হুজুরকে যেমন দেখেছি
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০৭ এএম

মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বড় মাপের আলেম। ইবাদত-বন্দেগীর দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন মস্তবড় আবেদ। রাজনৈতিক দিক দিয়ে চিন্তা করলে তিনি ছিলেন উচ্চ পর্যায়ের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সামাজিকভাবে দেখলে, তিনি ছিলেন একজন সমাজ সচেতন নেতা। তাঁর আচার-আচরণ, আতিথেয়তা ছিল সম্পূর্ণ সুন্নতে রাসূল (সা.) ভরপুর।
ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষ ইন্তেকাল করলেও আমাদের কাছে চিরজীবন বেঁচে থাকবেন, তাঁর স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলো অম্লান থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। তিক্ষè মেধা আর অদম্য চিন্তার কারণেই তিনি দেশের বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে অমর হয়ে আছেন। আজ তিনি নেই, নেই শিক্ষকদের মধ্যে ঐক্য। তাঁর মতো শিক্ষক নেতা বেঁচে থাকলে হয়তো শিক্ষকরা আজ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অনশন, মানববন্ধন আর রাজপথে আন্দোলনে নামার কথা ভুলেই যেত, এসব ছাড়াই আদায় হতো সব দাবি, পূর্ণ হতো সকলের মনবাঞ্ছনা। এখনো মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর মতো একজন মহান শিক্ষক নেতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে সমগ্র শিক্ষক সমাজ।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন আলিয়া নেছাবে শিক্ষিত একজন আলেম, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও তিনি মন্ত্রণালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে ফাইলে ইংরেজিতে নোট লিখতেন। কারো জন্য কোনো সুপারিশ করলে তাও তিনি ইংরেজিতে লিখতেন। সুন্দর বাংলা লেখা ও পড়ায় ছিলেন একজন পণ্ডিত। আল্লাহপ্রেমিকদের বড় একটা গুণ হলো, সকলের সাথে সৎ ব্যবহার করা। সেই গুণে শতভাগ গুণান্নিত ছিলেন তিনি। শুধু দেশেই নয় বরং সারা বিশ্বের মুসলিম জ্ঞানী-গুণী, দার্শনিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে ছিল তাঁর বন্ধুত্ব। আমার সৌভাগ্য হয়েছে হুজুরের সাথে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি সভা-সেমিনারে যোগ দেয়ার। সে সময়ে লক্ষ করেছি, বিভিন্ন দেশের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে তাঁর সুমধুর সম্পর্ক। মনে হয়েছিল, মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) তাঁদের বহু দিনের আপন জন। লক্ষ করেছি, হুজুরও তাঁদেরকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন আপন বন্ধুর মতো। এটা ছিল মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর একটি বড়গুণ। শুধু তাই নয়, অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধানের সাথে ছিল তাঁর গভীর বন্ধুত্ব, যা দুঃসময়ে আমাদের দেশের অনেক উপকারে আসতে দেখেছি।
আমি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলে থাকি, মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর জন্ম না হলে মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস অন্য রকম হতো। মাওলানা হুজুরের সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফসল আজকের পুনর্গঠিত জমিয়াতুল মোদার্রেছীন তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৯৭৬ সাল থেকে দেশের বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অরাজনৈতিক বৃহত্তর প্লাটফর্ম তিলে তিলে আজকের এ অবস্থানে এসেছে। এর একমাত্র কৃতিত্বের দাবিদার হুজুর। তিনি অনুভব করেছিলেন, অবহেলিত ও বঞ্চিত এ সমাজকে বঞ্চনা ও অবহেলা থেকে মুক্ত করে সমাজ ও দেশ উন্নয়নের কাজে লাগাতে হবে এবং আগত আলেম সমাজকে কুরআন, হাদিস, ফিক্হ, তাসাওফ শিক্ষার সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী করে গড়ে তুলতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই তিনি দেশের সেরা আলেম ওলামা, পীর-মাশায়েখকে নিয়ে বড় বড় সম্মেলন, সভা, সেমিনার করেছেন। কার্যত তিনিই মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রমে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীরা কুরআন, হাদিস, আরবি, ফিক্হ, আকায়েদ, ইসলামের ইতিহাস, তাসাওফসহ ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাথে তথ্য ও প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, পৌরনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা শিক্ষাসহ সকল বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা নীতি-নৈতিকতার সাথে দেশ ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও এ দেশের আলেম-ওলামা বিশেষ করে মাদরাসা শিক্ষার কল্যাণে ব্যয় করেছেন। আজ মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ইহজগতে নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর হাতে গড়া প্রাণপ্রিয় সংগঠন। তাঁর ইন্তেকালের পূর্বমুহূর্তে এ সংগঠন ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র হয়েছে বেশ পরিকল্পিতভাবে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে আল্লাহর ওলীগণের হাতে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনের তিলমাত্র ক্ষতি হয়নি। আজ বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন তাঁর সুযোগ্য সন্তান আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ এবং জাতীয় পর্যায়ের বৃহত্তম সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছে।
ছাত্রজীবন থেকে অনেক দিন আল্লাহপাক আমাকে মাওলানা হুজুরের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ দিয়েছিলেন। সেই সুবাধে হুজুরকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। দেশে-বিদেশে অনেক সভা, সেমিনার, সম্মেলন ছাড়াও হজে সফর সঙ্গী হয়ে কাছে থেকে তাঁকে দেখেছি। আজকের দিনে আমি ভীষণভাবে তাঁর শূন্যতা অনুভব করছি। তিনি ছিলেন দেশের উচ্চ পর্যায়ের ধর্মীয় পণ্ডিত, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখের প্রিয়পাত্র। আমি দেখেছি, ছারছীনা দরবারের মরহুম পীর সাহেব কেবলা শাহ্ আবু জাফর মো. ছালেহ (রহ.) হুজুরকে আপন সন্তানের মতই ভালবাসতেন। মরহুম আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী (রহ.), মরহুম ফজলুল করিম (রহ.), পীর সাহেব চরমোনাই, মরহুম পীর সাহেব সোনাকান্দা, পীর সাহেব মশুরীখোলা, পীর সাহেব ধামতী, পীর সাহেব মৌকারা, আজিমপুর দরবার শরিফসহ অগণিত দরবারের পীর সাহেবদের সাথে তাঁর গভীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। আলেমদের মধ্যে মরহুম মাওলানা আমিনুল ইসলাম, মরহুম শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.), মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মরহুম মাওলানা নূরুল ইসলাম হাসেমী, মরহুম মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ.), মরহুম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন আক্তার, মরহুম মাওলানা মুফতী আমিনী (রহ.), মরহুম মাওলানা শামছুল হক (রহ.), মরহুম মাওলানা আজিজুর রহমান নেছারাবাদী (রহ.) সহ অসংখ্য আলেম-ওলামার যাতায়াত ছিল। গাউছুল আজম কমপ্লেক্সে সর্বদাই হুজুর সকলের দুঃখ-সুখের খোঁজ খবর নিতেন।
তাদের সান্নিধ্য পেলে আতিথেয়তায় মুগ্ধ করতেন সকলকে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের অধিকার আদায়ে তিনি গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। সেই সুবাধে দেখেছি, শিক্ষক নেতা মরহুম অধ্যক্ষ শহীদুল্লাহ, মরহুম আলী রেজা, মরহুম আব্দুল খালেক, মরহুম তোফায়েল আহমদ, মরহুম আমান উল্লাহ, মরহুম শরীফুল ইসলাম, মরহুম অধ্যক্ষ মোকাররম হোসেন, কাজী ফারুক আহমদ, অধ্যক্ষ আসাদুল হকসহ অনেকে হুজুরের সংস্পর্শে আসতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করতেন। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর নিকট নিরাপদ স্থান মনে করে দলমত নির্বিশেষে সকলেই আসতেন। এমনকি সে সময়ের ডান-বাম ঘরাণার রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী ব্যক্তিবর্গকেও দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা হুজুরের সান্নিধ্যে এসে হাসিমুখে বিদায় নিতে। এক কথায় বলা যায়, মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) ছিলেন সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষের অত্যন্ত আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব।
আজ অনেকেই বলেন, মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) অনেক ক্ষমতার অধিকারী থেকেও কেন তিনি কিছু মাদরাসা সরকারিকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেননি? আমাদের কিছু শিক্ষকও এই ধরনের প্রশ্ন করেন। আসলে হুজুর ইচ্ছা করলে তখন কিছু মাদরাসা সরকারিকরণ করতে পারতেন। এবিষয়ে আমি হুজুরের কাছ থেকে তাঁর বক্তব্য, বিবৃতি থেকে যা দেখেছি তাহলো, হুজুর বলতেন, কিছু মাদরাসা যদি সরকারি হয়, তাহলে সকল মাদরাসায় এর প্রভাব পড়বে। কিছু মাদরাসা সরকারি হলে ইল্ম-আমল নষ্ট হবে, সাথে সাথে বাকি বেসরকারি মাদরাসাগুলো ধ্বংসের দারপ্রান্তে চলে যাবে। সত্যিই আজ দেশে তিনটি সরকারি মাদরাসাই তার স্বাক্ষী। মরহুম হুজুরের চিন্তা ছিল সকল মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের একশত ভাগ বেতন-ভাতা পর্যায়ক্রমে এনে দিয়ে শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ করা। সেই দর্শন থেকেই এক দাবি হচ্ছে বেসরকারি সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে। মরহুম হুজুরের স্বপ্নসাধ ও দর্শন নিয়েই আজ তাঁরই সন্তানের নেতৃত্বে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও মাদরাসা শিক্ষকদের প্রাণের দাবি আদায়ে সকলেই ঐক্যবদ্ধ। আমাদের কর্তব্য হবে, মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.) এর প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে সকল ভেদাভেদ ও মতপার্থক্য ভুলে দেশের সকল শিক্ষক-কর্মচারী, দরবার, খানকা, পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামা, ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

লৌহজংয়ে বিএনপির পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা

নতুন বছরের প্রথমার্ধে এর মাধ্যমে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরে আসবে - প্রিন্স

আন্দোলনে গুলি চালানোর নির্দেশ, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গ্রেপ্তার

কুমিল্লায় ক্রেতা-বিক্রেতার কলরবে মুখরিত পহেলা বৈশাখের মাছের মেলা

টানা দুই দিন সংঘর্ষ, ১৪৪ ধারা জারি রাজৈরে

নির্বাচনের রোডম্যাপের সমাধান হবে আলোচনার মাধ্যমে: মির্জা ফখরুল

মহেশখালীতে ছাত্রলীগ নেতার হাতে বিএনপির কর্মী খুন -রাজনীতি নিয়ে কথা কাটাকাটি

কিশোরগঞ্জে আনন্দ আয়োজনে বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন

প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাহরাস্তিতে জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা আটক

সুনামগঞ্জে নানান আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন

আটঘরায় সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক নিহত আহত ২ জন

নববর্ষে বিএনপির আকাঙ্খা দ্রুত ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া-কাজী শিপন

ইসরায়ীলের সুবিধাভোগী ছিল স্বৈরাচারী আ‘লীগ- নববর্ষে বিএনপি নেতা মাহবুব চৌধুরী

ড. ইউনূসের অনাড়ম্বর আয়োজনে নববর্ষের শুভেচ্ছা, মুগ্ধ নেটিজেনরা

দুমকীতে কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে গাছ উপরে পড়ে আহত-২

দুই পক্ষের সংঘর্ষে এএসপিসহ অর্ধশত আহত, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ

ভারতীয় দুম্বা এবং ছাগল আটক করলো সিলেট বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়ন

মাগুরার শ্রীপুরে যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার

মনোহরগঞ্জে মাদরাসার ছাদে শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার

দুই পক্ষের সংঘর্ষে এএসপিসহ অর্ধশত আহত, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ