মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ : এক সব্যসাচীর প্রতিকৃতি
২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম
কবিতা সবময়ই বিবর্তনশীল। কবিতার স্থিরাবস্থা বলে কিছু নেই। চর্যাপদের কবিরা যে-পদ্ধতি ও ভাষায় বাংলা কবিতার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, মধ্যযুগের কবিরা সে-রাস্তায় ছিলেন না কখনও। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, সৈয়দ আলাওল, শাহ মহম্মদ সগীর হয়ে বাংলা কবিতা প্রথম আধুনিকতার পথে এসে প্রবেশ করে মধুসূদনের যুগে। মধুসূদনই বাংলা ভাষার প্রথম কবি, যিনি বাংলা কবিতায় আধুনিকতার বীজটি রোপন করেন। বাংলা কবিতার প্রকৃত মুক্তিদাতা মধুসূদন। কেবল কবিতা নয়, বাংলা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখাই তাঁর হাত দিয়ে উৎপত্তি লাভ করে বাংলা ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল তাঁর দুই সফল উত্তরসূরী। বাংলা কবিতা সত্যিকার অর্থে মহীরূহের রূপ ধারণ করে এই দুই কবির হাতে। তিরিশের কিছু কবি ইউরোপের চিন্তাচেতনা তাঁদের কাব্যে আমদানি করে রবীন্দ্র-নজরুল থেকে নিজেদেরকে পৃথক করে ফেলার চেষ্টা করেন। আধুনিক জীবনবোধ তাঁদের কবিতায় ঠাঁই পেলেও ভাষার পোশাকি আধুনিকতা উপহার দিতে পারেননি তাঁরা বাংলা কবিতাকে। বাংলা কবিতা পোশাকে ও মননে পুরোপুরি আধুনিক হয়ে উঠতে থাকে চল্লিশের দশকে, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, ফররুখ আহমদ, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ কবির হাতে। পঞ্চাশের কিছু কবি এর পরিপূর্ণতা দান করেন। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, এসব কবির কয়েকজন।
এঁদের মধ্যে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ ছিলেন একজন সব্যসাচী লেখক। কবি, প্রাবন্ধিক, শিশু সাহিত্যিক, সাহিত্যসমালোচক, গবেষক ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি সমানভাবে খ্যাত। বিরলপ্রজ এ লেখক ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ থাকলেও মূলত কবি হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তিনি। কাব্য-স্বভাবে তিনি ছিলেন রোমান্টিক। প্রেম, প্রকৃতি, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ তাঁর কবিতার মূল চারিত্র্য। পাঁচ দশকের অধিক সময় তিনি নিয়োজিত ছিলেন কাব্যসাধনায়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কবিতার সঙ্গে তিনি অটুট রেখেছিলেন তাঁর সম্পর্ক। একথা তিনি অবলীলায় প্রকাশ করেছেন তাঁর এক কবিতায় এভাবে:
পঞ্চাশ বছর ধরে লেখনীর সঙ্গে করি বাস
সঙ্গছাড়া হই তার তেমন মেলেনি অবকাশ।
একাত্ম সে আজীবন আমার সত্তার সঙ্গে লীন
আমৃত্যু সে রয়ে যাবে পৃথিবীতে আছি যতদিন।
(স্বগত সংলাপ)
জুলেখার মন (১৯৫৯) কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতার অঙ্গনে তাঁর উত্থান ঘটে। প্রথম কাব্যগ্রন্থই তাঁকে পঞ্চাশের অন্যতম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ অন্ধকারে একা প্রকাশিত হয় পরবর্তী দশকে ১৯৬৬ সালে। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় রক্তিম হৃদয়; আপন ভুবনে ১৯৭৪ এবং বৈরিতার হাতে বন্দী
১৯৯৬ সালে। বিপুল কবিতা তিনি হয়তো লেখেননি। কিন্তু যতটুকু লিখেছেন, লিখেছেন শিল্পের মাপকাঠিতে। ফলে তাঁর সব কবিতা, সব সময় উৎকৃষ্ট হয়ে উঠতে না পারলেও, একেবারে ফেলনা মনে হবে না কারো কাছে। নিসর্গ, প্রেম ও দেশমাতৃকা তাঁর কবিতার অনিবার্য বিষয়। তাঁর কাব্যের শান্ত শীতল সৌন্দর্যের পেলবতা আমাদেরকে বিমুগ্ধ না করে পারে না যখন তিনি এভাবে বলেন:
নিসর্গ যখন ডাকে, রক্তের ধ্বনির মতো আসে
তার মৃদৃ আবাহন; মঝে মাঝে বিষণ্ন আবেশে
উতল আবেগ নিয়ে, প্রাণের প্রতীকে কথা কয়
জানে না সে হলো কিংবা হলো না সময়,
প্রেম তার মজে গিয়ে ঘর ছেড়ে নিসর্গ বাউল
আপন ইচ্ছায় সেও ফুটাবে সুরের শুভ্র ফুল।
(নিসর্গ বাউল)
খাঁটি কবিরা সব সময়ই দেশপ্রেমিক হয়ে থাকেন। দেশ না থাকলে ভাষা থাকে না, কবিতার অস্তিত্বও থাকে না। তিরিশের কবিদের বড় সমস্যা ছিলো তাঁদের কোনো দেশ ছিলো না, একমাত্র জীবনানন্দ দাশ ছাড়া; মনেপ্রাণে তাঁরা ছিলেন ইউরোপিয়ান, ইউরোপের কবিদেরকেই বুকে ধারণ করে, অনেকটা পরগাছার মতো, টিকে থাকতে চেয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে। চল্লিশ ও পঞ্চাশের কবিরা এই ভুলটা করেননি। তাঁরা স্বদেশের বুকে নিজেদের ঠিকানা রচনা করেই তবে ব্রতী হয়েছিলেন শিল্পের সাধনায়। মাহফুজউল্লাহর কবিতার মধ্যেও আমরা দেখতে পাই নিখাঁদ দেশপ্রেমের ঘনঘটা। তীব্র দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে, এরকম একটি কবিতা তাঁর ‘সকল দেশের সেরা’। দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের দেশাত্মবোধক গানের ছায়া তাঁর এ কবিতার উপর পতিত হলেও কবি মাহফুজউল্লাহ তাঁর স্বকীয়তা দিয়ে একটি আলাদা কাব্য-মেজাজ তুলে ধরতে পেরেছেন এখানে:
সকল দেশের সেরা এই দেশ এই নদী জল;
আমৃত্যু আমার চোখে বাঁধা এর স্বপ্ন ভালবাসা
বিচিত্র দেশের মাটির রহস্যের অসীম কুয়াশা
ঘেরা আছে চারিদিকে;
(সকল দেশের সেরা)
একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ এক জটিল সময়ের কবি। রাজনৈতিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতার স্পৃহা, রক্তাক্ত গণআন্দোলন, সামরিক স্বৈরাচারের ভয়ঙ্কর থাবা প্রভৃতির ছায়াতলে বেড়ে ওঠে তাঁর কবি-মানস। তাই তাঁর কবিতার ভাষা কখনও কখনও তীর্যকও হয়ে ওঠে যখন তিনি সোশ্যাল-ক্রিটিক হয়ে আবির্ভূত হন কবিতায়। তাঁকে তখন ইয়েটস-এর মতো পোড় খাওয়া জীবন-দর্শনের ভাষ্যকার হয়ে ঊঠতে দেখি। তাই তিনি এভাবে অবলীলায় বলে উঠতে পারেন:
প্রাজ্ঞজনের চেয়েও প্রাজ্ঞ ভেবে
রাজা ও উজির মেরেছি চতুর্দিকে
জানতাম না তো বয়স এ দাদ নেবে
রঙরেজ যত একদিন হবে ফিকে
(বৃদ্ধজনের প্রার্থনা)
ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের পাশাপাশি এ কবিতার মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয় মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সুনিপুণ ব্যবহার, যা আরও শোভামন্ডিত হয়ে উঠেছে চমৎকার অন্তমিলের কারণে। পঞ্চাশের সবচেয়ে ছন্দ-সচেতন কবি ছিলেন শামসুর রাহমান; দ্বিতীয় স্থানটি বোধহয় মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর। পঞ্চাশের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ বাংলা কবিতার ছন্দ শেখার জন্য দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁর কাছে। ছন্দ নিয়ে মাহফুজউল্লাহর আগ্রহ ও গবেষণা ছিলো সার্বক্ষণিক। তাঁর কবিতাগুলো এর সাক্ষী হয়ে আছে। অন্তমিলসমৃদ্ধ কবিতাতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন বেশি। ২২ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত ছন্দ ও প্রতি চরণ শেষে অন্তমিল প্রয়োগ করেও উৎকৃষ্ট আধুনিক কবিতা রচনা করতে পেরেছেন তিনি খুব সহজভাবেই, যা প্রমাণ করে যে, বাংলা ছন্দে তাঁর বিচরণ ছিলো সহজাত। উদাহরণ দেওয়া যায়:
তোমার আনন্দ নেই, দুঃখ নেই, আছে শুধু শক্তি উপেক্ষার
অপ্রকাশ বেদনার জ্বালা নেই, প্রকাশ করো না কিছু তার
হয়তো নীরব থাকো সে কারণে কোনো কিছু উচ্চারিত হয় না কখনো
আনন্দ কি বেদনার কোনো কথা, নিজেই কি অন্তরালে শোনো
হৃদয়-গভীরে কান পেতে রেখে অবিরাম অন্তরের ভাষা
কি রূপে ধ্বনিত হয় আশা কিংবা গাঢ় কোনো অনন্ত হতাশা
এর কোনো কিছুতেই কখনো যে তোমার জাগে না মনস্তাপ
(দ্বিতীয় সত্তার প্রতি)
মূলত ছান্দসিক কবি মাহফুজউল্লাহ তাঁর সময়কে বাঁধতে চেয়েছিলেন ছন্দের শৃঙ্খলে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, ছন্দ কবিতার জন্য অপরিহার্য বটে, কিন্তু কেবল ছন্দের কারণে কেউ অমর কবি হয় না; কবিরা অমর হন কবিতায় নিহিত অমর বার্তার কারণে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে ছন্দের জাদুকর বলা হয় বটে, কিন্তু কবিতা তাঁর বড় হালকা; ফলে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের মতো বড় কবি হওয়া অদৃষ্টে জোটেনি তাঁর। এদিক দিয়ে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহও তাঁর দশকের সেরা দুই কবি আল মাহমুদ ও শামসুর রাহমান থেকে কিছুটা পিছিয়েই আছেন বলা যায়।
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ তাঁর সময়ের একজন উৎকৃষ্ট সাহিত্য সমালোচকও। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য, প্রাক-আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাঁর গবেষণাকর্ম বিশেষ মূল্যের দাবি রাখে। মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অত্যন্ত মূল্যবান কাজ করেছেন তিনি । তাঁর মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থটি বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। তবে তিনি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে। আধুনিক কালে নজরুলের উপর গবেষণা করে যাঁরা বিখ্যাত হয়েছেন তাঁদের একজন মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। অন্য তিন জন হলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিকুল ইসলাম ও শাহাবুদ্দীন আহমদ। নজরুলের উপর তাঁর আকর গ্রন্থ নজরুলকাব্যের শিল্পরূপ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে, বাংলা একাডেমী থেকে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম যুগস্রষ্টা, বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি নজরুলের জীবন, সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্প-সংস্কৃতিতে তাঁর অপরিসীম অবদান সম্পর্কে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ যে-মূল্যায়ন করেছেন তা তাঁর অকৃত্রিম নজরুল-প্রেমের ফসল। নজরুলকাব্যের ভাষা, ছন্দ, অলংকার ও নন্দনতাত্ত্বিক দিকসমূহ বিশদভাবে তুলে ধরে নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে তিনি আজীবন সচেষ্ট থেকেছেন। নজরুল সমালোচনার ধারা ও দিগন্তকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন তাঁর অমূল্য লেখনির দ্বারা।
প্রকৃত অর্থে, একটি বৃহৎ হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন কবি মাহফুজউল্লাহ। ফররুখ আহমদের দুর্দিনে যে-দুজন মহৎপ্রাণ লেখক কলম ধরেছিলেন কবির অনুকূলে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে, তাঁদের একজন মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ,, অন্য জন আহমদ ছফা। ফররুখ আহমদ যে একজন মৌলিক কবি, বাংলা ভাষায় একটি স্বতন্ত্র কবিকণ্ঠ ফররুখ, তা তিনি নানা বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর লেখায়। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে, আশির দশকে ফররুখকে নিয়ে যখন আলোচনার ঝড় ওঠে সারাদেশে, ফররুখ আবার স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত হন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র, ফররুখের নামে নানা একাডেমি ও সংগঠন গড়ে ওঠে এবং ফররুখের উপর পত্রপত্রিকা বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশে উন্মুখ তখন কিন্তু অনেকেই ভুলে যান ফররুখের জন্যে কলম নিয়ে যুদ্ধ করা এ দুঃসাহসী মানুষটিকে। আমি তখন পাক্ষিক পালাবদল পত্রিকায়। ফররুখের কবিতার উপর একটি প্রবন্ধ চেয়ে আমি একবার ফোন দেই কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহকে। ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে জানান যে, ফররুখকে নিয়ে আয়োজিত সভা-সেমিনারে তাঁকে কেউ ডাকেনই তো না, বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য পত্রপত্রিকা থেকে কেউ লেখাও চেয়ে পাঠান না। অথচ এ ব্যক্তিটিই প্রথম কলম ধরেছিলেন ফররুখের জন্যে। কেবল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও ফররুখ নয়, তিনি কলম ধরেছেন অন্যান্য কবিদের জন্যেও। লিখেছেন গোলাম মোস্তফা (১৯৮৭) ও সূফী মোতাহার হোসেন (১৯৮৮) নামে দুটি জীবনীগ্রন্থ। রেখাচিত্র: যাঁদের হারিয়ে খুঁজি তাঁর আরেকটি মূল্যবান গ্রন্থ, যেখানে রয়েছে ১৩৬ জন কবি-সাহিত্যিকের জীবন-স্মৃতি।
সাহিত্যের নানা শাখা নিয়ে কাজ করলেও মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর মূল জগৎ ছিলো কবিতা। তিনি মনে করতেন, মানুষের অভিজ্ঞতাই কবিতার উপাদান। কবিতা নিয়ে তাঁর ভাবনার অন্ত ছিলো না। শুদ্ধ কবিতার প্রকার-প্রকরণ নিয়ে তিনি অনেক প্রবন্ধও লিখেছেন। ‘কবিতা ও প্রসঙ্গকথা’ তাঁর এমনই একটি প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধের শেষ অংশটুকু ধারণ করে আছে কবিতা সম্বন্ধে তাঁর ধারণার সারৎসার। তিনি বলেন: ‘কবিতায় এবং ব্যাপক অর্থে সাহিত্য-শিল্পে পাঠক সাধারণত তার চেনা জীবনের ছবিই খুঁজে ফেরে...। এ কারণেই কবিকে অতীতপরিক্রমা এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের জগতে পরিভ্রমণ করেও শেষপর্যন্ত বর্তমানের পটে, চেনা পরিমণ্ডলেই ফিরে আসতে হয়, নামতে হয় নিজস্ব স্বাদেশিক পটভূমিকায়। ...তাই যে-কবিতা অনুবাদেও এসব বৈশিষ্ট্য হারায় না, ব্যক্তিমন ও সামাজিক-দৈশিক মনের পটে উজ্জ্বল হয়ে ফোটে, আপন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে বিদেশীদের কাছে গভীর ও অনিন্দ্যরূপে তুলে ধরে, সে-কবিতাই দেশকালের সীমা পেরিয়ে সার্বজনীনতার ব্যাপ্তি পায়, মহৎ সাহিত্য-কীর্তিরূপে নন্দিত হয়।’ কতই না গুরুত্বপূর্ণ এ উক্তিগুলো তরুণ কবিদের জন্যে!
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর সাথে আমার শেষ কথা হয় সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে। আমার দেশ-এ প্রকাশিত আমার একটি সনেট , ‘মসলিন’, নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন তিনি। কবিতাটি আমার কপোতাক্ষ পাড়ের রোদ্দুর (২০১২) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিষয়টি আমাকে অভিভূত করে এ কারণে যে, বয়োজ্যেষ্ঠ কবিরা সাধারণত তরুণ কবিদের কবিতা পড়েন না বলে শুনে এসেছি এতকাল। এর ব্যতিক্রমও যে আছে, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ কবি আল মাহমুদ ও মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। ‘মসলিন’ যে একটি চমৎকার দেশপ্রেম, দ্রোহ ও শ্লেষের কবিতা হতে পেরেছে, তাঁর মতো একজন কবির কাছ থেকে তা জানতে পেরে বাকহারা হয়ে যাই আমি। তিনি এর প্রথম স্তবকটি:
ঢাকার সে তাঁতিদের কব্জিকাটা হাতের কসম
এবং কসম সেই কসাইয়ের বর্বর ছুরির,
সীমারের মতো যার বক্ষদেশে ছিলো না পশম,
শোণিতে ভিজিয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা-তুরাগের তীর।
(মসলিন, কপোতাক্ষ পাড়ের রোদ্দুর)
শুনিয়ে আমাকে বলেন, ‘আসল কবিতার আওয়াজই এরকম, আপনি কবিতা কী জিনিস তা বোঝেন।’ তরুণদেরকে উৎসাহিত করার মতো গুণীকবির আজ বড্ড অভাব এদেশে। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর মতো কবিদেরকে তাই সহজেই ভুলে যাওয়া খুব মুশকিল।
সাহিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি কয়েকটা। বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান ১৯৭৭ সালে, নজরুল মেমোরিয়াল এওয়ার্ড (কোলকাতা) পান ১৯৮৭ সালে এবং আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার পান ১৯৮৭ সালে। কিন্তু তাঁর মতো কবি শেষ জীবনে এসে যে-রকমটি মূল্যায়িত হওয়া উচিত ছিলো রাষ্ট্রীয়ভাবে, তা হয়নি। মারা যান তিনি অনেকটা নির্জনে-নিভৃতে। অথচ তাঁর চেয়ে শতগুণ নিম্নমানের কবিরা রাষ্ট্রযন্ত্রের আনুকূল্য পেয়ে রাজকবি সেজে বসে আছেন এদেশের সাহিত্য-অঙ্গনে। একথা আমাদের কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না যে, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহকে ভুলে যাওয়া মানে পঞ্চাশের কাব্য-আন্দোলনকে ভুলে যাওয়া। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহকে এড়িয়ে যাওয়া মানে আধুনিক বাংলা কবিতার মূল ধারাকেই এড়িয়ে যাওয়া।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও অধ্যাপক
[email protected]
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ