মক্কা বিজয়ের আদর্শ
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৩ এএম
বিজয় দিবস যে কোনো জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবের ধারক। বিজয় আসে দীর্ঘ সংগ্রাম, সাধনা ও স্বপ্নরচনার পথে বুকের তাজা রক্ত নজরানা দেয়ার পর। বিজয় দিবসকে সামনে রেখে জাতি তার অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে পারে। ভবিষ্যতে পথচলার দিক নির্দেশনা ও প্রেরণা পায়। এই প্রেরণা উৎসারিত হয় জাতীয় চেতনা, সর্বজনীন জীবনবোধ, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভান্ডার থেকে।
মহান বিজয় দিবসে পাটাতনে দাঁড়িয়ে পেছনের দিকে তাকালে আমরা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাগরবক্ষে একটি বাতিঘর দেখতে পাই। সেই বাতিঘর মুসলমান হিসেবে আমদের চেতনা, জীবনবোধ ও ঐতিহ্যের ধারক এবং ভবিষ্যতে পথ চলার আলোকবর্তিকা। সেই বাতিঘর নিঃসন্দেহে মক্কা বিজয়। মক্কাবিজয় সংঘটিত হয়েছিল হিজরি ৮ সালে। এখন ১৪৪৪ হিজরি সাল। এই ঘটনা দেড় হাজার বছর আগের হলেও সেদিন মহানবী (সা.) এর নেতৃত্বে মুসলমানগণ যে বীরত্ব, রণকৌশল, বিনয় ও শত্রুর সাথে আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তা মুসলমানদের জন্য তো বটেই, গোটা মানব জাতির জন্য অনুকরণীয় আদর্শ।
পৌত্তলিক কুরাইশদের নির্যাতনে বাধ্য হয়ে মহানবী (সা.) স্বদেশভূমি মক্কা ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছিলেন মদীনায় ৮ বছর আগে। দেশত্যাগী মুসলমান মুহাজির ও মদীনাবাসী আনসারদের নিয়ে তিনি মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মক্কার কুরাইশরা মদীনার ইসলামী শক্তিকে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য একের পর এক যুদ্ধ করে। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা-চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায় এবং ৮ হিজরির ২০ রমজান মহানবী (সা.) অসাধারণ রণকৌশল প্রয়োগ করে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন।
মক্কা বিজয় ছিল ইসলামের বিশ^বিজয়ের সূচনা। এ বিজয়ের পটভূমিতে আছে ২ বছর আগের হুদাইবিয়ার সন্ধির ঘটনা।
হিজরি ৬ষ্ঠ সালে মহানবী (সা.) ১৪শ মুসলমানকে নিয়ে কাবাঘর জিয়ারত ও উমরা পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু মক্কার কাছে হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে কুরাইশরা বাধা দেয়, মুসলমানদের মক্কা প্রবেশ করতে দেবে না। নবীজি কূটনৈতিক তৎপরতায় কুরাইশদের বুঝাতে চাইলেন, তিনি কাবাঘর জিয়ারত ও উমরা পালন করেই মদীনায় ফিরে যাবেন। কিন্তু কুরাইশরা কিছুতেই রাজি নয়। অনেক আলাপ-আলোচনার পর মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তি হয়, নাম হুদাইবিয়ার সন্ধি। সন্ধির শর্তগুলো ছিল দৃশ্যত মুসলমানদের জন্য অপমানজনক। একটি শর্ত ছিল, এ বছর উমরা না করেই মুসলমানদের মদীনায় ফিরে যেতে হবে। মুসলমানরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না এমন শর্ত। তারা নিশ্চিত ছিল, মক্কায় গিয়ে কাবাঘর তওয়াফ করতে পারবে। মহানবীর কাছ থেকে তারা সে আশ^াস পেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মহানবী (সা.) কুরাইশদের শর্ত মেনে নিয়ে ১০ বছর মেয়াদি চুক্তিতে সই করেন।
চুক্তি সম্পাদনের পর নির্দেশ দিলেন সবাই ইহরাম খুলে নাও, মাথার চুল কামাও কর, কুরবানির জন্য আনা পশুগুলো জবাই কর। কিন্তু সে আদেশ পালিত হল না। নবীজি লক্ষ করলেন, একটু আগে পর্যন্ত তার অজুর পানি, মুখের থুথুর বরকত নেয়ার জন্য যে সাহাবীরা কাড়াকাড়ি করেছে, তারাই এখন পশু কুরবানি করার নির্দেশ মানছে না। কঠিন পরিস্থিতি। তিনি মনক্ষুণ্ন হয়ে তাঁবুতে ফিরে গেলেন। সফরসঙ্গিনী উম্মে সালামার জিজ্ঞাসার জবাবে ঘটনা খুলে বললেন।
বিচক্ষণ উম্মে সালামা (সা.) ব্যাপারটি বুঝে ফেললেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি এখনই তাঁবু থেকে বের হন। কারো সাথে একটি কথাও বলবেন না। সোজা গিয়ে আপনার কুরবানির উটনি জবাই করুন। আপনার নাপিতকে ডেকে মাথা মুন্ডনের ব্যবস্থা করুন। তিনি তাই করলেন।
এ দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা নিজ নিজ পশু কুরবানি দিল, মাথা মুন্ডন করে ইহরাম খুলে ফেলল। মূলত তারা অপেক্ষায় ছিল, সন্ধির অপমানজনক শর্তগুলো হয়ত পরিবর্তন হয়ে যাবে। কিন্তু নবীজির কুরবানি এবং মাথা মুন্ডন দেখার পর তাদের সন্দেহ দূর হয়ে গেল। তাই নবীজির হুকুম পালনের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল। যে মহিয়ষী মহিলার পরামর্শে এতবড় কঠিন পরিস্থিতি শান্ত হল, সংকটের অবসান হল তিনি নবীজি (সা.) এর সহধর্মীণী আমাদের মা উম্মে সালামা (রা.)। এ ঘটনা প্রমাণ করে, মহিলারা রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টার পদে আসীন হতে পারবেন।
২১ মাস যেতে না যেতে মাথায় কুরাইশরা হুদাইবিয়ার সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন করে। কথা ছিল, কুরাইশ বা মুসলমানরা কেউ অপর পক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোনো গোত্রের উপর আগ্রাসনে সাহায্য করবে না। কিন্তু কুরাইশদের সহায়তায় তাদের মিত্র বনু বকর খোজাআ গোত্রের উপর আক্রমণ ও ব্যাপক হত্যাকান্ড চালায়। খোজাআ গোত্র ছিল মুসলমানদের মিত্র। এ ঘটনার পরপর কুরাইশরা বুঝতে পারল পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াতে পারে। পরিস্থিতির নাজুকতা আঁচ করে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মদীনায় গিয়ে হজরতের সাথে সাক্ষাত ও আলাপ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার প্রচেষ্ট ব্যার্থ হয়। বুঝতে পারেন মুসলমানরা মক্কা আক্রমণ করতে যাচ্ছে। আবু সুফিয়ান তড়িঘড়ি মক্কার পথে রওনা হন। এর পরপরই ৮ম হিজরির ১০ রমজান ১০ হাজার মুসলমানকে সাথে নিয়ে মহানবী মক্কা অভিযানে বের হন। মহানবী মক্কার জীবনে অবর্ণনীয় জুলুম নির্যাতন, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মদীনা আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে পারেÑএ আশংকায় মক্কায় তখন থমথমে আতঙ্ক।
মহানবী মক্কার উপকণ্ঠে উপনীত হলেন। তিনি এমন সব রণকৌশল গ্রহণ করলেন যাতে কুরাইশ বাহিনী ভয়ে হতভম্ভ হয়ে গেল। সামান্য প্রতিরোধ করার মনোবলও হারিয়ে ফেলল। মরুভূমির খোলা প্রান্তরে ১০ হাজার মুসলিম ফৌজের অবস্থান। নিয়ম ছিল কোনো অবস্থাতেই নিজেদের উপস্থিতি শত্রুপক্ষকে জানতে দেবে না। কিন্তু না। নবীজি নির্দেশ দিলেন রাতের খাবার দশ হাজার লোকের প্রত্যেকে আলাদা চুলায় রান্না করবে। রাতের অন্ধকারে বিশাল প্রান্তর জুড়ে থোকা থোকা আগুন জ¦লে উঠল। এতে শত্রুবাহিনীর গুপ্তচররা ভাবল, না জানি কত ফৌজ এসেছে কুরাইশদের আক্রমণ করতে। এত বিশাল বাহিনীর মোকাবিলার শক্তি মক্কাবাসীর নেই।
নবীজি আরেকটি নির্দেশ রাতের নির্দেশের বিপরীত। বললেন, সকালে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতে সৌচাগার নির্মাণ কর। সৌচাগার হবে সমান তফাতে এবং সংখ্যায় কম। ফলে সকাল থেকে সৌচাগারের জন্য মুসলমানদের দীর্ঘ লাইন। দিনের বেলার কুরাইশ গুপ্তচররা দেখে অবাক। মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা বিপুল বিশাল না হলে সৌচাগারের এত দীর্ঘ লাইন কেন। এই রিপোর্ট কুরাইশদের কাছে পৌঁছালে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বা প্রতিরোধ করার মনোবল সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে। এই দুটি রণকৌশল বিনাযুদ্ধে মক্কা বিজয়ের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছিল নিঃসন্দেহে।
এদিকে মুসলমানদের গতিবিধি নিরীক্ষণের জন্য কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান রাতে এসেছিলেন উন্মুক্ত প্রান্তরে। এক পর্যায়ে হযরতের চাচা আব্বাস (রা.) এর সঙ্গে তার সাক্ষাত হয় এবং তিনি আবু সুফিয়ানকে নবীজির কাছে নিয়ে যান। পরদিন সকালে অনেকটা বাধ্য হয়ে আবু সুফিয়ান ঈমান আনে। আব্বাস (রা.) এর প্রস্তাবে নবীজি চিরশত্রু, শত্রুবাহিনীর প্রধান আবু সুফিয়ানের প্রতি এমন সম্মান দেখালেন, যা মক্কা বিজয়কে একেবারে সহজ করে দিল। বললেন, মক্কার বাসিন্দাদের যারা কাবাঘরে প্রবেশ করবে তারা আমাদের আক্রমণের হাত থেকে নিরাপদ, যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তারাও আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে।
অতুলনীয় বীরত্ব ও রণকৌশল ব্যবহার করে ৮ হিজরির ২০ রমজান নবীজি প্রায় বিনা বাধায় মক্কায় প্রবেশ করেন। মক্কা বিজয় সূচিত হয়। তিনি কাবাঘরে রক্ষিত জাহেলী যুগের পৌত্তলিকতার প্রতীক মূর্তিগুলো ভেঙে ছুঁড়ে ফেলে দেন। মক্কাবাসীর আতঙ্ক ছিল মক্কায় থাকাকালীন ১৩ বছর মুসলমানদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের প্রতিশোধ নেয় কিনা। মহানবীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি স্বদেশ ছেড়ে মদীনায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার শাস্তি হিসেবে মক্কায় গণহত্যার নির্দেশ দেন কিনা। মদীনার জীবনের ৮ বছরে বদর, ওহুদ, আহজাবের মতো বড় বড় যুদ্ধ পরিচালনার প্রতিশোধ নিতে মক্কাকে বধ্যভূমিতে রূপান্তরিত করেন কিনা। কিন্তু মহানবী (সা.) এর কোনোটাই করলেন না। তিনি মক্কাবসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তাতে ঘোষণা করলেন, ‘লা তাসরীরা আলাইকুমুল ইয়াউম। ওয়া আন্তুম তোলাকা। আজকের দিনে তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিশোধ নেই। তোমরা সবাই মুক্ত।’ রক্তপাত এড়ানোর জন্য গৃহীত রণকৌশল এবং বিজিত জাতির উদ্দেশ্যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সেদিনের দৃষ্টান্ত দুনিয়ার মানুষের সামনে অনন্তকালের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ, মুসলমানদের জন্য সুন্নাত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের নামায, রোজা, হজ, যাকাত প্রভৃতি ধর্মীয় বিষয়কে আমরা ফরজ, ওয়াজিব বা সুন্নাত হিসেবে মান্য করা কর্তব্য মনে করি। মনে রাখতে হবে তার রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, যুদ্ধ ও দেশজয়ের সুন্নাতও আমাদের জন্য আদর্শ ও অনুসরণীয়। আজকের বিজয় দিবসে মুসলমান হিসেবে আমাদের জাতীয় জীবনে সে সুন্নাহর উজ্জীবন হোক।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ