চীনে যেভাবে ভাইরাল হলো কংএর মীম
১২ জুন ২০২৩, ০৪:২৩ পিএম | আপডেট: ১২ জুন ২০২৩, ০৪:২৩ পিএম
চীনে এখন ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়স্কদের এক-পঞ্চমাংশই বেকার - বলছে মে মাসে প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যান। আর এই হতাশা এখন প্রকাশ পাচ্ছে অনলাইনে ভাইরাল নানা রকম মীমের মাধ্যমে। এই মীমের উৎস এক শতাব্দীরও বেশি পুরোনো একটি বিখ্যাত ছোটগল্প। সেটি হচ্ছে কং ইজির গল্প।
গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে কং ইজি - একজন ব্যর্থ জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটিয়েছিলেন। তার নামটি এখন হয়ে উঠেছে চীনের লক্ষ লক্ষ গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারীর প্রতীকী সাংকেতিক শব্দ - যা দিয়ে তারা অনলাইনে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। চীনা ভাষায় এসব মীমকে বলা হচ্ছে কং ইজি সাহিত্য। এর সংখ্যা শত শত। দেশটির প্রায় প্রত্যেকটি সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে দেখতে পাওয়া যাবে এই মীম।
একে পাওয়া যাবে অনলাইন মন্তব্যে, সাহিত্যের প্রতীকসম্বলিত রেখাচিত্রে, এমন কি নতুন করে লেখা পুরো একটি গল্পে। এই গল্প নিয়ে কেউ বানিয়ে ফেলেছেন এনিমেশন ভিডিও, কেউ লিখেছেন র্যাপ স্টাইলের গান। অবশ্য বেজিংএর কর্তৃপক্ষ এই কং ইজি র্যাপ গানকে 'বাড়াবাড়ি' হিসেবে নিয়েছে এবং ইন্টারনেট থেকে মুছে ফেলেছে।
চীনের রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন সিসিটিভিতে কং ইজির গল্পের এক বিশেষ দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্রদের উচিত তাদের "লম্বা গাউন খুলে ফেলা।" লম্বা গাউনের উদ্ধৃতিটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গল্পে কং যে লম্বা গাউন পরতেন - তা চিনিয়ে দিতো তখনকার চীনে কে ধনী এবং শিক্ষিত, আর কে দরিদ্র ও অশিক্ষিত । কারণ লেখাপড়া-না-জানা গরীব চীনারা খাটো জ্যাকেট পরতেন। সুতরাং সিসিটিভির পরামর্শ হচ্ছে - ছাত্রদের উচিত তাদের অহমিকা ত্যাগ করে, লম্বা গাউন খুলে ফেলে দিয়ে যে চাকরি পাওয়া যায় সেটাই নিয়ে নেয়া।
চীনের অনেক তরুণ তাদের জীবনের সাথে কংএর অনেক মিল দেখতে পাচ্ছেন - যদিও সেই গল্পটি অনেক পুরোনো। ধারণা করা হয়, গল্পটির সময়কাল উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ । চীনে তখন চলছে কিং রাজবংশের শাসন। তখন চীনের অত্যন্ত সম্মানজনক আমলাতন্ত্রে চাকরি পেতে হলে 'কেজু' নামে একটি খুব কঠিন রাজকীয় পরীক্ষায় পাস করতে হতো। কিন্তু কং সেই পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। তবে তখনকার চীনা সমাজে ওপর দিকে ওঠার একপাত্র পথই ছিল 'কেজু' পাস করা। এতে অনুত্তীর্ণ হবার ফলে কং চিরকালের জন্য ব্রাত্য হয়ে গেলেন।
তার জীবন নিয়ে এই গল্প আজও স্মরণীয় হয়ে আছে কারণ তা ছিল চীনের 'সিস্টেমের' এক নির্মম সমালোচনা। এখন এ যুগের নতুন প্রজন্মের মনে সেই প্রাচীন গল্পই নতুন করে অনুরণন তুলেছে - যারা চাকরি পাচ্ছে না, এবং যারা এক কঠোর পরীক্ষা-সংস্কৃতির চাপে বিপর্যস্ত ও হতাশ।
একটি মীমে বলা হয়, "ছোটবেলায় গল্পটি পড়ে বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আর মনে হচ্ছে - আমিই কং ইজি।" "আমি মনে করেছিলাম শিক্ষা হচ্ছে উন্নতির প্রথম ধাপ, কিন্তু আমি ক্রমশ উপলব্ধি করেছি যে এটা আসলে এমন একটা জিনিস যেখানে একবার পা রাখলে আমি আর নেমে আসতে পারবো না, আর লম্বা গাউন-পরা কং ইজি এখান থেকে আর ওপরে উঠতে পারেনি" - বলেছেন একজন ওয়েইবো ব্যবহারকারী।
ব্যাপারটা অন্য মাত্রা পেয়ে যায় - যখন সিসিটিভি এ বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা প্রচার করে। কংএর ট্রাজিক জীবনের জন্য তাকেই দোষারোপ করে সিসিটিভি মন্তব্য করে, কং পরিস্থিতির সাথে নিজকে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে, যে চাকরি পাওয়া যাচ্ছিল সে তা নিতে পারেনি। সিসিটিভি আরো মন্তব্য করে যে কং ইজির যুগ অতীত হয়ে গেছে, এবং "উচ্চাভিলাষী তরুণদের আর কখনোই লম্বা গাউন আঁকড়ে পড়ে থাকা উচিত নয়।"
এর প্রতিক্রিয়ায় অনলাইনে অসংখ্য মন্তব্য ও পোস্ট দিতে থাকেন ক্রুদ্ধ চীনা তরুণ-তরুণীরা। তারা শিক্ষা ও চাকরির এই গরমিল, বেকারদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা-জালের অভাব এবং সমাজে ওপর দিকে ওঠার ক্রমশঃ সংকুচিত হতে থাকা সুযোগকে "অন্যায় ও অনুচিত" বলে মন্তব্য করেন। কেউ কেউ বলেন সিসিটিভির এ প্রতিক্রিয়া 'গ্যাসলাইটিং' বা তরুণদের মনে হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টার সাথেও তুলনা করেন।
চীনের আরেকটি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম জিহু-তে একজন ব্যবহারকারী প্রশ্ন তোলেন - "যদি কোন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চাকরি না পায় তাহলে হযতো সেটা তারই দোষ। কিন্তু যখন আন্ডারগ্রাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্ব এত বেশি তখন কি তাদের সবাইকে 'লম্বা গাউন খুলে না ফেলার জন্য' দায়ী করা যায়?"
এই ব্যবহারকারী এবং তার মতো আরো বেশ কয়েকজন মন্তব্য করেন - চীনা ছাত্ররা অনেকগুলো বছর পড়াশোনার জন্য ব্যয় করে কিন্তু তারা এখন অনুভব করছে যে তারা প্রতারিত হয়েছে। তাদের যদি এখন নিজেদের স্বপ্ন পরিত্যাগ করতেই হয়, তাহলে এতদিন লেখাপড়া করে কী লাভ হলো?
"দশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে অনেকে লেখাপড়ার জন্য সাধু-সন্ন্যাসীর মত জীবন যাপন করে"- বলছিলেন আরেকজন - "তারা নিজেদের আনন্দের জন্য তেমন কিছু করে না, মেয়েদের সাথে মেলামেশাও খুবই বিরল। তাদের পরিবার ভালো-স্কুল-আছে-এমন এলাকায় বাড়ি কেনার জন্য, অথবা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য বিদেশে পাঠানোর জন্য অনেক অর্থ খরচ করে।"
তাদের মন্তব্য থেকে এটাই বেরিয়ে আসে যে চীনের সামাজিক নিরাপত্তা জালে বিরাট ফাঁক রয়ে গেছে। শহুরে শ্রমিকদের অর্ধেকেরও কম এখন বেকারভাতা পাচ্ছে। শুধু তাদের নিজেদের নয়, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। একজন মন্তব্য করেন, "সাধারণ পরিবার থেকে আসা কেউ কি এদেশে বড় সাফল্য পেতে পারবে? আমার মনে হয় সেটা হবে খুবই কঠিন। বড়লোকরা আর আমাদের সাথে এক কাতারে নেই।"
মুখে বলা না হলেও - দশকের পর দশক ধরে চীনে এমন একটা সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল যে পার্টির হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতার ধাকবে, আর তার বিনিময়ে পাওয়া যাবে সমৃদ্ধি। কিন্তু কয়েকদশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পর এখন চীনের অর্থনীতিতে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তরুণ চীনারা - যারা তাদের অভিভাবকদের সাফল্য পেতে দেখেছে - তারা এখন এই ব্যাপক পরিবর্তন দেখে হতবাক হয়ে গেছে।
চীনে এ বছর ১ কোটি ১৫ লাখ গ্রাজুয়েট তৈরি হবে। কিন্তু দেশটির নেতৃস্থানীয় ১০০ কোম্পানির ৬০ শতাংশই বলছে, তারা অপেক্ষাকৃত কম গ্রাজুয়েট নিয়োগ দেবে। গত ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের এক রিপোর্টে সরকার বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ক্রমবর্ধমান 'উদ্বেগ, হতাশা ও বিভ্রান্তির ব্যাপারে তারা সচেতন' এবং এটা সমাজের অর্থনৈতিক আস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে কং ইজির গল্পকে কেন্দ্র করে এরই প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়েছে।
গল্পটি লিখেছিলেন লু সুন ১৯১৯ সালে। তাকে মানা হয় চীনা সাহিত্যের একজন দিকপাল বলে, তুলনা করা হয় চার্লস ডিকেন্স ও জর্জ অরওয়েলের সাথে। লু তার গল্পে সেদেশের সামন্তবাদ ও নিপীড়নের যে তীক্ষ্ম সমালোচনা করেছেন তা এতই সুপরিচিত যে ভাইরাল হতে বা মীমে পরিণত হতে সময় লাগে না। পার্টির তিরস্কার থেকেও তা মুক্ত থাকতে পারে। মাও জেদং একসময় লু সুনকে আখ্যায়িত করেছিলেন সেদেশের শীর্ষস্থানীয় একজন 'ঋষি' হিসেবে। কমিউনিস্ট পার্টি এত উচ্চ স্থানে তাকে বসানোর পর তো আর তার কণ্ঠরোধ করতে পারে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোমোমা কলেজে চীনা সাহিত্যের অধ্যাপক আইলিন চেং বলেন, লু ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং সরকারি নিপীড়ন ও ব্যক্তির কণ্ঠরোধের কড়া সমালোচক। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্ষমতাসীন পার্টি লু সুন সম্পর্কে বলে থাকে যে তার এসব সমালোচনা অতীতের চীনকে নিয়ে এবং ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু চীনে এ যুগের ছাত্ররা তার রচনাকে এখন রাষ্ট্রবিরোধী উপায়ে কাজে লাগাচ্ছে, বলছেন প্যারিসের স্কুল অব এ্যাডভান্সড স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক সেবাস্টিয়ান ভেগ। চীনে যখন ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ কমে আসছে, তখন মনে হচ্ছে লু সুন যেন নতুন করে বেরিয়ে আসছেন। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি ট্রাম্পের
বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষকর্মী নিতে আগ্রহী লিবিয়া
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
ইইউভুক্ত দেশে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের হুমকি কাতারের
দক্ষিণ কোরিয়ার সৌন্দর্যের পেছনে ছুটে বিপদের ফাঁদে পর্যটকরা
ঢাকার বাতাস আজ ‘ঝুঁকিপূর্ণ’
২৮ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদ
হিরো নয় কারিনার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করতে পারি
রাওয়ার নেতৃত্বে আবদুল হক ও ইরশাদ সাঈদ
স্লোভাক প্রধানমন্ত্রীর মস্কোতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক
কুমিল্লায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৩ কিশোর নিহত
গাজীপুরে কারখানা থেকে দগ্ধ আরও এক লাশ উদ্ধার
সিরিয়ার আকাশে নিষিদ্ধ হলো ইরানের বিমান
বিমানে ‘ঘুমিয়ে’ ছিলেন বাইডেন : সেনাদের লাশ পেতে অপেক্ষায় স্বজনরা
ভারতে পণ আইন নিয়ে বিতর্ক, এক ব্যক্তির আত্মহত্যা ঘিরে আলোড়ন
ভারত সীমান্তের শূন্যরেখায় পড়ে ছিল বাংলাদেশির গুলিবিদ্ধ লাশ
এক্সপ্রেসওয়েতে কভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকার সংঘর্ষে নারী নিহত, আহত ৫
ব্রাজিলে বাড়ির ওপর বিমান বিধ্বস্ত, সব যাত্রী নিহত
চুয়াডাঙ্গার রামদিয়ায় জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে একজনকে হত্যা, আহত ৫
চীনের নতুন বাঁধ প্রকল্পে তিব্বতিদের প্রতিবাদ, দমন-পীড়ন ও গ্রেফতার