চোখ ওঠা রোগের নাম পশ্চিমবঙ্গে ‘জয় বাংলা’ হয়েছিল যেভাবে
২০ জুলাই ২০২৩, ০৬:৫৬ পিএম | আপডেট: ২০ জুলাই ২০২৩, ০৬:৫৬ পিএম
কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে অনেক দিন পরে আবারও ‘জয় বাংলা’ কথা খুব শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিক পরিচিত স্লোগান হলেও এখন যে ‘জয় বাংলার’ কথা শোনা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে, তা আসলে ‘চোখ ওঠা’ রোগ বা কনজাংটিভাইটিস।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে চোখ ওঠা রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় থেকেই কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগকে ‘জয় বাংলা’ বলে থাকেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরগুলি থেকেই পশ্চিমবঙ্গে চোখ ওঠা রোগটি ছড়িয়েছিল বলে মনে করা হলেও ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের মতো প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা গবেষণাপত্রসহ একাধিক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে ১৯৭১ সালে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই রোগটি ছড়িয়েছিল। উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌতে সে বছর কনজাংটিভাইটিসকে মহামারি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
আবার রোগটির নাম কেন ‘জয় বাংলা’ হলো, তা নিয়েও চালু রয়েছে একাধিক তত্ত্ব। ‘একাত্তরের রাতদিন’ বইয়ের লেখক, সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী ১৯৭১ সালে নিয়মিতভাবে শরণার্থী শিবির ও রণাঙ্গনে ঘুরতেন। ‘কনজাংটিভাইটিস সেই সময় ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার বইতেও বিষয়টার উল্লেখ করেছি। কেউ কেউ বলে থাকেন যে শরণার্থীদের কিছুটা তাচ্ছিল্য করার জন্য একটা রোগের নামকে ‘জয় বাংলা’ বলে দেয়া হয়েছিল,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন চক্রবর্তী।
‘কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সব থেকে জনপ্রিয় স্লোগানকে চোখ ওঠা রোগের নাম দেয়ার সেটা কারণ ছিল না। সেই সময়ে ইয়াহিয়া খান বাঙালীদের রক্তচক্ষু দেখাচ্ছিলেন, আর কনজাংটিভাইটিস হলেও চোখ লাল হয়ে যায়, সেইভাবেই রক্তচক্ষুর সূত্র ধরে লোকমুখে জয় বাংলা নামটা ছড়িয়ে পড়ে। আমার লেখাতেও এই ব্যাখ্যাই দিয়েছি আমি।’ ‘যে পশ্চিমবঙ্গবাসী শরণার্থীদের সঙ্গে ভাগ করে খাবার খেয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, তাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে একটা রোগের নাম রেখে দেবে, এটা অযৌক্তিক। যারা এই তত্ত্ব চালানোর চেষ্টা করেন, তারা ভুল করেন,’ বলছিলেন চক্রবর্তী।
বিভিন্ন মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা পত্রগুলোতে দেখা যাচ্ছে কনজাংটিভাইটিস বা ‘জয় বাংলা’ ১৯৭১ এর মহামারী হিসাবে দেখা দেয়ার প্রায় দশ বছর পরে আবারও পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছিল ১৯৮১ সালে। তবে ৭১-এর তুলনায় সেবারের প্রকোপ অনেকটাই কম ছিল। তার পরেও মাঝে মাঝে কনজাংটিভাইটিস দেখা গেলেও বহু বছর পরে ২০২৩ সালে আবারও ফিরে এসেছে ‘জয় বাংলা’।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে খুলনা সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর এএসএম শামসুল আরেফিন। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ১৯৭১ সালে ভারতে বাসে, ট্রামে বা যেখানেই যেত মুক্তিযোদ্ধা অথবা শরণার্থীরা, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ 'জয় বাংলার' লোক বলতেন।
‘আমাদের সবাইকে সে সময়ে জয় বাংলার মানুষ বলা হত। সেই ডাকে কোনও অসম্মান বা তাচ্ছিল্য তো ছিলই না, বরং এটা যথেষ্ট সম্মানের অভিবাদন ছিল। আর যেহেতু শরণার্থী শিবিরগুলোতেই কনজাংটিভাইটিস বেশি ছড়িয়েছিল, তাই লোকমুখে এটা চালু হয়ে গিয়েছিল যে জয় বাংলা-র রোগ বা জয় বাংলার মানুষদের রোগ। তা থেকেই রোগটার নামই হয়ে গেল জয় বাংলা,’ বলেন আরেফিন, ‘তখন আমাদের বাহিনীর অনেক অফিসার আর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যেই কনজাংটিভাইটিস ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষত যারা কলকাতায় বেশ কিছুদিন কাটিয়ে তারপরে রণাঙ্গনে ফিরতেন তাদের অনেকেরই কনজাংটিভাইটিস হয়েছিল মনে আছে।’
আবার কলকাতা থেকে ওষুধপত্র আর চিকিৎসক দল নিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের শরণার্থী শিবিরগুলিতে আর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মাঝেমাঝেই যেতেন পিপলস রিলিফ কমিটির স্বেচ্ছাসেবক ও পরবর্তীতে কবি-সাংবাদিক জিয়াদ আলি। তার কথায়, “পেট্রাপোল সীমান্ত সহ উত্তর ২৪ পরগণার বিভিন্ন সীমান্ত আর নদীয়াতে যেসব শরণার্থী শিবিরগুলোতে তখন নিয়মিতই যাতায়াত করতাম। মে-জুন মাস নাগাদ আমরা লক্ষ্য করি যে অনেকেই চোখ লাল হওয়া, চোখ থেকে জল পড়ার সমস্যার কথা জানাচ্ছেন আমাদের। শিবিরগুলি ছাড়া কলকাতা শহরেও বহু মানুষের তখন কনজাংটিভাইটিস হচ্ছিল। আমাদের সঙ্গী চিকিৎসকরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করা, চোখে হাত না দেওয়া আর বারেবারে চোখে জল দেওয়ার পরামর্শ দিতেন। শরণার্থী শিবিরগুলিতে দেখতাম বেশ কিছু মানুষ কালো চশমা পড়াও শুরু করেছিলেন।“
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে পশ্চিমবঙ্গে আসা বেশ কিছু বিদেশী সাংবাদিকও কনজাংটিভাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। সম্ভবত সেকারণেই নিউ ইয়র্ক টাইমসও এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। সেই সময়ের সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি হিসাবেই প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা করিয়েছিলেন কনজাংটিভাইটিসের। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে স্কুল বন্ধ ছিল, ট্রেন চালক আর গার্ডদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় রেল চলাচল ব্যহত হয়েছিল।
সপ্তাহ দুয়েক আগে কলকাতার আদি বাসিন্দা, বর্তমানে সিঙ্গাপুর নিবাসী ঘোষ পরিবার দেশে এসেছিলেন ছুটি কাটাতে। ফিরে যাওয়ার কয়েকদিন আগে পরিবারের কর্তা কুবলয় ঘোষের হঠাৎই চোখ লাল হয়ে ভীষণ ফুলে যায়, সমানে জল পড়তে থাকে। ঘোষের স্ত্রী সুদেষ্ণা ঘোষ বলছিলেন, “ওর চোখ ফুলে গিয়ে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। তারপরেই আমার, ছেলের আর আমার মায়ের সংক্রমণ ছড়ালো। ডাক্তারের কাছে গেলাম সবাই। সবারই কনজাংটিভাইটিস। ওদের তিন-চার দিনের মধ্যে সেরে গেলেও আমার সারতে প্রায় সাত দিন লেগেছিল। বাকিদের চোখে ব্যথা না থাকলেও আমার প্রচণ্ড ব্যথা ছিল চোখে।“
কনজাংটিভাইটিসের কারণে ঘোষ পরিবারকে সিঙ্গাপুরে ফিরে যাওয়া দু'বার পিছিয়ে দিতে হয়। এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় কনজাংটিভাইটিস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বলে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন। কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের চক্ষু বিভাগের সিনিয়র চিকিৎসক উদয়াদিত্য মুখার্জী বলছিলেন, “আমাদের হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ১৫-১৬ শতাংশ রোগীই কনজাংটিভাইটিস নিয়ে আসছেন। বাস্তবে আক্রান্তের সংখ্যাটা আরও বহু গুণ বেশি হওয়ারই সম্ভাবনা, কারণ কনজাংটিভাইটিসে আক্রান্ত হলে সিংহভাগ রোগীই ডাক্তারের কাছে আসেন না, এমনিতেই তিন-চার দিনের মধ্যে সেরে যায়। যাদের বাড়াবাড়ি হয়, তারাই শুধু হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে ডাক্তারের কাছে আসেন।“
তিনি বলছিলেন, “বহু বছর পরে এত সংখ্যক কনজাংটিভাইটিস রোগী পাচ্ছি আমরা। এখনও পর্যন্ত কোন স্ট্রেইন থেকে এই ভাইরাসটা ছড়াচ্ছে, তা জানা যায় নি, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে এটা নতুন কোনও স্ট্রেইন।“ সম্প্রতি কনজাংটিভাইটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জয় বাংলা নামটাও আবারও বেশি শোনা যাচ্ছে। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রাজশাহী মহানগরীতে ঘন কুয়াশা
আবারও ভানুয়াতুতে দ্বীপপুঞ্জে ৬.২ মাত্রার ভূমিকম্প
হাজীগঞ্জে ভরাট মিঠানিয়া খালের মুখ, হুমকিতে ফসলি জমি
রাহাতের সুরের মুর্ছনায় বিমোহিত দর্শক, বাংলায় বললেন 'আমরা তোমাদের ভালোবাসি'
‘প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে’
যুক্তরাজ্যে ট্রাম্পের বিশেষ দূত হিসেবে মার্ক বার্নেট নিযুক্ত
ফাইনালে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার
ফ্রেন্ডলি ফায়ার দুর্ঘটনায় লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধবিমান ধ্বংস
ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?
বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত
হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি
কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫
ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি
উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন
বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের
নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত
সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প
আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ
মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা