ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হচ্ছে

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

০২ জুলাই ২০২৩, ০১:৩৪ পিএম | আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৩, ০১:৩৪ পিএম

আধুনিক মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে যে ঐতিহ্যবাহী তত্ত্ব প্রচলিত, সেটি এবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বহু বছর ধরে, একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সরা পূর্ব বা দক্ষিণ আফ্রিকার একক পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছিলেন, আজকের আধুনিক মানুষের উৎপত্তি ঠিক কোন জায়গা থেকে হয়েছে সেটি তারা চিহ্নিত করেছেন। সেই স্থানটি প্রাথমিকভাবে বোতসওয়ানা সেইসাথে নামিবিয়া এবং জিম্বাবুয়ের কিছু অংশ জুড়ে বলে ধারণা করেছিলেন গবেষকরা।

কিন্তু বর্তমান সময়ের শক্তিশালী কম্পিউটার মডেলিং এবং জেনেটিক ডেটা বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে ভিন্ন তথ্য। কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, আমরা মানুষ মূলত আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একাধিক পূর্বপুরুষের গোষ্ঠী থেকে এসেছি। বলা হচ্ছে, আফ্রিকায় অন্তত দুটি গোষ্ঠী কোটি কোটি বছর ধরে সহাবস্থানে ছিল। সেখান থেকে মানুষ বংশবিস্তার করে পুরো মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ‘আমরা জানি না এই দুটি গোষ্ঠী কোথায় থাকত, তবে তারা একে অপরের থেকে এতোটা দূরে ছিল যে দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে সামান্য জিনগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়,’ ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিসের গবেষক ব্রেনা হেন বিবিসি মুন্ডোকে এ কথা জানান।

ফসিলের অভাব

মানব প্রজাতি অন্তত তিন লাখ বছর আগে আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এ পর্যন্ত মানুষের যতো প্রাচীন ফসিল উদ্ধার হয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে পুরনোটা ছিল তিন লাখ বছর আগের। সেই থেকেই মানুষের উৎপত্তির এই আনুমানিক হিসাব করা হয়েছে। ধারণা করা হয় সেই ফসিলের সাথে আধুনিক মানুষের ইতিহাসের সংযোগ থাকতে পারে। কিন্তু এখানে চ্যালেঞ্জের জায়গাটি হল: বিবর্তনের শুরু দিকের মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সের বেশি সংখ্যক ফসিল সংগ্রহ করা যায়নি। যে কয়টি পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর অবশিষ্টাংশ ইথিওপিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় কীভাবে মানব প্রজাতির উদ্ভব হল, কিভাবে তারা আফ্রিকার মহাদেশ জুড়ে এবং পরে পৃথিবীর বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ল - সে বিষয়ে সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

নতুন গবেষণা ইঙ্গিত করে যে, আফ্রিকার একাধিক পূর্বপুরুষ গোষ্ঠী হোমো সেপিয়েন্সের উত্থানে অবদান রেখেছে, এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে সামান্য পার্থক্য ছিল বলে গবেষকরা জানতে পেরেছেন। তারাই বংশ বিস্তার করে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছেন এবং কয়েক হাজার বছর ধরে একে অপরের সাথে মিলেমিশে নানা ধরণের বৈচিত্র্য তৈরি করেছেন। অনেকটা নানা আকার ও রঙের মোজাইকের মতো।

২০১৮ সালে, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের প্রত্নতত্ত্ববিদ এলিয়েনর স্কেরি এমন একটি গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন যা সাম্প্রতিক গবেষণাকে কিছু ভিত্তি দিয়েছিল। ‘আমরা প্রত্নতত্ত্ব, জীবাশ্ম, জেনেটিক এবং জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি যে, আফ্রিকার একাধিক জনগোষ্ঠী থেকে মানুষ বিবর্তিত হয়েছে। আমরা এই মডেলটিকে আফ্রিকান মাল্টিরিজিওনালিজম বা প্যান-আফ্রিকান কাঠামোগত মডেল বলি,’ বিবিসি মুন্ডোকে এমনটাই জানিয়েছেন স্কেরি। ‘সেই সময়ে আমরা বলেছিলাম যে জেনেটিক মডেলগুলোকে একটি কাঠামোগত রূপ দেয়া প্রয়োজন এবং এজন্য আমরা জেনেটিসিস্টদের সেটি করার আহ্বান জানাই,’ বিশেষজ্ঞরা যোগ করেন।

হেন এবং তার সহকর্মীরা ঠিক তাই করেছে। ‘ছোট ছোট স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিয়ে গড়া এক বৈচিত্র্যময় বৃহৎ জনগোষ্ঠীতে আমাদের শেকড় গাঁথা হয়েছে,’ স্কেরি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এমন মন্তব্য করেন। যদি বিষয়টিকে আমরা ছবি একে উপস্থাপন করি, তাহলে নকশাটি দেখতে অনেকটা ‘জট বাঁধা লতা বা ডালপালার মতো দেখাবে,’ ট্রি অফ লাইফ অর্থাৎ সাজানো কোন বিন্যাস মনে হবে না। এই জড়িয়ে থাকা লতাগুলোকে শুধুমাত্র জিনগত পার্থক্য দিয়ে আলাদা করা সম্ভব এবং এটি বিবর্তনের ধারণাকে একটি নতুন রূপ দিয়েছে। যাকে গবেষকরা ব্যাখ্যা করেছেন ‘জড়িয়ে থাকা লতাপাতার কাঠামো’ হিসেবে।

এই উপসংহারে পৌঁছাতে হেন এবং তার সহকর্মীরা একটি শক্তিশালী কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করেন। গবেষক দলটি এজন্য একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করেছেন যা তৈরি করেছেন কানাডার মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-লেখক সাইমন গ্রেভেল। এই সফটওয়্যারটি মডেলিংয়ের কাজে জন্য প্রয়োজনীয় বিশাল কম্পিউটিং শক্তিকে সমন্বয় করতে পারে, নেচার জার্নালের রিপোর্টে এমন তথ্য দেয়া হয়েছে৷ তারা পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার বাসিন্দা সেইসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার নামা জনগোষ্ঠী মিলিয়ে মোট ২৯০ জনের জিনোম সিকোয়েন্সিং উপাত্ত সংগ্রহ করেন।

তারপর তারা আফ্রিকায় বিদ্যমান জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গবেষণা করেন। বিভিন্ন সময়কালে এই মানুষগুলো কেমন ছিলেন সেই দৃশ্যপট তৈরি করেন। এরমধ্যে কোনটি আজকের মানব প্রজাতির মধ্যে পাওয়া ডিএনএ-এর বৈচিত্র্যের সাথে মিলে যায় সেটা দেখার চেষ্টা করেছেন গবেষকরা। ‘এই জিনোমিক তথ্য, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জিনের ঐতিহাসিক গতিবিধি ধরতে এবং বুঝতে গবেষকদের সাহায্য করেছে’ এমন তথ্য জানিয়েছে নেচার জার্নাল।

গবেষণায় উঠে এসেছে যে আমরা যারা এখন বেঁচে আছি - তারা সবাই প্রায় ১০ লাখ বছর আগে আফ্রিকায় থাকা অন্তত দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের পূর্বসূরিদের খুঁজে পাবো। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে অন্তত দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর সন্ধান পাবো - যারা লাখ লাখ বছর আগে থেকে আফ্রিকায় বাস করে আসছে। উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিসিস্ট অ্যারন রাগসডেল এবং প্রধান লেখক বলেছেন, ‘এতদিন ধারণা ছিল সব মানুষ একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে, কিন্তু আমাদের অতীত ইতিহাসের গভীরে গেলে দেখা যাবে বিষয়টি আরও জটিল। মানব প্রজাতির একক স্থান বা একক গোষ্ঠী থেকে বিবর্তিত হওয়ার ধারণাটি জটিল।’

সাম্প্রতিক এ গবেষণার ফলাফল সঠিক কিনা তা স্পষ্টভাবে বলা যাবে না। মানব প্রজাতির উদ্ভব নিয়ে জটিলতা অব্যাহত থাকবে এবং এ নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধান যে চলতেই থাকবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পরবর্তী গবেষণাগুলোকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তি। সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মণিপুর গৃহযুদ্ধে ইন্ধন দিচ্ছে মিয়ানমার, চাঞ্চল্যকর দাবি রিপোর্টে
সিরিয়ার নেতার সঙ্গে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান
অর্থনৈতিক সংকটে আফগান রুটি, ঐতিহ্য ও জীবনের অংশ
উত্তরপ্রদেশে ৩ খলিস্তানি বিদ্রোহীকে গুলি করে হত্যা পুলিশের
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার ১,১০০ হতাহতের শিকার : সিউল
আরও

আরও পড়ুন

শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা জনজীবন স্থবির

শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা জনজীবন স্থবির

খুবির নির্মাণকাজের গুণগতমান নিশ্চিত ও তদারকি বাড়ানোর নির্দেশ উপাচার্যের

খুবির নির্মাণকাজের গুণগতমান নিশ্চিত ও তদারকি বাড়ানোর নির্দেশ উপাচার্যের

নওগাঁ শহরের দেয়াল থেকে মুছে ফেলা হলো জয়  বাংলা

নওগাঁ শহরের দেয়াল থেকে মুছে ফেলা হলো জয় বাংলা

জাহাজে ছিল ৫ জনের লাশ, হাসপাতালে মারা গেলেন আরও ২ জন

জাহাজে ছিল ৫ জনের লাশ, হাসপাতালে মারা গেলেন আরও ২ জন

বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালইজড হাসপাতালে পুনরায় শুরু হলো বহুল প্রতীক্ষিত কিডনি প্রতিস্থাপন

বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালইজড হাসপাতালে পুনরায় শুরু হলো বহুল প্রতীক্ষিত কিডনি প্রতিস্থাপন

নওগাঁয় নতুন পুলিশ সুপার সাফিউলের  দায়িত্বভার গ্রহণ

নওগাঁয় নতুন পুলিশ সুপার সাফিউলের দায়িত্বভার গ্রহণ

দু’জনের ওপর ১২ কোটি মানুষের তথ্য সুরক্ষা কতটা যৌক্তিক: এনসিএসএ মহাপরিচালক

দু’জনের ওপর ১২ কোটি মানুষের তথ্য সুরক্ষা কতটা যৌক্তিক: এনসিএসএ মহাপরিচালক

ফ্যাসিস্টের দোসর মহিববুর ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ২ মামলা

ফ্যাসিস্টের দোসর মহিববুর ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ২ মামলা

নোয়াখালীর আমিশাপাড়াতে এনআরবিসি ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু

নোয়াখালীর আমিশাপাড়াতে এনআরবিসি ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু

নিউজিল্যান্ড দলে নতুন মুখ জ্যাকবস

নিউজিল্যান্ড দলে নতুন মুখ জ্যাকবস

জালিয়াতির নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের বেতন-ভাতা  ফেরত নেয়ার দাবি তুলেছে ‘সিলটি পাঞ্চায়িতের

জালিয়াতির নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের বেতন-ভাতা  ফেরত নেয়ার দাবি তুলেছে ‘সিলটি পাঞ্চায়িতের

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল

বার্মিংহামের সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ অ্যান্ড এডুকেশন সেন্টারে কাতারের ব্যবসায়ী মহিন উদ্দিন

বার্মিংহামের সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ অ্যান্ড এডুকেশন সেন্টারে কাতারের ব্যবসায়ী মহিন উদ্দিন

উন্নয়নের প্রতিটি ধাপে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতই সরকারের লক্ষ্য : রিজওয়ানা হাসান

উন্নয়নের প্রতিটি ধাপে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতই সরকারের লক্ষ্য : রিজওয়ানা হাসান

খুঁটির জোর কোথায়?  আওয়ামী ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজ করে বিল নেয়ার অভিযোগ!

খুঁটির জোর কোথায়?  আওয়ামী ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজ করে বিল নেয়ার অভিযোগ!

দুমকী উপজেলা জমিয়তে হিজবুল্লাহ সভাপতির ইন্তেকাল

দুমকী উপজেলা জমিয়তে হিজবুল্লাহ সভাপতির ইন্তেকাল

সাদপন্থীদের কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধের দাবিতে শেরপুরে বিক্ষোভ

সাদপন্থীদের কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধের দাবিতে শেরপুরে বিক্ষোভ

মৌলভীবাজারের বড়লেখা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে চা শ্রমিক গোপাল হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন

মৌলভীবাজারের বড়লেখা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে চা শ্রমিক গোপাল হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন

ছাগলনাইয়ায় ফসলি জমির মাটি কাটায় দুইটি এক্সেভেটর জব্দ

ছাগলনাইয়ায় ফসলি জমির মাটি কাটায় দুইটি এক্সেভেটর জব্দ

আব্দুল্লাহ শফিকের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

আব্দুল্লাহ শফিকের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড