আয়বৈষম্য বিপজ্জনক স্তরে
০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল নির্ধারিত ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটাগরি থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশের’ ক্যাটাগরিতে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং ওই প্রক্রিয়ার সফল পরিসমাপ্তির পর ২০২৬ সালে বাংলাদেশ বিশে^ একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে। গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল, আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরেও প্রবৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়েছিল। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আবার ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ২৭৬৫ ডলারে পৌঁছে গেছে বলে সরকার দাবি করেছে। অতএব, স্বীকার করতেই হবে, জিডিপি ও জিএনআই প্রবৃদ্ধিসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক সূচক গত তিন দশক ধরে সন্দেহাতীতভাবে জানান দিয়ে চলেছে যে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনুন্নয়ন ও পরনির্ভরতার ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়ে টেকসই উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে। কিন্তু মাথাপিছু জিডিপি যেহেতু একটি গড় সূচক, তাই মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে যদি দেশে আয়বন্টনে বৈষম্যও বাড়তে থাকে, তাহলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠির কাছে পুঞ্জীভূত হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে, যার ফলে নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়।
আশির দশক থেকেই এদেশে আয় ও সম্পদ বৈষম্য ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এখন বাংলাদেশ একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি বা হ্রাস পরিমাপ করার জন্য নানা পরিমাপক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে লরেঞ্জ কার্ভ এবং জিনি সহগ অন্যতম। কোন অর্থনীতির জিনি সহগ যখন দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ০.৫ এ পৌঁছে যায় বা ০.৫ অতিক্রম করে তখন নীতি-নির্ধারকদের বোঝার কথা যে আয়বৈষম্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩৬, মানে প্রচন্ড দারিদ্র্য-কবলিত দেশ হলেও ঐ পর্যায়ে এদেশে আয়বৈষম্য তুলনামূলকভাবে সহনীয় ছিল। ১৯৮৩-৪ অর্থ-বছর পর্যন্ত জিনি সহগ ০.৩৬ ছিল। এরপর আশির দশক ও নব্বই দশকে জিনি সহগ বেড়ে ২০০০ সালে তা ০.৪৫ এ পৌঁছে যায়। ২০০৫ সালে জিনি সহগ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ০.৪৬৭। ২০১০ সালেও জিনি সহগ ০.৪৬৫ এ রয়ে গিয়েছিল। ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে জিনি সহগ ০.৪৮৩ এবং ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে ০.৪৯৯ এ পৌঁছে গেছে। এর মানে বাংলাদেশ এখন উচ্চ-আয়বৈষম্যের জিনি সহগ ০.৫ এ পৌঁছে গেছে।
আরেকটি পরিমাপকের গতি-প্রকৃতির মাধ্যমে ২০১০ ও ২০২২ সালের মধ্যে আয়বৈষম্য বিপজ্জনকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠির বিপক্ষে এবং ৫-১০ শতাংশ ধনাঢ্য গোষ্ঠিগুলোর পক্ষে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি ফুটে উঠেছে: ২০১০ সালে দরিদ্রতম ৫ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ০.৭৮ শতাংশ, যা ২০২২ সালে মাত্র ০.৩৭ শতাংশে নেমে গেছে। ২০১০ সালে দরিদ্রতম ১০ শতাংশ জনসংখ্যার মোট আয় ছিল মোট জিডিপি’র ২ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা মাত্র ১.০১ শতাংশে নেমে গেছে।
সমস্যার আরেক পিঠে দেখা যাচ্ছে, দেশের ধনাঢ্য ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০১০ সালে ছিল মোট জিডিপি’র ৩৫.৮৫ শতাংশ, যা ২০২২ সালে বেড়ে ৪০.৯২ শতাংশে পৌঁছে গেছে। আরো দুঃখজনক হলো, জনগণের সবচেয়ে ধনাঢ্য ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠির দখলে ২০২২ সালে চলে গেছে মোট জিডিপি’র ৩০.০৪ শতাংশ, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪.৬১ শতাংশ। এই ধনাঢ্য সৃষ্টিকারী ও ধনাঢ্য গোষ্ঠিগুলোর দখলে জিডিপি’র ক্রমবর্ধমান অংশ পুঞ্জীভূত হতে দেওয়ার বিপদ সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর কৌশল কী ফল প্রসব করতে পারে তা নাটকীয়ভাবে ধরা পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদন ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮ এ। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ এই পাঁচ বছরে অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশে^র বড় অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে সারা বিশে^ এক নম্বর স্থানটি দখল করেছে বাংলাদেশ। ঐ পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ধনকুবেরের সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭.৩ শতাংশ হারে। ঐ গবেষণা প্রতিবেদনে ত্রিশ মিলিয়ন বা তিন কোটি ডলারের বেশি নীট-সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদেরকে ‘আল্ট্রা-হাই নেট-ওয়ার্থ ইন্ডিভিজুয়াল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
১৯৭২ সালের সংবিধানে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় চারনীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতাসীন খোন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সরকার পাকিস্তানি স্টাইলে স্বজনতোষী পুঁজিবাদ (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) প্রতিষ্ঠাকে এই রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ফিরিয়ে এনেছিল। জিয়াউর রহমান সরকারের ১৯৭৮ সালের বিনিয়োগ নীতিমালা এ-ব্যাপারে একটা মাইলস্টোন, যেখানে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য অনেকগুলো নীতি ঘোষিত হয়েছিল। ১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার প্রবর্তিত ‘নয়া শিল্প নীতি’ এবং ১৯৮৬ সালে প্রবর্তিত ‘সংশোধিত শিল্প নীতি’ ও আমদানি উদারিকরণ নীতি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের প্রয়াস। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এদেশে ‘নিউ লিবারেল’ অর্থনৈতিক সংস্কারের গতি আরো তরান্বিত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমদানি উদারীকরণের রাশ টেনে ধরার প্রয়াস নিলেও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাধানিষেধের কারণে তারা তেমন সফল হয়নি। অন্যদিকে, ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নির্বাচিত সরকার পালাক্রমে এদেশে গত ৩২ বছরের মধ্যে ৩০ বছর সরকারে আসীন থাকলেও দেশে আয়বৈষম্য নিরসনে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২০১০ সালের ঐতিহাসিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে সংবিধানে সমাজতন্ত্র ফেরত এসেছে। কিন্তু, নামকাওয়াস্তে সমাজতন্ত্রকে সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হলেও বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এ ব্যাপারে নীরবতা পালনকেই নিরাপদ মনে করছে। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি পরিবারের কথা বলা হতো, যারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ঐ ২২ পরিবারের মধ্যে দুটো পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের, তা-ও একটি ছিল অবাঙালি। ঐ বাংলাদেশেই ২০২২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব মোতাবেক ৫৪,৭২৭ জন কোটিপতি ছিল। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠির কাছে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ার বিপদ সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছে।
সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় আয়বৈষম্য বিপজ্জনক হওয়ার বিষয়টার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো: ১) দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে ১১ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যেখানে মাতাপিতার বিত্তের নিক্তিতে সন্তানের স্কুলের এবং শিক্ষার মানে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে; ২) দেশে চার ধরনের মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে; ৩) দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুরোপুরি বাজারিকরণ হয়ে গেছে; ৪) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে ্এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ৫) দেশের জায়গা-জমি, এপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচন্ডভাবে বেড়েছে; ৬) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মক ভাবে বাড়ছে; ৭) ঢাকা নগরীতে জনসংখ্যা দুই কোটি ত্রিশ লাখে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তীবাসী; ৮) দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৯) বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ১০) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ১১) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবাহ বাড়ছে; ১২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ১৩) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১৪) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; ১৫) দেশে ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ও লেভেল/এ লেভেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মোচ্ছব চলছে; ১৬) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে; এবং ১৭) দেশে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি বেড়ে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে পদে পদে। দুর্নীতিলব্ধ অর্থের সিংহভাগ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য বাড়তে থাকলে তার অবশ্যম্ভাবী অনুসঙ্গ হিসেবে সমাজে ও অর্থনীতিতে আরো অনেকগুলো ডাইমেনশনে বৈষম্য, বঞ্চনা ও স্বাধীনতাহীনতা (ঁহভৎববফড়স) চরমাকার ধারণ করে। আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘সিস্টেম’ প্রতিনিয়ত সমাজে বৈষম্য ও বঞ্চনা বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টি করে চলেছে। এর মানে, আয় ও সম্পদবৈষম্যবৃদ্ধি সফলভাবে প্রতিরোধ করতে পারলে দেশের জনগণের দারিদ্র্য নিরসন আরো বেগবান হতো, ভিয়েতনাম এবং গণচীন গত চার দশকে যেটা প্রমাণ করেছে। (অবশ্য, এসব দেশের জনগণ রাজনৈতিক স্বাধীনতাহীনতার শিকার।) দারিদ্র্য বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের গবেষণা এবং তাত্ত্বিক গবেষণার ভিত্তিতে রচিত আমার বই ঞযব চড়াবৎঃু উরংপড়ঁৎংব ধহফ চধৎঃরপরঢ়ধঃড়ৎু অপঃরড়হ জবংবধৎপয রহ ইধহমষধফবংয এ মোট ১২টি প্রধান ডাইমেনশানে বা প্রক্রিয়ায় এদেশে বৈষম্যবৃদ্ধি,বঞ্চনা ও দারিদ্র্য সৃষ্টি হচ্ছে বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই ১২ টি ডাইমেনশান হলো:
১) দারিদ্র্য সৃষ্টির প্রধান ক্ষেত্র কৃষি ব্যবস্থা (ধমৎধৎরধহ ংুংঃবস);২) ক্রমবর্ধমান বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা;৩) স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান বাজারিকরণ;৪) সরকারি রাজস্ব আহরণ ও ব্যয় ব্যবস্থার মাধ্যমে উদ্বৃত্ত আহরণ ও উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ;৫) ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণের সঞ্চয়কে উচ্চবিত্ত জনগণের খেদমতে পাচার;৬) বৈদেশিক ঋণ/অনুদান আত্মসাৎ এবং দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ;৭) কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অব্যাহত ব্যর্থতা;৮) আমদানি উদারীকরণ ও চোরাচালান এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের উপর এগুলোর মিলিত প্রভাব;৯) সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার রাজধানী-কেন্দ্রিকতা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এর ফলে সৃষ্ট বঞ্চনা;১০) স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অকার্যকরকরণ ও বি-ক্ষমতায়ন (ফরংবসঢ়ড়বিৎসবহঃ);১১) রাজনীতির দুবৃত্তায়ন; এবং১২) রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থার ব্যর্থতা (মড়াবৎহধহপব ভধরষঁৎব) এবং সুশাসনের অভাব।ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য সমস্যা মোকাবেলা করা দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের সদিচ্ছা এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন, কারণ আয় ও সম্পদ পুনর্বন্টন খুবই কঠিন রাজনৈতিক নীতি-পরিবর্তন ছাড়া অর্জন করা যায় না। সমাজের শক্তিধর ধনাঢ্য গোষ্ঠীগুলোর কায়েমী স্বার্থ আয়-পুনর্বণ্টন নীতিমালাকে ভন্ডুল করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেই। দক্ষিন কোরিয়া, তাইওয়ান, গণচীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইসরাইল এবং শ্রীলংকায় রাষ্ট্র নানারকম কার্যকর আয় পুনর্বন্টন কার্যক্রম গ্রহণ ও সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিনি সহগ বৃদ্ধিকে শ্লথ করতে বা থামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যদিও সাম্প্রতিক বিশে^ জিনি সহগ কমানোর ব্যাপারে কিউবা ছাড়া অন্য কোন উন্নয়নশীল দেশকে তেমন একটা সাফল্য অর্জন করতে দেখা যাচ্ছে না। এই দেশগুলোর মধ্যে কিউবা, গণচীন ও ভিয়েতনাম এখনো নিজেদেরকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, বাকি দেশগুলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনুসারী হয়েও শক্তিশালী বৈষম্য-নিরসন নীতিমালা গ্রহণ করে চলেছে। উপরের বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে সফল ভূমি সংস্কার এবং/অথবা কৃষি সংস্কার নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছে।
নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও জার্মানীর মত ইউরোপের কল্যাণ-রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় নীতি অনেক বেশি আয়-পুনর্বন্টনমূলক, যেখানে অত্যন্ত প্রগতিশীল আয়কর এবং সম্পত্তি করের মত প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে জিডিপি’র ৩০-৩৫ শতাংশ সরকারি রাজস্ব হিসেবে সংগ্রহ করে ঐ রাজস্ব শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা (প্রধানত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পেনশন, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও আবাসন), পরিবেশ উন্নয়ন, নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা, গণপরিবহন, বেকার ভাতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়। এই রাষ্ট্রগুলোর প্রতিরক্ষা বাহিনী, সিভিল আমলাতন্ত্র ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জন্যে সরকারি ব্যয় জিডিপি’র শতাংশ হিসেবে খুবই অনুল্লেখ্য। এই কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোতে এবং বৈষম্য-সচেতন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে কয়েকটি বিষয়ে মিল দেখা যাচ্ছে সেগুলো হলো:
১) রাষ্ট্রগুলোতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল লেভেলের শিক্ষায় একক মানসম্পন্ন, সর্বজনীন, আধুনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার ব্যাপারে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে।২) রাষ্ট্রগুলোতে অত্যন্ত সফলভাবে জনগণের সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু রয়েছে।৩) রাষ্ট্রগুলোতে প্রবীণদের পেনশন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।৪) রাষ্ট্রগুলোতে সর্বজনীন বেকার ভাতা চালু রয়েছে।৫) এসব দেশে নিম্নবিত্ত জনগণের জন্যে ভর্তুকি মূল্যে রেশন বা বিনামূল্যে খাদ্য-নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে।৬) প্রবীণ জনগণের আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্যে অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা উন্নত-উন্নয়নশীল নির্বিশেষে এসব দেশে চালু রয়েছে।৭) এসব দেশে গণপরিবহন সুলভ ও ব্যয়সাশ্রয়ী, এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হয় ।৮) এসব দেশে রাষ্ট্র ‘জিরো টলারেন্স অগ্রাধিকার’ দিয়ে দুর্নীতি দমনে কঠোর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা চালু করেছে।৯) এসব দেশ ‘মেগা-সিটি’ উন্নয়নকে সফলভাবে নিরুৎসাহিত করে চলেছে এবং গ্রাম-শহরের বৈষম্য নিরসন ও আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে খুবই মনোযোগী।১০) দেশগুলোতে ‘ন্যূনতম মজুরির হার’ নির্ধারণ করে কঠোরভাবে প্রতিপালনের ব্যবস্থা চালু রয়েছে।১১) নিম্নবিত্তদের আবাসনকে সব দেশেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।১২) এসব দেশে কৃষকরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্য দাম পান তার জন্যে কার্যকর সরকারি নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে।১৩) ব্যক্তিখাতের বিক্রেতারা যেন জনগণকে মুনাফাবাজির শিকার করতে না পারে সেজন্যে এসব দেশে রাষ্ট্র কঠোর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে।
২০১৭ সালে প্রকাশিত আমার বই ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র ও অনুন্নয়ন: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দৃষ্টিকোণ থেকে’ -এর উপসংহারে আমি বলেছি, ‘বাংলাদেশে ‘রাজনীতিক-সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট-সিভিল আমলাতন্ত্র-মুৎসুদ্দী পুঁজিপতি--এই চার গোষ্ঠীর ‘গ্র্যান্ড এলায়েন্স’ রাষ্ট্রক্ষমতাকে একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা পুঁজি আহরণের লোভনীয় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তাই, ভোটের রাজনীতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে ‘ঘুষ ও ঘুষির’ রাজত্বে পর্যবসিত হয়েছে। আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্র যে সন্ত্রাসী-মাস্তান-কালো টাকার কাছে জিম্মি হয়ে গেছে তার পেছনে রাজনীতির বৈশ্যকরণ (পড়সসবৎপরধষরুধঃরড়হ) ও দুবৃত্তায়ন (পৎরসরহধষরুধঃরড়হ) প্রক্রিয়া প্রধান ভূমিকা পালন করছে, এবং রাষ্ট্রচরিত্রই নিঃসন্দেহে তার জন্যে সঙ্ঘটক উপাদান। গ্রন্থের মূল অনুসিদ্ধান্ত হলো, রাষ্ট্রচরিত্রই বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। কারণ, এদেশের রাষ্ট্র উৎপাদনশীল জনগণের স্বার্থের পাহারাদার না হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী অধিপতি গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত উপরে উল্লিখিত ‘গ্র্যান্ড এলায়েন্সের’ অনর্জিত দুর্নীতিজাত খাজনা এবং মুনাফা আহরণের হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার পরিণামে আন্দ্রে গুন্দার ফ্রাঙ্ক কথিত ‘উদ্বৃত্ত আহরণ ও উদ্বৃত্ত আত্মসাতের’ (ংঁৎঢ়ষঁং বীঢ়ৎড়ঢ়ৎরধঃরড়হ ধহফ ংঁৎঢ়ষঁং ধঢ়ঢ়ৎড়ঢ়ৎরধঃরড়হ) প্রধান ধারাটির পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এসেমগলু ও রবিনসন এ ধরনের রাষ্ট্রকেই ‘পুঁজি লুন্ঠনমূলক রাষ্ট্র’ (বীঃৎধপঃরাব ংঃধঃব) বলে অভিহিত করেছেন।
দেশে দুর্নীতি এবং পুঁজি-লুণ্ঠন বেলাগামভাবে বেড়ে চলেছে। ফলে বৈধ অর্থনিিতর সমান্তরালে একটি কালো অর্থনীতি বিস্তার লাভ করছে। এহেন কালো অর্থনীতি ইতোমধ্যেই বৈধ অর্থনীতির ৭০-৭৫ শতাংশের মত আকার ধারণ করেছে বলে কেউ কেউ দাবি করছেন, তবে এ ধরনের দাবির সমর্থনে বিশ্বাসযোগ্য গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা দুরূহ। খ্যাতনামা বৃটিশ পত্রিকা দি ইকনমিস্ট বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকে ‘চৌর্যতন্ত্র’ (শষবঢ়ঃড়পৎধপু) নামে অভিহিত করেছে। আমি এই শাসনকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম (পৎড়হু পধঢ়রঃধষরংস) বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ’-এর ক্লাসিক নজির হিসেবে অভিহিত করে চলেছি। জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলের তিন সরকার-প্রধান এরশাদ, বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনা এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমকে লালন করে চলেছেন, যার ফলে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন, ক্ষমতাসীন দল বা জোটের নেতা-কর্মী এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা-প্রাপ্ত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, সামরিক অফিসার এবং আমলারা পুঁজি-লুণ্ঠনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ধন-সম্পদ আহরণ করতে সমর্থ হয়েছেন। ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতিরেকে এদেশে সৎভাবে ধন-সম্পদের মালিক হওয়া প্রায় অসম্ভব বিবেচিত হয়ে থাকে।
ব্যাংকঋণ লোপাট, সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদারি, বৈদেশিক ঋণের অর্থে বাস্তবায়িত উন্নয়ন-প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টতা, শেয়ার বাজার ম্যানিপুলেশান, ব্যাংকের মালিকানা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের মালিকানা, টিভি নেটওয়ার্কের মালিকানা, চোরাচালান, মুনাফাবাজি ও কালোবাজারি, আমদানি বাণিজ্য, রিয়াল এস্টেট, চাঁদাবাজি ও মাস্তানিÑ এগুলোই এদেশে দ্রুত ধন-সম্পদ আহরণের লোভনীয় ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উল্লিখিত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা সাফল্যের অপরিহার্য উপাদান। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি এদেশে ক্রমেই ‘সিস্টেমে’ পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ‘ক্লেপ্টোক্রেসি’ এবং ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ এদেশে আয়বৈষম্য এবং অন্যান্য ধরনের বৈষম্যকে ক্রমেই পর্বতপ্রমাণ করে তুলছে। লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট, সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর অর্থনীতি বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়।
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত