সামনে নির্বাচন, কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে এরদোগান?
১৪ মার্চ ২০২৩, ১০:০৭ এএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৩২ পিএম
![](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2023March/1-20230314100754.jpg)
মসজিদ আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনারগুলো আমাদের বেয়নেট এবং বিশ্বাস হলো আমাদের সৈন্য। এই প্রচারণায় সফল হন এরদোগান এবং ২০০৩ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এর পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গত ২০ বছর ধরে তিনি দেশটির ক্ষমতায় আসীন।
যে বালক একদা রাস্তায় লেবুর শরবত আর রুটি বিক্রি করতেন, তিনিই হয়ে উঠলেন আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিক এবং যুদ্ধংদেহী এক আঞ্চলিক নেতা। তার উত্থান শুরু হয় প্রায় তিন দশক আগে ইস্তাম্বুল শহরের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
এর পরে তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী এবং দুই দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তার এই ক্ষমতা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও লড়বেন তিনি। তুরস্ক যখন বিধ্বংসী ভয়াবহ ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় মোকাবেলার চেষ্টা করছে, তখনই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে এই কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের এই ভূমিকম্পে তুরস্কে প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, গৃহহীন হয়েছে ১৫ লাখের মতো মানুষ। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে।
এছাড়াও রয়েছে তুরস্কের টালমাটাল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে মানুষের নাভিশ্বাস ওঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৬ সালে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান চেষ্টা থেকে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বেঁচে গেলেও, আসন্ন নির্বাচনে তিনি কতোটা সফল হবেন সেটা নির্ভর করছে তার সরকার কীভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে তার ওপর।
এরদোয়ানের উত্থান যেভাবে
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ও সাবেক ফুটবলার রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুল শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়ে চলে আসেন রাজনীতির সম্মুখ সারিতে।
রাজধানী আঙ্কারা থেকে সাংবাদিক সরওয়ার আলম (যিনি তুরস্কের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন) বলেন, ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা সমাধান করে তিনি প্রথমে ওই শহরে এবং পরে সারাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন।
তিনি বলেন, 'আবর্জনা সমস্যা, বিদ্যুৎ সংকট, পানির সমস্যাসহ আরও যত ধরনের সমস্যা ছিল সেগুলো সমাধানের জন্য মেয়র এরদোয়ান আন্তরিকভাবে কাজ করেন। পরবর্তীকালে তুরস্কের রাজনৈতিক সমস্যা থেকেও তিনি সুবিধা পেয়েছেন। তৎকালীন জোট সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ার পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে তিনি মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যেকোনও একটি দল এককভাবে সরকার গঠন করলে দেশকে আরও স্থিতিশীলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।'
একচ্ছত্র ক্ষমতা
দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তুরস্কের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বদলে দিয়ে আরও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন এরদোয়ান। আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পর অন্য যেকোনও নেতার চেয়ে তিনিই দেশটিকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠার সাথে সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকেও এরদোয়ান ক্রমশ দূরে সরে গেছেন।
তিনি বলেন, 'যখন তিনি দলের নেতৃত্বে আসেন, তার রাজনৈতিক আচরণে মনে হয়েছিল যে তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে চান। কিন্তু যতোই তিনি ক্ষমতার কাছাকাছি গেছেন, ততই তিনি ক্ষমতাকে এককেন্দ্রিক করেছেন। সেটা তিনি সাংবিধানিকভাবে করেছেন। প্রেসিডেন্টের হাতে সব ক্ষমতা দিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। বিচার বিভাগ, সংবাদ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেছেন। এর পাশাপাশি তিনি তুরস্কের আদর্শিক অবস্থানেও পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। জনসমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি দেশটিকে ইসলামপন্থী ধারায় পরিচালিত করেছেন।'
পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিরক্ষা জোট নেটোতে যোগ দেওয়ার জন্য সুইডেন ও ফিনল্যান্ড যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তুরস্ক তাতেও বাধা দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এরদোয়ানের এই পেশি-সুলভ কূটনীতি লক্ষ্য করা গেছে ইউরোপের বাইরেও। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তার এই সামরিক শক্তি প্রদর্শন এরদোয়ানকে দেশের ভেতরে জনপ্রিয় করেছে বলে মনে করেন আলী রীয়াজ।
সাংবাদিক সরওয়ার আলম এরদোয়ানের ২০ বছরের শাসনামলকে তিনটি ভাগে ভাগ করে তার রাজনৈতিক কৌশল ও কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, তার শাসনামলের শুরুর দিকে তুরস্কে বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল, হয়েছিল ব্যাপক উন্নয়ন। প্রথম সাত বছরে তিনি অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে জোর দিয়েছিলেন। নতুন করে রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ করেন। এসব উন্নয়নের জন্য মানুষ তাকে ভোট দিয়েছে। পরের সাত বছরে তিনি রাষ্ট্রের কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। যেমন হিজাবের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সেটা তিনি প্রত্যাহার করেন, রাষ্ট্রের ভেতরে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করার চেষ্টা করেন। আর শেষের সাত বছরে তাকে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং সবশেষে ভয়াবহ ভূমিকম্পের মুখে পড়তে হয়।'
ইসলামপন্থী রাজনীতি
মুসলিম মূল্যবোধের পক্ষে সরাসরি বক্তব্য দেওয়ার কারণেও এরদোয়ান বহু তুর্কীর কাছে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তার নেতৃত্বে ইসলামপন্থী দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা একেপি ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণকে তুষ্ট করার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করে।
চার সন্তানের পিতা এরদোয়ান জন্ম-নিয়ন্ত্রণের সমালোচনা করেন। যাদুঘর থেকে আয়া সোফিয়াকে ফের মসজিদে রূপান্তরিত করেন।
ক্ষমতায় আসার আগেও এক সমাবেশে জাতীয়তাবাদী একটি কবিতা পড়ার জন্য তার চার মাসের জেল হয়েছিল। এই কবিতার কয়েকটি লাইন ছিল এরকম, 'মসজিদ আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ আমাদের হেলমেট, মিনারগুলো আমাদের বেয়নেট এবং বিশ্বাস হলো আমাদের সৈন্য।'
ইসলামপন্থী বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি ফরাসী প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। সুইডেনে কোরান পোড়ানের ঘটনায় নরডিক ওই দেশটিকেও তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে কাশ্মির প্রসঙ্গ তুলে ভারতের সমালোচনা করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রীয়াজ বলছেন, একদিকে দেশের ভেতরে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য এবং একই সাথে তিনি যেহেতু আঞ্চলিক পর্যায়েও তুরস্কের একটা অবস্থান তৈরি করতে চান, তাই তিনি ইসলামপন্থী মনোভাব তৈরি করেছেন।
রীয়াজ বলেন, 'এটা হচ্ছে তার পপুলিস্ট এজেন্ডা। বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা বিভিন্নরকম জনতুষ্টিবাদী আদর্শকে গ্রহণ করে। জনতুষ্টিবাদী এই আদর্শের একটা রূপ থাকে। এই রূপ কোথাও জাতীয়তাবাদ, কোথাও উন্নয়ন, কোথাও ধর্ম। মি. এরদোয়ানের ইসলামপন্থী এজেন্ডা তারই একটি অংশ।'
এরদোয়ানের সামরিক পেশি
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বহির্বিশ্বের সামনেও তার সামরিক পেশিশক্তি প্রদর্শন করেছেন। লিবিয়া ও সিরিয়া যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশ নিয়েছেন। ন্যাটোর সদস্য দেশ হওয়া স্বত্বেও তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের জন্য তিনি মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়েছেন। শস্য রফতানির বিষয়ে যুদ্ধরত দুটো দেশের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতেও সফল হয়েছেন।
পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিরক্ষা জোট নেটোতে যোগ দেওয়ার জন্য সুইডেন ও ফিনল্যান্ড যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তুরস্ক তাতেও বাধা দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এরদোয়ানের এই পেশি-সুলভ কূটনীতি লক্ষ্য করা গেছে ইউরোপের বাইরেও। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তার এই সামরিক শক্তি প্রদর্শন এরদোয়ানকে দেশের ভেতরে জনপ্রিয় করেছে বলে মনে করেন আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরেই ওই অঞ্চলে তুরস্ক একটা শক্তিশালী প্রভাবশালী দেশ হয়ে উঠতে চেয়েছে। গত দুই তিন দশক যাবত ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং আঞ্চলিক দেশগুলো ওই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। এরা হচ্ছে ইরান, সৌদি আরব এবং তুরস্ক। এরদোয়ান সেখানে নিজের একটা জায়গা তৈরি করেছেন। এই শক্তি অর্জন করতে গিয়ে তিনি কৌশল অবলম্বন করেছেন।'
ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ও বিরোধী দমন
এরদোয়ানের জন্য ২০১৬ সাল ছিল এক কঠিন বছর। দুই দশকের শাসনামলে এটাই ছিল তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ এসেছিল সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে যারা তুরস্ককে কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। তুর্কী সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এতে নিহত হয় ৩০০ জনের মতো।
এরপরই বিরোধীদের ওপর শুরু হয় ব্যাপক দমন অভিযান। রাজনীতিক ও সাংবাদিকসহ ৫০ হাজারেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়। চাকরীচ্যুত হন প্রায় দেড় লাখ সৈনিক, সরকারি চাকুরীজীবী, শিক্ষক, পুলিশ অফিসার ও বিচারক। যুক্তরাষ্ট্রে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রীয়াজ বলছেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই অভিযান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে দৃশ্যত আরও শক্তিশালী করেছে।
তিনি বলেন, 'শুধু সেনাবাহিনী নয়, সমাজের ভেতরে তিনি এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যে তার বিরুদ্ধে কথা বলা বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী দলগুলোকে তিনি বিপর্যস্ত করে ফেলতে পেরেছেন। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছেন। এসব তার কর্তৃত্ববাদী এজেন্ডারই অংশ।'
টালমাটাল অর্থনীতি ও ভূমিকম্প
নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা হলো সাধারণ মানুষের ক্ষোভ। জনমত সমীক্ষায় তিনি ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছেন। চরম মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার খরচের লাগামহীন বৃদ্ধির কারণে কারণে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এখন করুণ। ডলারের বিপরীতে তুর্কী লিরার দাম কমেছে রেকর্ড পর্যায়ে। এর মধ্যে যোগ হয়েছে সর্বশেষ ভূমিকম্প।
আঙ্কারার সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সরওয়ার আলম বলছেন, এসব ইস্যুই মে মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন এরদোয়ানের জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এরদোয়ানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন জোট তাদের প্রচারণায় বলছে– বিরোধী জোটের মতো বহু দল যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হবে। তারা বলছে- বিরোধীরা তাদের প্রার্থী দিতেই এক বছর সময় নিয়েছে। কখনো জোট ভেঙে গেছে, পরে আবার জোড়া লেগেছে। এরকম মতবিরোধ নিয়ে তারা কিভাবে দেশ পরিচালনা করবে? ফলে এধরনের কোয়ালিশন সরকার বেশি দিন টিকতে পারবে না।
তিনি বলেন, 'ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তুরস্কের অর্থনীতিতে যে সমস্যা শুরু হয় সেটা তিনি কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বর্তমানে তুরস্কের মুদ্রা লিরার মূল্য ডলারের বিপরীতে রেকর্ড পরিমাণে কমে গেছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ভূমিকম্পের পরপরই সরকারের বিভিন্ন বাহিনী কেন দুর্গত মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে পারেনি তা নিয়েও মানুষের ভেতরে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এজন্য অবশ্য রাস্তাঘাট ভেঙে পড়াকে দায়ী করেছেন।'
বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এরদোয়ানের জন্য কঠিন এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কতোটা সহজ হবে সেটা নির্ভর করছে বিরোধী দলগুলোর একজোট থাকতে পারার ওপর। ছয়টি দল নিয়ে গঠিত এবং ‘টেবল অব সিক্স’ নামে পরিচিত এই জোট নিজেদের মতবিরোধ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচনে একক প্রার্থী দিতে সম্মত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে যিনি বিরোধী জোটের প্রার্থী হয়েছেন তিনি জোটের সবচেয়ে বড় ও ধর্মনিরপেক্ষ দল পিপলস পার্টি বা সিএইচপির প্রধান- ৭৪ বছর বয়সী কেমাল কিলিচদারুগলু। বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা বলছে, এরদোয়ানের সঙ্গে তার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে।
আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক এই সিএইচপি দলটি গঠন করেছিলেন। এটি সবচেয়ে পুরনো দল, তবে নব্বই-এর দশক থেকে এটি ক্ষমতার বাইরে। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে কে প্রার্থী হবেন সেটা নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে টানাপড়েন চলছিল এক বছর ধরে। বিরোধী জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল গুড পার্টি ইস্তাম্বুল কিম্বা আঙ্কারার মেয়রকে প্রার্থী করতে চেয়েছিল।
ইস্তাম্বুলের মেয়র একরাম ইমামগুলুর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল একে পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করে তিনি মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নিজেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরোধী জোটের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে কিলিচদারুগলু জয়ী হলে এই দুজন মেয়রকে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হবে।
আঙ্কারার সাংবাদিক সরওয়ার আলম বলছেন, কামাল কিলিচদারুগলু ২০১২ সাল থেকে বিরোধী সিএইচপি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তিনি এই দল সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। মানুষের একটা ধারণা ছিল যে সিএইচপি হচ্ছে কট্টর বামপন্থী, কিম্বা শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ দল, অথবা শুধুমাত্র আতাতুর্কের দল। তিনি এই ধারণা থেকে বের হয়ে এসে সবাইকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। এখানে সব ধরনের মতাদর্শের লোক রয়েছে। এমনকি ইসলামপন্থীরাও তার সঙ্গে রয়েছে। এসব কারণে তুরস্কের রাজনীতিতে তিনি নতুন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
এরদোয়ানের রাজনৈতিক পরীক্ষা
কিলিচদারুগলুর নেতৃত্বে বিরোধীরা যে প্রচারণা চালাচ্ছে তাতে মূল কথা হচ্ছে- তুরস্কে এক ব্যক্তির শাসনের অবসান ঘটানো, আইনের শাসন ও সবার জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। কিলিচদারুগলু প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অন্যদিকে এরদোয়ানের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন জোট তাদের প্রচারণায় বলছে– বিরোধী জোটের মতো বহু দল যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হবে। তারা বলছে- বিরোধীরা তাদের প্রার্থী দিতেই এক বছর সময় নিয়েছে। কখনো জোট ভেঙে গেছে, পরে আবার জোড়া লেগেছে। এরকম মতবিরোধ নিয়ে তারা কিভাবে দেশ পরিচালনা করবে? ফলে এধরনের কোয়ালিশন সরকার বেশি দিন টিকতে পারবে না।
তুরস্কে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দুই পর্যায়ে। প্রথম ধাপে যদি কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পান, তখন সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দু’জন প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
আলী রীয়াজ বলেন, 'প্রথম পর্যায়ের ভোটে মি. এরদোয়ানের ভোট যদি ৫০ শতাংশের নিচে রেখে দেওয়া যায়, তাহলে তিনি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যেতে পারেন।'
আঙ্কারার সাংবাদিক সরওয়ার আলম বলছেন, 'বিরোধী জোটের প্রার্থী কেমাল কিলিচদারুগলুর চেয়েও এরদোয়ানের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বেশি। কিন্তু বিরোধীরা যদি তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।'
এরদোয়ানের জন্য এবারের নির্বাচন আগের নির্বাচনগুলোর মতো সহজ হবে না বলে মনে করেন সরওয়ার আলম।
তুরস্কে এমন এক সময়ে এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যখন দেশটির স্বাধীনতা অর্জনের শতবর্ষ উদযাপন করছে। আর এই নির্বাচনেই ৬৯-বছর বয়সী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারিত হবে। সূত্র: বিবিসি
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
জন্মভূমির বিপক্ষে মুরের ফিফটি, মাডান্ডের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড
![ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/4634-20240727032845.jpg)
ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮২ রানে থামিয়েও দিনশেষে অস্বস্তিতে ইংল্যান্ড
![পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
পদ্মায় নিখোঁজ নৌপুলিশের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও
![বেতাগী দরবারে ওরশ আজ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
বেতাগী দরবারে ওরশ আজ
![সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
সন্ধ্যা হলেই দ্বিগুণ ভাড়া ভোগান্তিতে যাত্রীরা
![কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
কারফিউ শিথিল করায় টাঙ্গাইলে জনজীবনে কর্মচাঞ্চল্য ফিরেছে
![নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/5-20240726212443.jpg)
নদী ভাঙনে ৪৫৮ পরিবারের আহাজারি
![বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726212448.jpg)
বিটিভি ভবনে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে টুকুসহ বিএনপি জামায়াতের ৬ নেতা কারাগারে প্রেরণ
![শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726212737.jpg)
শনিবার সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী
![মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726213356.jpg)
মেট্রোরেল স্টেশনে হামলার ঘটনায় আসামিদের ৫ দিনের রিমান্ড
![গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726213707.jpg)
গণবিরোধী কারফিউ দিয়ে মানুষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে : ডা. মনীষা
![নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726213859.jpg)
নিহত রুদ্রের নামে শাবির প্রধান ফটকের নামকরণ
![তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726222840.jpg)
তিনটি গুলি খেয়ে বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে’
![মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/500-321-inqilab-white-20240726214708.jpg)
মালয়েশিয়া ও প্রবাসী আর্ট মেলায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
![সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকুন- ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সবুর এমপি
![কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন, পরিবারের আহাজারি
![কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/2-20240726211751.jpg)
কুষ্টিয়ায় বছরে পাটের আবাদ কমেছে ৯০ হাজার বিঘা জমিতে
![ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/1-20240726212504.jpg)
ভাঙন আতংকে যমুনা পাড়ের মানুষ
![দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2024July/SM/3-20240726211927.jpg)
দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় হাকালুকি হাওর তীরের ৩ উপজেলা
![চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
চুয়াডাঙ্গায় মাদরাসাছাত্র হত্যা মামলায় আসামির যাবজ্জীবন