছিল অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা।

একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে ‘সোনার বাংলা’ গঠন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপে সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আজ কৃষি, শিক্ষা, ক্রীড়া, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়ন, বিশ^ শান্তিরক্ষা, খাদ্য উৎপাদন, স্বাস্থ্য, তথ্য প্রযুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অনেক ক্ষেত্রেই অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।

লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বৈশাখের কালো ঘোড়া
কালবৈশাখী
বৈশাখ
আচানক এইসব দৃশ্য
ভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকিভারতীয় আধিপত্যবাদের হুমকি
আরও
X

আরও পড়ুন

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

রূপায়ণ সিটিতে শতকন্ঠে বর্ষবরণ

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

বর্ষবরণকে স্বাগত জানিয়ে গাজীপুরে জেলা বিএনপির শোভাযাত্রা

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

আমরা নতুন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছি: ফারুকী

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

ভারতীয়দের হজ কোটা ৮০ শতাংশ কমাল সৌদি

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো

চীনা দূতাবাসের সৌজন্যে ঢাকার আকাশে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো

নাসিরনগর প্রশাসনের বর্ষবরণে উপস্থাপক ছাত্রলীগ কর্মী, সাংবাদিককে এসিল্যান্ড বললেন কিছু হবে না!

নাসিরনগর প্রশাসনের বর্ষবরণে উপস্থাপক ছাত্রলীগ কর্মী, সাংবাদিককে এসিল্যান্ড বললেন কিছু হবে না!

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আহমাদ মারা গেছেন

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আহমাদ মারা গেছেন

পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতি, ভালোবাসা আর আনন্দের  প্রতীক : সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা

পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতি, ভালোবাসা আর আনন্দের প্রতীক : সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা

নববর্ষে আইন শৃঙ্খলা সুরক্ষায়  প্রশংসনীয় ভূমিকায় র‍‍্যাব - ৯

নববর্ষে আইন শৃঙ্খলা সুরক্ষায়  প্রশংসনীয় ভূমিকায় র‍‍্যাব - ৯

ছাত্রদলের সহ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করায় কুপিয়ে আহত করলো সভাপতি-সম্পাদক

ছাত্রদলের সহ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করায় কুপিয়ে আহত করলো সভাপতি-সম্পাদক

সর্বাধুনিক যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে উত্তর কোরিয়া

সর্বাধুনিক যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে উত্তর কোরিয়া

লৌহজংয়ে বিএনপির পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা

লৌহজংয়ে বিএনপির পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা

নতুন বছরের প্রথমার্ধে এর মাধ্যমে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে আসবে - প্রিন্স

নতুন বছরের প্রথমার্ধে এর মাধ্যমে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে আসবে - প্রিন্স

আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গ্রেপ্তার

আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গ্রেপ্তার

কুমিল্লায় ক্রেতা-বিক্রেতার কলরবে মুখরিত পহেলা বৈশাখের মাছের মেলা

কুমিল্লায় ক্রেতা-বিক্রেতার কলরবে মুখরিত পহেলা বৈশাখের মাছের মেলা

টানা দুই দিন সংঘর্ষ, ১৪৪ ধারা জারি রাজৈরে

টানা দুই দিন সংঘর্ষ, ১৪৪ ধারা জারি রাজৈরে

নির্বাচনের রোডম্যাপের সমাধান হবে আলোচনার মাধ্যমে: মির্জা ফখরুল

নির্বাচনের রোডম্যাপের সমাধান হবে আলোচনার মাধ্যমে: মির্জা ফখরুল

মহেশখালীতে ছাত্রলীগ নেতার হাতে বিএনপির কর্মী খুন -রাজনীতি নিয়ে কথা কাটাকাটি

মহেশখালীতে ছাত্রলীগ নেতার হাতে বিএনপির কর্মী খুন -রাজনীতি নিয়ে কথা কাটাকাটি

কিশোরগঞ্জে আনন্দ আয়োজনে বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন

কিশোরগঞ্জে আনন্দ আয়োজনে বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন

প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাহরাস্তিতে জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা আটক

প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাহরাস্তিতে জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা আটক