দুর্যোগ মোকাবিলায় টেকসই ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে
০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম | আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪, ১২:১৮ এএম
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে পরিচিত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিধস, বন্যা প্রবণতা, দারিদ্র্য ইত্যাদি নির্দেশকের উপর ভিত্তি করেই এসব জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। একাধারে হিমালয়ের বরফ গলার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততার সমস্যা, নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা ইত্যাদি দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রতিবছরই এদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। খুলনা, বরিশাল এবং চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্র তীরবর্তী জেলাসমূহে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা ও আর্সেনিক দূষণ গ্রাস করেছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চলগুলোতে প্রতি বছর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানির প্রভাবে কৃষি জমিতে লবণাক্ততার বৃদ্ধি ঘটে। উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের জেলাসমূহ ভৌগোলিকভাবে নদী বিধৌত। এসব এলাকায় প্রতি বছর বন্যা ও নদীভাঙনে ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে খরা প্রবল আকার ধারণ করে। রাজশাহী বিভাগের বেশ কিছু এলাকা আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগের পাহাড়ি এলাকাগুলোকে ভূপ্রাকৃতিক গঠন বৈচিত্র্যের কারণে ব্যাপক ভূমিধস হয়। সেইসাথে বন্যা ও ভূমিকম্প এসব এলাকার মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঢাকা বিভাগের মেঘনা নদীর উপরের জেলাসমূহ এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাসমূহ ভূপ্রাকৃতিকভাবে অনেকটা ভূমিকম্পনপ্রবণ। এসকল জেলার বাড়তি জনসংখ্যার জন্য অতিরিক্ত দালানকোঠা ও গৃহ নির্মাণের জন্য জায়গাগুলো ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া এ অঞ্চলের অধিকাংশ জেলায় শুষ্ক মৌসুমে খরা লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ দেশের প্রতিটি বিভাগের অধিকাংশ জেলা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব জেলায় ঘন ঘন সংঘটিত নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, সর্বোপরি মানুষের দৈনন্দিন জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ ১৫টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নবম স্থান সুস্পষ্ট জানান দেয় এদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে। এদেশে প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ভূমিকম্প, আর্সেনিক দূষণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনে। তবে নদীমাতৃক এই দেশের প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে বন্যা। ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্ত্বিক কাঠামো, অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত, একই সময়ে প্রধান নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি, নদীতে পলল সঞ্চয়ন, পানি নিষ্কাশনে বাধা, ভূমিকম্প, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট কারণে প্রায় প্রতি বছরই এ দেশে বন্যা হয়ে থাকে। দেশে ঘটে যাওয়া ছোট ও বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস ও কালবৈশাখীতে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। নদী ভাঙনের ফলে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। বজ্রপাত ও বর্তমান সময়ে ভয়াবহ এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা এবং বজ্রপাতে মৃত্যুর আশঙ্কা দুইটিই বেড়ে চলছে। তাপপ্রবাহ বেশি হওয়ায় চলতি বছর বেশি বজ্রপাত হওয়ার আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। গবেষণা বলছে, বজ্রপাতের কারণে বেশিরভাগ প্রাণহানি বর্ষা পূর্ববর্তী মৌসুম এবং বর্ষা ঋতুতে ঘটে। উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে আবহাওয়ার ধরন ও বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ এবং ঋতু পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটছে। এ কারণেই বজ্রপাত বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশগুলোয় বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্তর্গত। ভৌগোলিক অবস্থান দেশটিতে ব্যাপক হারে বজ্রপাতের অন্যতম কারণ। দেশটির দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আবার এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস দেশটিতে প্রবেশ করে। আবার উত্তরে আছে পাহাড়ি এলাকা এবং কিছু দূরেই আছে হিমালয়। যেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুইটা বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কারণে বাতাসে গরম ধূলিকণা বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাত বেড়ে যাচ্ছে। গবেষণা বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বজ্রপাতের আশঙ্কা বাংলাদেশেই বেশি। মেঘের সঙ্গে তাপের একটা সম্পর্ক আছে। তাপ বেশি হলে মেঘে কেমিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল প্রোপার্টি বেশি হবে। বজ্রপাতও বেশি হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্পও বাংলাদেশে বার বার আঘাত হানছে। মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে দেশে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। সেইসাথে ভূমিকম্পে অপূরণীয় ক্ষতি যেমন- বাড়িঘর, দালানকোঠা চুর্ণবিচুর্ণ হওয়া, গাছপালা ও নদীর পাড় ভেঙ্গে যাওয়া, নদীর বাঁধ জলাধার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটা, মাটিতে ফাটল, পাহাড়ি ধস, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা আছে। কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বিরতিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে কেঁপে উঠছে স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পে। এর অনেকগুলোর উৎপত্তিস্থলও দেশের ভেতরে। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ফলে এদেশেও হতে পারে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। আর তেমন কোনো ঘটনা ঘটলে পরিস্থিতি কী হবে তা কল্পনাও করা যায় না। কারণ ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ যতটুকু সক্ষমতা অর্জন করেছে, তার তুলনায় ভূমিকম্প মোকাবেলার প্রস্তুতি বা সক্ষমতা একেবারেই ক্ষীণ। রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে একেক ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন চিহ্নিত করতে সরকারের সহযোগী সংস্থাগুলোর উদ্যোগে সমন্বিত কারিগরি জরিপ করা দরকার। না হলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি এবং এর ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
বন উজাড় করাও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আরেকটি কারণ। কেননা, বনভূমি পৃথিবীর ফুসফুস। একটি দেশের প্রকৃত পরিবেশ বজায় রাখার জন্য মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। সেখানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ ১৫.৫৮ শতাংশ। বৃক্ষরাজি পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে অক্সিজেন সরবরাহ করে পরিবেশকে নির্মল ও শীতল রাখে। কিন্তু মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফলে ক্রমাগত বৃক্ষের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকায় বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন ও জলীয়বাষ্প হ্রাস পেয়ে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের রিপোর্টে বলা হয়, ২০০১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ কমেছে ৬,০৭,৬২০ একর। এ বিশাল বনভূমি বিদ্যমান থাকলে প্রায় ৭৫ মেগা টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো যেত বলে ধারণা করা হয়। ওই সময়ে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে চট্টগ্রামে (৫৭,৫৭০ একর)। বিশ্বব্যাপী বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মূলত মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজনে যত্রতত্র নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার এদেশে মানুষ বাসস্থান তৈরি করতে বৃক্ষ নিধন করছে। এছাড়া অবৈধ দখল, সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ফার্ম হাউজ, দোকান, রিসোর্ট ইত্যাদি কাজে বন উজাড় করছে। ফলে এ দেশের পরিবেশ দিন দিন চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে এবং সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহ তারই উদাহরণ।
মূলত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কিছু কারণই এ অসহনীয় তাপপ্রবাহের জন্য দায়ী। প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও জলবায়ুগত পরিবর্তন, উপমহাদেশীয় উচ্চ তাপবলয়, বৃষ্টিপাত হ্রাস এবং এল নিনোর সক্রিয়তা। তাপপ্রবাহের জন্য মানবসৃষ্ট কারণগুলোর উল্লেখযোগ্য হলো: অতিমাত্রায় বন উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ব্যাপক হারে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, উন্মুক্ত স্থানের অভাব, পুকুর-জলাশয় ভরাট, জনঘনত্ব ইত্যাদি। তাপপ্রবাহ আবহাওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়ার সত্ত্বেও ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এবারের চিত্রটি ভিন্ন মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন, সমন্বয়হীনতা, জলাশয় ও উন্মুক্তস্থান ভরাট, অতিরিক্ত যানবাহন ও জনঘনত্ব, অপরিকল্পিত স্থাপনা, সবুজের আচ্ছাদন হ্রাস, অত্যধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, ইট-কংক্রিটের অতিরিক্ত বসতি ইত্যাদি বাংলাদেশের প্রধান নগর এলাকাগুলোর অতিরিক্ত তাপমাত্রার জন্য দায়ী। নগর এলাকায় জনঘনত্ব ও আবাসিক স্থাপনার ঘনত্ব অধিক। এখানে অল্প জায়গার ভিতরে অনেক মানুষের রান্নাবান্না, চলাচলে ব্যবহৃত যানবাহন ব্যাপক আকারে বায়ুদূষক গ্যাস উৎপন্নের পাশাপাশি শহর এলাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। যানবাহনগুলোর ইঞ্জিনে ত্রুটি, মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার না করা, ফিটনেসের অভাব ইত্যাদি কারণে নগর এলাকায় এসব যানবাহন তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের নবতর সংযোজন হলো সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহ। তাপপ্রবাহজনিত এ প্রাকৃতিক পরিস্থিতি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন একটি কাজ। তবে তাপপ্রবাহজনিত হতাহত থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হয়ে শহর এলাকার সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান সমন্বয়ের মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন ও সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যাপ্ত ও সঠিক বৃক্ষের পরিমাণ বাড়াতে হবে ও সেগুলোর যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে। জনগণকে শহর এলাকার ভবনের ছাদবাগানে উৎসাহিত করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো হলেও এর ক্ষতিকর দিকগুলো গরিব দেশের উপর গিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশের জনগণের অতিমাত্রার ভোগবিলাসিতা, যন্ত্রনির্ভরশীলতার ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য সফলের জন্য পৃথিবীতে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এসব দেশের কলকারখানা ও যানবাহন থেকে অতিমাত্রায় কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে তাপমাত্রা। তাতে মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। সমুদ্র ও নদীর কম্পন বাড়ছে। ফলে নদী ও সমুদ্রের উপকূলে ভাঙনের হারও বেড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের বেশিরভাগ নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। পলি জমে বেশকিছু নদী দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। দেশের প্রধান নদীগুলো বিভিন্ন স্থানে এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ড্রেজিং করে এসব নদী মাঝেমধ্যে সচল করার ব্যবস্থা নেওয়া হলেও সেটা যথোপযুক্ত নয়। ফলে বর্ষাকালে নদীর উপচে পড়া পানি প্লাবিত করে ফসলের মাঠ ও জনবসতি। প্রতি বছরই বন্যা এদেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি রোধে পর্যাপ্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে, যতই দিন যাবে, বাংলাদেশ আরো ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে অনেক সমস্যা হবে। সমুদ্রের নোনা পানি কৃষিজমিতে ঢুকে পড়বে। জমিগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাবে। মোট ভূখণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তলিয়ে যাবে, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সুপেয় পানির অভাব, কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে এ দেশের ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বাস্তুচ্যুত এ বিপুল জনগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে শহরে এসে অপরিকল্পিত বস্তি তৈরি করবে। ফলে শহরকে বিষিয়ে তুলবে। ‘বাংলাদেশ সয়েল রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট’ এর প্রতিবেদনে জানা হয়, গত চার দশকে এ দেশের মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ প্রায় ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এভাবে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়তে থাকলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। তবে এসব বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যে উপকূলীয় সকল জেলায় শুরু হয়ে গেছে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সব কিছুর পেছনে মূল কারণ হলো জলবায়ুর পরিবর্তন।
ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব প্রকট। এই নেতিবাচক প্রভাবকে প্রশমিত করতে যথাযথ পরিকল্পনা ও কৌশল অনুসারে কাজ করতে হবে। দেশের আবহে কোনো দুর্ঘটনা বা দুর্যোগ ঘটার পরে শুরু হয় তোড়জোড়। করা হয় তদন্ত কমিটি। কোথাও কোথাও নেওয়া হয় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা। তবে তা কিছুদিনের মধ্যে ধামাচাপা পড়ে যায় আরেকটি বড় দুর্ঘটনা না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য, যেকোন দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা পরবর্তী পদক্ষেপের চেয়ে এগুলো প্রতিরোধে পূর্ববর্তী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা বুদ্ধিমানের কাজ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কলকারখানার বর্জ্য ও শহরের মল-মূত্র এবং আবর্জনা সরাসরি নদীতে না পড়ে পরিশোধন করে ফেলতে হবে। জলবায়ু দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে শিল্পকারখানার মালিক ও জনগণকে সচেতন করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে বলিষ্ঠ উদ্যোগ নিতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে এবং পাহাড়ি অঞ্চলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গাছ লাগিয়ে বনাঞ্চল গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি শহর, নগর, গ্রাম, গঞ্জ, পাড়া মহল্লায় ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণের আওতায় আনতে হবে। কৃষি জমি, জলাভূমি, পাহাড় ইত্যাদি ধ্বংস করে বসতবাড়ি বা কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে সরকারকে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। দুর্যোগ ঘটার পূর্বে জনগণকে সতর্ক করতে হবে। আবহাওয়া অফিসকে আধুনিকায়ন করে দুর্যোগ পূর্ববর্তী সঠিক, নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান করতে হবে। দুর্যোগ পূর্ববর্তী সময়ে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় মুঠোফোনে বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে জনগণকে সচেতনতাপূর্বক দুর্যোগকালীন সময়ে করণীয় বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। সম্ভাব্য দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ জায়গা, সাইক্লোন শেল্টার বা বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলায় নিয়োজিত কর্মীবাহিনীকে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে এসব কাজে ব্যয়ভার যোগানের জন্য বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার সাহায্য নিয়ে সেগুলোর সুষ্ঠু বণ্টন এবং সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
[email protected]
বিভাগ : বিশেষ সংখ্যা
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সাময়িক বন্ধের পর খুললো যমুনা ফিউচার পার্ক
জ্বালানি খাতে সাশ্রয় হয়েছে ৩৭০ কোটি টাকা: জ্বালানি উপদেষ্টা
গৌরনদীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকান ঘরে বাস নিহত-১ আহত-৬
কুড়িগ্রামের উলিপুরে ২ আ'লীগ নেতা গ্রেপ্তার
লাওসে ভেজাল মদপানে ৬ বিদেশির মৃত্যু
না.গঞ্জে ডেঙ্গু পরীক্ষার টেস্ট কিট সংকট কে কেন্দ্র করে টেস্ট বাণিজ্যের অভিযোগ
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের প্রস্তুতি
‘পতনের’ মুখে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন
বিশ্বব্যাংক আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতির প্রদর্শনী
আগামীকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না
সিলেট সীমান্তে দেড় কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ
২ মার্চকে জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির আহ্বান জানালেন মঈন খান
সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে যা বললেন বদিউল আলম
সিংগাইরে সাংবাদিক মামুনের বাবার ইন্তেকাল
বিরামপুরে ধান-ক্ষেত থেকে হাত বাধা আদিবাসী দিনমজুর মহিলার লাশ উদ্ধার!
আওয়ামী শুধু ফ্যাসিস্ট নয়, তাদের আরেকটা নাম দিয়েছি স্যাডিস্ট: মিয়া গোলাম পরওয়ার
খুবিকে ইমপ্যাক্টফুল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে সকলের সহযোগিতা কামনা
লাল পাহাড়ের দেশকে বিদায় জানিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অরুণ চক্রবর্তী
বিদেশি প্রভুদের নিয়ে বিতাড়িত স্বৈরাচার ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে: তারেক রহমান
আগামী রোববার-সোমবারও বন্ধ থাকবে ঢাকা সিটি কলেজ