ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বদলাচ্ছে মোদি সরকার?
১৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:৫৩ পিএম | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:৫৩ পিএম
ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত আইন প্রত্যাহার করে নতুন রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আনার প্রস্তাব দিয়েছে ভারতের মোদি সরকার। প্রস্তাবিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা যেমন চলতি আইনের থেকে অনেকটা প্রসারিত হয়েছে, তেমনই ন্যূনতম সাজার মেয়াদেও বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু যে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনেই পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে, তা নয়। ভারতের ফৌজদারী বিচার প্রক্রিয়াতেও পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে সংসদে পেশ করা বিলগুলিতে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহ সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন নিয়ে।
চলতি রাষ্ট্রদ্রোহ দমন আইনের কারণে বাক-স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল বলে সরকার যুক্তি দেখালেও আইনজীবীরা মনে করছেন প্রস্তাবিত আইনে সেই স্বাধীনতা আরও খর্ব হওয়ারই আশঙ্কা থাকছে। তাদের মতে প্রস্তাবিত রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি কঠোরতর। চলতি রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের যে অপব্যবহার হচ্ছে, সেটা একাধিক মামলার রায়ে উঠে এসেছে এবং আইনটির যে পরিবর্তন দরকার, সেটা কেন্দ্রীয় সরকারও সুপ্রিম কোর্টে জমা দেয়া এক হলফনামায় জানিয়েছিল। তারপরেই, গতবছর ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানার নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের এক বেঞ্চের নির্দেশে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে দায়ের করা সব বিচারাধীন মামলা, আপিল এবং সব আইনি প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে, যতদিন না ওই আইনটির পুনর্বিবেচনা শেষ করছে সরকার। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে চলতি রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে নতুন মামলা দায়ের করা থেকেও বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের ওই বেঞ্চ।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই সংসদের বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে তিনটি বিল পেশ করেন, যার মাধ্যমে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড বা আইপিসি, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড বা সিআরপিসি এবং ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট— এ তিনটি আইনের বদলে নতুন তিনটি আইন আনার কথা বলা হয়েছে। শাহের পেশ করা বিল অনুযায়ী, ভারতীয় দণ্ডবিধির নাম বদলে এবার সেটা হতে চলেছে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডের নাম হবে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা আর ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের প্রস্তাবিত নতুন নাম হবে ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম।
ফৌজদারি মামলার বিচার প্রক্রিয়া, সাক্ষ্য গ্রহণ আর সাজার মেয়াদ সবই নির্ভর করে আইপিসি, সিআরপিসি আর এভিডেন্স অ্যাক্টের ওপরে। নতুন নামে আইনগুলি আনার জন্য বিলটি পেশ করার পরেই সিলেক্ট কমিটিতে পাঠিয়ে দিয়েছে সরকার, যাতে বিস্তারিত আলোচনার পরে আবার পার্লামেন্টে ফিরিয়ে আনা যায় সেটিকে। বর্তমানে ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারাটিই এত বছর ধরে ভারতে ‘দেশদ্রোহ’ বা রাষ্ট্রদোহ’-এর মতো অপরাধের বিচার ও সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত।
আইন বদলের কারণ কী?
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে আইন পরিবর্তনের স্বপক্ষে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘যে সব আইনগুলি প্রত্যাহার করা হচ্ছে, সেগুলি ব্রিটিশ প্রশাসনকে রক্ষা আর শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহৃত হত। মূল ধারণাটা ছিল শাস্তি দেওয়ার, ন্যায় বিচার নয়। ওই আইনগুলি বদলিয়ে যে তিনটি নতুন আইন আনা হচ্ছে, তার মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত করার কথাই ভাবা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘লক্ষ্যটা শাস্তি দেয়া নয়, ন্যায় বিচার দেয়া। অপরাধ বন্ধ করার প্রবণতা গড়ে তোলার জন্য সাজা দেয়া হবে।’
ব্রিটিশ আমলের যে সব আইন প্রত্যাহার করে নতুন আইনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে সবথেকে বেশি আলোচনা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহ দমন আইনে পরিবর্তন নিয়ে। প্রস্তাবিত নতুন আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়টি রয়েছে ন্যায় সংহিতার ১৫০ নম্বর ধারায়। চলতি আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের যে সংজ্ঞা রয়েছে, প্রস্তাবিত আইনে সংজ্ঞাটি দীর্ঘতর হয়েছে। এখানে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি "জেনেশুনে মুখে বা লিখে, অথবা কোনও আকার-ইঙ্গিতে বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কিংবা অর্থনৈতিক ভাবে অথবা যেকোনও ভাবে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজকর্ম, সশস্ত্র বিদ্রোহ বা অন্তর্ঘাতমূলক কোনও কাজ করলে, যা ভারতের একতা, সার্বভৌমত্ব বা অখণ্ডতার জন্য বিপদ হয়ে উঠতে পারে," এরকম অপরাধের ক্ষেত্র কমপক্ষে সাত বছর আর সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন জেলের সাজার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞায় যে শব্দগুলি যোগ করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘বিচ্ছিন্নতা’, ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’, ‘অন্তর্ঘাতমূলক কাজ’, এই শব্দগুলি। বর্তমানে যে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন চালু আছে, তাতেও যাবজ্জীবন বা তিন বছরের সাজার কথা রয়েছে, সঙ্গে জরিমানাও হতে পারে অপরাধীর।
মানবাধিকার কর্মী ও বিভিন্ন হাইকোর্ট এবং সর্বোচ্চ আদালত অনেকদিন ধরেই ব্রিটিশ আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন পুনর্বিবেচনার কথা বলে আসছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করে যে বর্তমানে যে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন আছে, তার ব্যাপক অপপ্রয়োগ করা হয় সরকার বিরোধীদের ওপরে। ইন্ডিয়ান পেনাল কোড বা আইপিসি যখন আইনে পরিণত হয় ১৮৬০ সালে, সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহের বিষয়টি ছিল না। আইপিসিতে একটি সংশোধনী এনে ১৮৭০ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ যুক্ত করা হয়। এই আইনটি ১৮৪৮ সালের ইংলিশ ট্রিজন ফেলনি অ্যাক্ট অনুসারে তৈরি করা হয়, যাতে ভিন্নমত পোষণকারী, বিদ্রোহী কার্যকলাপ মোকাবিলা করা যায়।
ব্রিটিশ আমলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হত। তবে স্বাধীনতার পরেও এই আইনের প্রয়োগ চলতে থাকে, আবার বারেবারে বিভিন্ন আদালতে সরকার পক্ষকে রাষ্টদ্রোহিতার মামলা দেওয়ার জন্য সমালোচিতও হতে হয়েছে। অনলাইন পোর্টাল ‘আর্টিকেল ১৪’ তাদের এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে যে ২০১০ সাল থেকে আটশোটি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ১৩ হাজার মানুষের বিরুদ্ধে।
আবার জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে যেখানে ৪৭টি মামলা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহের, তার পাঁচ বছর পরে ২০১৯ সালে ৯৩টি মামলা দায়ের করা হয়। যদিও বিচারের পরে সাজা হয়েছে মাত্র তিন শতাংশ মামলায়। যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দেওয়া হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে, তাদের মধ্যে মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, ছাত্র নেতা, মুসলিম অ্যাক্টিভিস্ট সহ এমন ব্যক্তিরা রয়েছেন, যারা সরকারের নানা নীতি বা কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
আওয়ামীলীগ শাসনামলে যশোরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রদর্শিত অস্ত্রের কোনো হদিস নেই
যে আইন বাংলাদেশে চলে, সেই আইনে পার্বত্য অঞ্চলেও চলবে -কুমিল্লার সমাবেশে ফয়জুল করিম চরমোনাই
সীতাকু-ের বিতর্কিত সাবেক সহকারী কমিশনার চট্টগামের এডিসি হলেন
ফরাজীকান্দি নেদায়ে ইসলাম ওয়েসীয়ান ছাত্রদের উদ্যোগে ঈদে মিলাদুন্নাবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ র্যালি
ব্রুনাইয়ে ভবন থেকে পড়ে গফরগাঁওয়ের প্রবাসী নিহত
গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ
মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন
মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে
ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী
ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক আওয়ামী লীগ তা কখনও চায়নি : শিমুল বিশ্বাস
এনপি জনগণকে নিয়ে যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিবে- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এজেডএম ডাঃ জাহিদ হোসেন,