মুসলিম ঘাতক মনু মানেসার টিভিতে, কিন্তু পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না
০৯ আগস্ট ২০২৩, ০৩:০০ পিএম | আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০৩:০১ পিএম
ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য হরিয়ানায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ধর্মীয় সহিংসতার জন্যে মূলত ২৮-বছর বয়সী এক তরুণকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। উত্তেজিত হিন্দু ও মুসলিম জনতার মধ্যে এ সংঘর্ষে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে একজন ইমামও রয়েছেন। এসময় পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্যসহ আরো বহু মানুষ আহত হয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে এ সংঘর্ষের জন্য মোহিত ইয়াদভ নামের এক তরুণের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে ধরা হয়। এই তরুণ ভারতে মনু মানেসার নামে সুপরিচিত। নূহের বাসিন্দারা এবং কয়েকজন মুসলিম রাজনীতিবিদ বলছেন হিন্দু শোভাযাত্রার দু’দিন আগে মনু মানেসারের পোস্ট করা একটি ভিডিওর কারণে সেখানে উত্তেজনা তৈরি হয়। ‘এই ভিডিওটি ছাড়া না হলে নূহকে আগুনে পুড়তে হতো না,’ ওই এলাকার বহু মুসলিম বাসিন্দা ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে একথা বলেছেন।
মানেসারের পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে সোমবারের শোভাযাত্রায় অংশ নেয়ার জন্য তিনি হিন্দুদের ‘বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ’ করার জন্য আহবান জানাচ্ছেন। ‘আমিও সেখানে থাকবো, আমার সমর্থক ও টিমও সেখানে থাকবে,’ ভিডিওতে বলেন তিনি। সাধারণভাবে দেখতে গেলে মানেসারের পোস্ট করা ভিডিওটিকে নির্দোষই বলা চলে। তাহলে সাম্প্রদায়িক এই সহিংসতার জন্য তাকে কেন দায়ী করা হচ্ছে?
মনু মানেসার একজন ট্রাক-বাসচালকের ছেলে। শ্রমিকদের কাছে তার মালিকানাধীন ছোট ছোট কিছু ঘর ভাড়া দিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি প্রায়শই ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। এক দশক আগে তিনি উগ্র হিন্দুত্ববাদী গ্রুপ বজরং দলে যোগ দেন। এর পরে তিনি ধীরে ধীরে সংগঠনের উচ্চ পর্যায়ে ওঠে আসেন। সোশাল মিডিয়ায় তার অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা ছবিতে তাকে মেশিনগানসহ আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতেও দেখা যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহসহ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তার কিছু সেলফি রয়েছে।
হরিয়ানা রাজ্য সরকারের গোরক্ষক টাস্ক ফোর্সের একজন সদস্য এবং নূহ-তে বজরং দলের গোরক্ষক ইউনিটের প্রধান এই মনু মানেসার। তিনি বলছেন, তার এই ‘আহবানের উদ্দেশ্য হিন্দুত্ববাদ ও গরুকে রক্ষা কর ‘- হিন্দুদের কাছে গরু অত্যন্ত পবিত্র একটি প্রাণী হিসেবে বিবেচিত। রাজস্থান ও হরিয়ানাসহ বেশ কয়েকটি ভারতীয় রাজ্যে গরু জবাই করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে গরু পরিবহন করা অথবা হত্যার সন্দেহে বহু মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যাও করা হয়েছে।
মনু মানেসার তার সমর্থকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। সোশাল মিডিয়াতে তার কিছু ফ্যান পেইজও আছে। তার ভক্তরা বলছেন যে মনু মানেসার ও তার টিমের তৎপরতার কারণে অর্ধশতাধিক গরুকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু নূহের মুসলিম বাসিন্দাদের কাছে মানেসার এবং তার অনুসারীরা হচ্ছে ‘গোরক্ষক’ যারা তথ্যপ্রমাণ ছাড়া মুসলিমদের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য গরু পাচারের অভিযোগকে কূটচাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। মানেসার সব সময় দাবি করেন যে তিনি ও তার দল প্রশাসনের সঙ্গে মিলে আইনের আওতার মধ্যেই কাজ করেন। ‘গরু ও হিন্দুত্ববাদকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা সবসময় প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করি। যখনই আমরা গরু পাচারকারীদের ধরি, তাদেরকে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দেই,’ বলেন তিনি।
তবে তার এই দাবি নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। কারণ গত কয়েক বছরে মানেসার নিজে এবং তার অনুসারীরা নিয়মিতভাবে অনেক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন যাতে কথিত গরু পাচারকারীদের হয়রানি করতে এবং যেসব ট্রাকে করে গোমাংস অথবা গরু পরিবহন করার অভিযোগ উঠছে, সেগুলোকে ধাওয়া করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিতে দেখা যাচ্ছে। বেশি কিছু ছবিতে তাকে আহত মুসলিম ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়িয়ে পোজ দিতে দেখা যাচ্ছে। কারো মুখ রক্তাক্ত, কারো মুখ ফুলে গেছে। তিনি এমন ভিডিও শেয়ার করেছেন যেখানে হিন্দু দেবতা রাম এবং ‘গোমাতার’ প্রশংসা করে মুসলিমদের স্লোগান দিতে বাধ্য করতে দেখা যাচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে জুনাইদ এবং নাসির নামের দুই মুসলিমকে খুনের জন্য মনু মানেসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অপহরণ, হামলা ও হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। প্রতিবেশী রাজ্য রাজস্থানের আদালতে পেশ করা দলিলপত্রে দেখা যায় বজরং দলের গোরক্ষক ইউনিট ওই দুই মুসলিমকে গরু বেচাকেনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে নূহ থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি অপহরণ করে। তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয় এবং একদিন পর হরিয়ানায় আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি গাড়িতে তাদের অগ্নিদগ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়।
এই হত্যাকাণ্ডের পর হরিয়ানা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় যে মানেসার পলাতক রয়েছেন এবং তারা জানেন না তিনি কোথায় আছেন। সেসময় তাকে গ্রেফতার করার জন্য রাজস্থানের পুলিশ হরিয়ানায় গিয়েছিল। কিন্তু তারা জানায় যে তাকে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু সোশাল মিডিয়াতে মনু মানেসারের নতুন নতুন ভিডিও ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত রয়েছে। এসব ভিডিও তার অ্যাকাউন্ট থেকে যেমন শেয়ার করা হচ্ছে, তেমনি ছড়িয়ে পড়ছে তার সমর্থক ও ভক্তদের কাছ থেকেও।
সোমবারের সহিংসতার পর মানেসারকে বিভিন্ন ভারতীয় টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা গেছে। এসব সাক্ষাৎকারে তিনি সহিংসতার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন যে ভিএইচপি নেতাদের পরামর্শে তিনি সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। সহিংসতার জন্য তিনি স্থানীয় মুসলিম নেতাদের দায়ী করেছেন, এবং বলেছেন, ‘হিন্দুরা তাদের ধর্ম অথবা গরুর ওপর কোনো ধরনের আক্রমণ সহ্য করবে না।’ এসব সাক্ষাৎকারে তিনি খুনের অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য রাখার সুযোগকেও কাজে লাগিয়েছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন- যে সময়ে অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল সেসময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না।
মনু মানেসারের এসব সাক্ষাৎকারের পর অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম যদি তাকে খুঁজে পায় এবং তার সঙ্গে কথা বলতে পারে তাহলে দুটি রাজ্যের পুলিশ তাকে পাচ্ছে না কেন? এবিষয়ে বিবিসির পক্ষ থেকে রাজস্থান ও হরিয়ানার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা এখনও এসব প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি। তবে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে তাকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে চাপ অব্যাহত রাখলে মানেসার বুধবার রাতে একটি হিন্দি সংবাদ চ্যানেলকে বলেছেন তিনি যে এর সাথে জড়িত নন সেটা প্রমাণ করতে ‘হরিয়ানা ও রাজস্থানের পুলিশের কাছে তিনি নিজেকে ১০১% তুলে ধরবেন।’
বৃহস্পতিবার সকালে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী এমএল খাত্তার বলেছেন, তার রাজ্যে মানেসার ফেরারি আসামী নয়, এবং তাকে খুঁজে বের করার কাজে তার সরকার রাজস্থানের পুলিশকে সাহায্য করবে। কিন্তু খাত্তারের এই দাবির সঙ্গে মানেসারের কথার বৈপরীত্য রয়েছে। কারণ একটি সংবাদ চ্যানেলকে তিনি বলেছেন হরিয়ানার পুলিশের বিভিন্ন মামলায় তার নাম রয়েছে। ‘একটা ইঁদুর মারা গেলেও, আমাকে দায়ী করা হয়,’ বলেন তিনি। পুলিশ বলছে, দাঙ্গা ও সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ৬ ফেব্রুয়ারির একটি ঘটনা যাতে চারজন আহত হয়েছে।
সেসময় পুলিশের একজন কর্মকর্তা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন যে ‘হত্যা প্রচেষ্টার মামলায় মনুও একজন অভিযুক্ত আসামী,’ কারণ তাকে ‘একটি ভিডিওতে ঘটনাস্থলের পাশে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে।’ ‘অপরাধ বিভাগসহ পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম তার অবস্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তিনি কোথায় আছেন সেটা এখনও বের করা যায়নি,’ বলেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
৪১ বছর ইমামতি করা ইমামকে রাজকীয় বিদায়
ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে বিদেশি কর্মী, ভিসা নিয়ে বিতর্ক
আজও ঢাকার বাতাস ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’
মাদারীপুরের মুখে গামছা বাঁধা অবস্থায় শিশু শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের আধিপত্যবাদ রুখে দিবে: মিজানুর রহমান আজহারী
টেনিস বল ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টে অংশ নিতে নেপাল গেল সৈয়দপুরের দল
আকাশ মণ্ডল থেকে ইরফান, তদন্তে জানা গেলো আসল পরিচয়
পর্তুগালে জাসাসের ৪৬ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন
আজারবাইজানের বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ইউক্রেনকে দায়ী করলেন রুশ বিমান প্রধান
প্রকাশ্যে এলো হানি-বাদশার দ্বন্দ্ব, গুরুতর অভিযোগ হানির
বন্ধ হয়ে গেলো গাজার শেষ হাসপাতালটিও
মনমোহন সিংহ,ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়া এক সাহসী ও দৃঢ় সংকল্পের নেতা
জনগণের অংশগ্রহণেই নির্ধারিত হবে আমরা আসলে কী চাই : জোনায়েদ সাকি
নাগরিক কমিটির ৩৬ সদস্য বিশিষ্ট ‘নির্বাহী কমিটি’ ঘোষণা
সচিবালয়ের কাগজ ভেবে দুটি ট্রাক আটকালো জনতা
মাত্র সাত মাসেই হাফেজ হলেন ১০ বছরের আব্দুল্লাহ
সিরিয়ায় আসাদের পতন, ঘরে ফিরছে ৩০ হাজার শরণার্থী
কুড়িগ্রামের উলিপুরে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে যুবদল নেতা নিহত
ভুল তথ্যে চায়ের দোকানে ফায়ার সার্ভিস, অথচ পানের বরজ পুড়ে ছাই
আবারো উত্তপ্ত মণিপুরের দুই গ্রাম, সংঘর্ষে নিহত ১