স্বাধীনতার দর্শন

Daily Inqilab ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব

২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:০৭ এএম

স্বাধীনতার দর্শন হলো মানবতার মুক্তির দর্শন। বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠার দর্শন। মানুষ স্বাধীন সত্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সে স্বাধীনভাবে হাসে-কাঁদে ও চলাফেরা করে। যার যা স্বভাব ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আল্লাহ সৃষ্টি করেন, সে সেই স্বভাব ও বুদ্ধিমত্তা নিয়েই চলে। কিন্তু যখন সে বড় হয় এবং তার কথা ও কর্ম সমাজে প্রভাব ফেলে, তখন স্বভাবতই তার সবকিছুতে একটা নিয়ন্ত্রণ পরিলক্ষিত হয়। সে আর মুক্ত বিহঙ্গের মতো চলতে পারে না। এই নিয়ন্ত্রণ তাকে মার্জিত করে ও সমাজে তাকে সম্মানিত করে। এই নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হ’লেই সে হয় স্বেচ্ছাচারী এবং সমাজে হয় অসম্মানিত। শৈশবের স্বেচ্ছাচারিতা গ্রহণযোগ্য ও উপভোগ্য হ’লেও পরিণত বয়সে তা হয় অগ্রহণযোগ্য। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য। স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বাধীনতার পার্থক্য এখানেই।

মানুষের এই স্বাধীনতা তার চিন্তা ও চেতনায়, কথায় ও কর্মে, পরিবারে ও সমাজে এবং পৃথিবীর সর্বত্র। যুগে যুগে মানুষের স্বাধীন চেতনা যখনই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, তখনই সে ফুঁসে উঠেছে। এটা যখন ব্যাপক রূপ নিয়েছে, তখনই রাষ্ট্র বিভক্ত হয়েছে। উপমহাদেশসহ পৃথিবীতে যেখানেই মুক্তি সংগ্রাম হয়েছে, সব জায়গায় চেতনা ছিল একটাইÑ জুলুম থেকে বাঁচা এবং নিজেদের জান-মাল ও ইজ্জতের স্বাধীনতা রক্ষা করা। স্বাধীনতার মূল দর্শন এখানেই। এই দর্শন কি বাস্তবতার মুখ দেখেছে? যাদের চেষ্টায় ও যাদের রক্তে এদেশ দু’বার স্বাধীন হয়েছে, তাদের সে স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে? নাকি নৈরাশ্যের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।

মানবজাতির এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে শেষনবী মুহাম্মাদ (সা.) এসেছিলেন মক্কায়। সকলকে তিনি দাওয়াত দিলেন আল্লাহ্র দাসত্বের প্রতি। দাওয়াত দিলেন অহির বিধানের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের। দেখা দিল প্রতিক্রিয়া। অপবাদ ও নির্যাতন শুরু হয়ে গেল তাঁর ও তাঁর সাথীদের উপর। নির্যাতিত সাহাবী খাব্বাব ইবনুল আরাত একদিন এসে কা‘বা চত্বরে শায়িত চিন্তান্বিত রাসূল (সা.)কে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি কি আমাদের জন্য দো‘আ করবেন না? তখন রাগে অগ্নিশর্মা রাসূল (সা.) উঠে বসে বললেন, তোমাদের পূর্বেকার লোকদের গর্তের মধ্যে ফেলে মাথা থেকে পুরা দেহ করাতে চিরে দু’ভাগ করে ফেলা হয়েছে। তবুও তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। কাউকে লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়িয়ে দেহের হাড্ডি থেকে গোশত ও শিরা ছাড়িয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। তবুও তারা তাদের দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়নি। মনে রেখ, আল্লাহ্র এই শাসন অবশ্যই পূর্ণতা লাভ করবে এবং এমন (নিরাপদ) অবস্থা আসবে যে, একজন আরোহী ইয়ামনের রাজধানী ছান‘আ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। কিন্তু কাউকে ভয় করবে না কেবল আল্লাহকে ব্যতীত এবং তার মেষপালের উপর নেকড়ের হামলার ভয় ব্যতীত’ (বুখারী হা/৩৬১২, মিশকাত হা/৫৮৫৮)।

এই কথা যখন রাসূল (সা.) বলছেন, তখন তিনি ছিলেন মক্কায় শত্রুবেষ্টিত। তিনি ও তাঁর সাথীরা সেখানে ছিলেন সর্বদা নির্যাতিত। অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকল। সকলে একে একে মক্কা ছেড়ে হাবশা ও ইয়াছরিবে হিজরত করল। অবশেষে রাসূল (সা.) নিজেও হিজরত করলেন ইয়াছরিবে। ইয়াছরিব হলো ‘মদীনা’। মক্কার চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেকটা শান্তি এখানে। কিন্তু না। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হলো ইহুদি ও মুনাফিকদের অপতৎপরতা। আবার অস্ত্রের ঝনঝনানি। পুনরায় অশান্তি ও সেই সাথে দারিদ্র্য। একদিন জনৈক ব্যক্তি এসে তার অন্নকষ্টের অভিযোগ করল। পরে আরেকজন এসে একই অভিযোগ করল। তখন রাসুল (সা.) সেখানে উপবিষ্ট ‘আদী ইবনু হাতেমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তুমি দেখবে যে, অবস্থা এমন শান্তিময় হবে, যখন (ইরাকের) ‘হীরা’ নগরী থেকে একজন পর্দানশীন গৃহবধূ একাকী নিঃসঙ্গ অবস্থায় মক্কায় যাবে ও বায়তুল্লাহ্র ত্বাওয়াফ শেষে পুনরায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় নিরাপদে ফিরে আসবে। অথচ, সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় পাবে না। যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তুমি দেখবে যে, কিসরার ধনভাণ্ডার বিজিত হবে। যদি তোমার হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তুমি দেখবে যে, মানুষ ঘর থেকে মুঠোভর্তি স্বর্ণ ও রৌপ্য নিয়ে বের হবে, কিন্তু নেওয়ার মতো কোনো প্রার্থী খুঁজে পাবে না। রাবী ‘আদী বিন হাতেম (রা.) বলেন, পর্দানশীন কুলবধূকে আমি একাকী ‘হীরা’ থেকে মক্কায় ভ্রমণ করতে দেখেছি। কিসরার ধনভাণ্ডার বিজয়ে আমি নিজে অংশ নিয়েছি। এক্ষণে যদি তোমাদের হায়াত দীর্ঘ হয়, তবে তোমরা অবশ্যই সেটা দেখবে, যা আবুল ক্বাসেম তথা মুহাম্মাদ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, তোমরা মুঠোভর্তি স্বর্ণ-রৌপ্য নিয়ে বের হবে, অথচ প্রার্থী খুঁজে পাবে না’ (অর্থাৎ দারিদ্র্য থাকবে না)। (বুখারী হা/৩৫৯৫, মিশকাত, হা/৫৮৫৭)।

বেশি দিন লাগেনি। রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর মাত্র এক যুগের মধ্যেই ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এত বেশি অর্থ জমা হয়েছিল যে, তিনি ইসলামী খেলাফতের সর্বত্র গরিবদের তালিকা করে তাদের কাছে রাষ্ট্রীয় ভাতা পৌঁছাতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, যদি আমি বেঁচে থাকি, তবে বায়তুল মালে কোনো অর্থ আমি সঞ্চিত রাখব না। সবাইকে এমনকি ছান‘আর পাহাড়ে অবস্থানকারী মেষপালককেও আমি তার ঘরে রাষ্ট্রীয় ভাতা পৌঁছে দেব’ (আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ পৃ. ৪৬)। তিনি বলতেন, ‘যদি ফোরাত নদীর কূলে একটি বকরীর বাচ্চাও হারানো অবস্থায় মারা যায়, তাতে আমি ভয় পাই যে, সেজন্য আমাকে (ক্বিয়ামতের দিন) জিজ্ঞাসিত হ’তে হবে’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৪১৫; সনদ ‘ছহীহ লিগায়রিহী’)। অর্থাৎ শাসক প্রজাসাধারণের দ্বীন ও দুনিয়ার পাহারাদার হবেন।

ওমর (রা.) জুম‘আর খুৎবা দিচ্ছেন। এমন সময় জনৈক মুসল্লী বললেন, বায়তুল মাল থেকে সবার ভাগে যে কাপড় বণ্টিত হয়েছে, আপনার গায়ের জামা তার চেয়ে বড় দেখছি, কারণ বলুন! ওমর (রা.) তার বড় ছেলে আব্দুল্লাহ্র দিকে তাকালেন। ছেলে দাঁড়িয়ে বলল, আমার ভাগেরটা আব্বাকে দিয়েছি, যাতে ওনার গায়ের জামাটা দীর্ঘ হয়। মুসল্লী বললেন, এবার খুৎবা দিন, শুনব’ (ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কেঈন ২/১৮০)। এটাই হলো ইসলামী খেলাফতের অধীনে জনগণের বাক স্বাধীনতা ও সরকারের জবাবদিহির নমুনা।

অথচ আধুনিক যুগের শাসনে আমরা কী দেখছি? দলীয় সরকার বা দলনেতারা যাকেই বিরোধী ভাবছেন, তাকেই বঞ্চিত করছেন তার ন্যায্য অধিকার থেকে। ওএসডি ও পানিশমেন্ট ট্রান্সফারের ভয়ে আতংকিত রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্মকর্তাগণ। মানুষ কখন কার রোষানলে পড়বে, আর জবেহ হ’য়ে বা গুলি খেয়ে মরে থাকবে কিংবা কখন কার ইঙ্গিতে কাকে রাতের অন্ধকারে এসে তুলে নিয়ে গিয়ে খতম, গুম অথবা পঙ্গু করবে অথবা মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠাবে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এখন রাস্তাঘাটে তো বটেই, নিজ বাড়িতেও নারীর ইজ্জতের গ্যারান্টি নেই। অন্নকষ্টে জর্জরিত মা নিজ হাতে নিজ সন্তানকে মেরে ফেলছে ও নিজে আত্মহত্যা করছে। কেউবা সন্তান বিক্রি করছে। গুণ্ডা ও চাঁদাবাজের ভয়ে মানুষ আজ তটস্থ।

অপারেশন ক্লিনহার্ট, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ প্রভৃতি শব্দগুলি অবিচার ও মানবাধিকার ধ্বংসের প্রতীক হিসাবে থেকে যাবে বাংলাদেশে চিরদিন। তাই ‘স্বাধীনতা দিবস’ এখন আর কারো হৃদয়ে আবেগ সৃষ্টি করে না। যা কেবল টিভি পর্দায় দেখা যায়, মনের পর্দায় নয়। তবুও স্বাধীনতার চেতনা আছে, থাকবে। আল্লাহ প্রদত্ত স্বাধীনতার দর্শন থাকবে চির অম্লান, চির জাগরুক!

মানুষের স্বাধীনতার চেতনাকে বিনষ্ট করার জন্য এদেশে চালু করা হয়েছে এমনকিছু চেতনানাশক, যার প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতার নামে এক চিরঅধরা মরীচিকার পিছনে ছুটছে মানুষ। অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করলে মানুষ সাময়িকভাবে অচেতন হয়। যদি এই ঔষধ স্থানিক হয়, তাহ’লে রোগী নিজে তার দেহের কাটাছেঁড়ার সবকিছু দেখতে পায়। কিন্তু ঔষধের প্রভাবে সে ব্যথাতুর হয় না বা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। চেতনানাশক ঔষধ তৈরি হয় ফ্যাক্টরিতে, প্রয়োগ করেন চিকিৎসক এবং ব্যবহৃত হয় রোগীর উপর। রোগীই এর ভালো-মন্দ সবকিছু ভোগ করেন। দেশের জাতীয় জীবনে এমনিতরো চেতনানাশক ঔষধ তৈরি হচ্ছে হর-হামেশা, যা ব্যবহৃত হচ্ছে নিরীহ জনগণের উপর। ভোটের মওসুমে নেতারা সব পাক্কা মুসলমানী পোশাকে হাজির হন। কবরে ফাতিহা পাঠ করে নির্বাচনী সফর শুরু করেন। ‘কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোনো আইন করা হবে না’ বলে তারস্বরে ভাষণ দেন ও নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেন। ব্যস এটাতেই বাজিমাত। সরল-সিধা ভোটারগণ এতেই খুশিতে বেহুঁশ। এটাই হলো প্রথম চেতনানাশক ঔষধ, যা দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ঘুম পাড়ানো হয়। এর মাধ্যমে জননেতারা পাঁচ বছরের জন্য জনগণের উপর শাসন-শোষণ, দলীয়করণ, হামলা-মামলা ও জুলুম করার অবাধ লাইসেন্স পেয়ে যান।

দ্বিতীয় চেতনা নাশক সস্তা ট্যাবলেট হলো জঙ্গীবাদ। নেতাদের মুখে ফেনা উঠে যাচ্ছে জঙ্গীবাদ জঙ্গীবাদ করে। ফলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে এবং বিদেশে জনশক্তি রফতানিতেও ধস নেমেছে। তারা শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সর্বদা চারদিকে কেবল জঙ্গী দেখেন। নিরীহ মহিলাদের ধরে এনেও তাদের এখন জঙ্গী হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অথচ দলীয় ক্যাডাররা প্রকাশ্য দিনমানে রাজপথে প্রতিপক্ষ জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশের উপর দাঁড়িয়ে নাচানাচি করলেও ওটা জঙ্গীপনা নয়। যাত্রীবাহী বাসে ওঠে গান পাউডার ছড়িয়ে তাতে আগুন দিয়ে প্রকাশ্য দিনের বেলায় ডজন খানেক তাজা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করলেও ওরা চরমপন্থী নয়। বাস-ট্যাক্সি ও ট্রেনে ভাংচুর, লুটপাট ও আগুনে পুড়িয়ে শেষ করে দিলেও ওরা সন্ত্রাসী নয়। কারণ ওরা যে গণতন্ত্রী। অথচ হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য যে, বাংলাদেশের মানুষ কখনোই জঙ্গী, সন্ত্রাসী বা চরমপন্থী নয়। তারা সর্বদা সহনশীল ও শান্তিপ্রিয়। তাদেরকে জঙ্গী বানানোর চেতনানাশক ট্যাবলেট তৈরি হয়েছে বিদেশের কোনো গোপন ফ্যাক্টরিতে। বাস্তবায়ন হচ্ছে আমাদের দেশে নেতাদের মাধ্যমে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ইসলামই যেন এখন সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ।
ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। ইসলামী জলসা বা ওয়াজ মাহফিল করতেও সরকারের অনুমতি লাগে। ‘কোনোরূপ রাজনৈতিক কথা বলা হবে না’- মর্মে মুচলেকা দিয়েই তবে ইসলামী জলসার অনুমতি নিতে হচ্ছে। অথচ, বাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবই লেখা আছে দেশের সংবিধানে। হ্যাঁ, এগুলি প্রযোজ্য হয় কেবলমাত্র ইসলামের বিরুদ্ধে ও ইসলামী নেতাদের চরিত্র হননের ক্ষেত্রে। অথচ, সচেতন দেশপ্রেমিক মাত্রই বুঝেন যে, এ দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ আমদানির মূল হোতা হলো পাশ্চাত্যের লুটেরা পরাশক্তি ও তাদের দোসররা, যারা তাদের কথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে ইরাক ও আফগানিস্তান ধ্বংস করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের তেল লুট করা তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিক টার্গেট। ঐসব দেশের তেল-গ্যাস লুট করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে এবার তারা এদেশের তেল-গ্যাস লুণ্ঠন করতে এগিয়ে আসছে। সরকারকে বাধ্য করা হবে তাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য। নইলে সরকারের পতন ঘটাবে তারা তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে।

তারা সমুদ্রসীমার নিয়ন্ত্রণ নেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন করে ইন্দোনেশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করা পূর্ব তিমূরের ন্যায় খ্রিস্টান অধ্যুষিত একটি বাফার স্টেট বানাবে। তাই তাদের প্রয়োজন এদেশকে ‘জঙ্গী রাষ্ট্র’ অপবাদ দিয়ে সন্ত্রাস দমনের নামে এখানে এসে ঘাঁটি গাড়া। কোন স্বাধীনচেতা ও দেশপ্রেমিক নেতা ও সরকার তারা কখনোই চাইবে না। সে যুগে বৃটিশ বিরোধী জিহাদ আন্দোলন, সিপাহী আন্দোলন, ফকির বিদ্রোহ, মুহাম্মাদী আন্দোলন প্রভৃতিকে তারা সন্ত্রাসী আন্দোলন বলেছিল। এযুগে তেমনি পাশ্চাত্যের জুলুম ও শোষণ বিরোধী ইসলামী আন্দোলনকে তারা জঙ্গী আন্দোলন বলে। অথচ, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের প্রতিরোধ আন্দোলন থাকবেই। বৃটিশ ও হিন্দু জমিদারদের জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠার কারণেই উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে। যুগে যুগে সর্বত্র এটাই হয়ে থাকে।

ইসলামী আক্বীদা ও তাহযীব-তমদ্দুনের বিরুদ্ধে যখনই ষড়যন্ত্র হয়েছে, তখনই তার বিরুদ্ধে ইসলামী জনতা রুখে দাঁড়িয়েছে। আর সেটাকেই লুফে নিয়ে পাশ্চাত্য শক্তিবলয় নাম দিয়েছে টেরোরিজম বা সন্ত্রাসবাদ। জনৈক লেখক তাই যথার্থভাবেই বলেছেন, টেরোরিজম বাই দ্য ওয়েস্টার্ন, অফ দ্য ওয়েস্টার্ন, ফর দ্য ওয়েস্টার্ন। টার্গেট কেবল ইসলাম ও মুসলমান’। অতএব দেশপ্রেমিক সরকার ও জনগণ সাবধান!

চেতনানাশক তৃতীয় ট্যাবলেট হলো নারীর ক্ষমতায়ন। দেশের অর্ধেক জনশক্তি নারীজাতিকে কর্মহীন রেখে কখনোই দেশ সামনে এগোতে পারে না, একথা নেতাদের মুখে মুখে। অথচ, নারীরা যদি গৃহের দায়িত্ব না নিতেন, তাহ’লে পুরুষের পক্ষে বাইরে যাওয়া আদৌ সম্ভব ছিল না। পুরুষ বাইরে ৮ ঘণ্টা চাকরি করে হাঁপিয়ে ওঠে। অথচ, নারী তার গৃহে ২৪ ঘণ্টা কর্তব্য পালন করে। তার হিসাব কেউ করে কি? নারীর অকপট সহযোগিতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা ব্যতীত একজন পুরুষ তার ঘরে বাইরে ও কর্মজীবনে ব্যর্থ, এ বাস্তব সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারে কি? যে পুরুষ তার স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে পারে না, সে পুরুষ অপদার্থ ও পৌরুষহীন। এরাই ঘরের শোভা নারীজাতিকে পরপুরুষের সাথে কর্মস্থলে আনতে চায়, যা নারীর স্বভাবধর্মের বিরোধী। সংসার ও সন্তান পালনই নারীর প্রধান দায়িত্ব। বাকি সবই অতিরিক্ত। পর্দা ও পরিবেশ নিরংকুশ ও নিরাপদ হ’লে সুযোগমত নারী ইচ্ছা করলে বাড়তি দায়িত্ব পালন করবে, নইলে নয়।

চেতনানাশক চতুর্থ ট্যাবলেটটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। সেই সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে সারা বিশ্ব থেকে বিতাড়িত বস্তাপচা সমাজতন্ত্রবাদ। এইসব মতবাদের কথা যারা বলেন, তারা সম্ভবত এগুলির সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য কিছুই বুঝেন না। এগুলিকে বলা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাহ’লে তারা তাদের পিতা-মাতাদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের মধ্যে এইসব চেতনা ছিল কি-না? স্বয়ং শেখ মুজিব, এম.এ.জি. ওসমানী, জিয়াউর রহমান, মেজর জলিল প্রমুখ বরেণ্য নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এই চেতনা ছিল কি? তাদের কোন ভাষণ বা লেখনী উক্ত মর্মে কেউ শুনাতে বা দেখাতে পারবে কি? বরং উল্টাটাই সত্য। তার প্রমাণ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলে প্রচারিত প্রবাসী সরকারের প্রচারপত্র। যেখানে ‘আল্লাহু আকবর’ দিয়ে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে এবং শেষে বলা হয়েছে ‘সর্ব শক্তিমান আল্লাহ্র উপরে বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অবিচল থাকুন’... (মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ৩য় খণ্ড ২২ পৃ.)। এতে প্রমাণিত হয় যে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে আল্লাহ্র নামে ও তার উপর বিশ্বাস রেখে। পুরা ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের লিখিত দালিলিক ইতিহাসের কোথাও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নামগন্ধও নেই। অথচ ’৭২-এর সংবিধানে তা যোগ করা হলো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংবিধান থেকে এনে। এতে তো পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কাদের স্বার্থে এইসব বানোয়াট থিওরি আমদানি করা হয়েছে।

এক্ষণে জনগণ যদি সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক হয়, তাহ’লে জনগণের আক্বীদা-বিশ্বাসের বাইরের কোনো মতবাদ এদেশে চলবে কি? নিজেদের বানানো কি বাইরের চাপানো, তা জনগণ দেখবে না। জনগণ যখনই বুঝবে যে, বৃটিশ ও পাকিস্তানিদের মতো তাদের নির্বাচিত শাসকরাও জালেম এবং তারাও ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তখন আর কোনো কিছুরই তোয়াক্কা তারা করবে না। জনগণের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে রাশিয়া, আমেরিকা ও পুরো ইউরোপীয় শক্তি আজ লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে, এটা দেখেও কি কারো হুঁশ হবে না? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ অর্থ যদি পরধর্মসহিষ্ণুতা হয়, তা হলে ইসলামেই একমাত্র সে শিক্ষা রয়েছে। সেই শিক্ষার কারণেই বাংলাদেশে কোনো ধর্মীয় দাঙ্গা হয় না। অথচ, প্রতিবেশী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের রক্তে প্রতিনিয়ত হোলি খেলা হয়। কিন্তু যারা মরছে ওরা যে মুসলমান! তাই বিশ্ব নীরব।
অতএব, সকলের উদ্দেশ্যে আমাদের আবেদন, ইসলাম আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ দ্বীন, যা মানবজাতির কল্যাণে নাজিল হয়েছে। এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আল্লাহ বরদাশত করবেন না। ইতিপূর্বে আদ, ছামুদ, নমরূদ, ফেরাঊন সবাই ধ্বংস হয়েছে আল্লাহ্র গজবে। আমরাও সেই গজবের শিকার হব প্রধানত সমাজনেতাদের দুষ্কর্মের কারণে। অতএব, জাতিকে চেতনাশূন্য রাখার অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে।

লেখক: আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ ও প্রফেসর (অব.), আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

পানির সংকট

পানির সংকট

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

তাইওয়ান পার্লামেন্টে তুমুল মারামারি

তাইওয়ান পার্লামেন্টে তুমুল মারামারি