ঢাকা   শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৬ আশ্বিন ১৪৩১

৫০ বছর আগে তেলকে যেভাবে অস্ত্র বানিয়েছিল আরবরা

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

০৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৬:১৩ পিএম | আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৩, ০৬:১৩ পিএম

সউদী আরবের বাদশাহ ফয়সাল এবং মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত ইসরাইলকে সমর্থনকারী দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে সম্মত হন।

 

গত সাত অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার ঘটনায় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনে আবারও সহিংসতা শুরু হয়েছে। এই যুদ্ধের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যের বাকি অংশেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আজ থেকে ৫০ বছর আগে এইরকম এক সহিংসতার সময় তেল বিশেষ একটি অস্ত্র হয়ে উঠেছিল আরব দেশগুলোর জন্য।

 

বিশ্বে তথাকথিত সেই 'তেল সংকটের' পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। আজ মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্র যে এতোটা সমৃদ্ধ, সেটার ভিত্তি স্থাপন করেছিল তাদের শক্তিশালী তেল সম্পদ। সেই সময় ওই সংকট যুক্তরাষ্ট্রকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়ার মতো হুমকির সৃষ্টি করেছিল। ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরাইলের সাথে তাদের আরব প্রতিবেশীদের যতো যুদ্ধ বেধেছে তার মধ্যে একটি বড় ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে এই তেল।

 

ইয়োম কিপুর যুদ্ধে ইসরাইলকে অস্ত্র দিয়ে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের এই সিদ্ধান্তের কারণে মিশর এবং সিরিয়া, ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সেই সাথে সউদী আরবের নেতৃত্বে তেল রপ্তানিকারক আরব দেশগুলো ওয়াশিংটন এবং তার মিত্রদের উপর তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে সে সময় অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব অর্থনীতির ভীত নড়ে ওঠে।

 

আরব দেশগুলো সেই পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিল কীভাবে?

১৯৭৩ সালে গোটা বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন- উভয়ের নেতৃত্বে থাকা দেশগুলোর দুটি জোটের একটি স্নায়ু যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। যদিও উভয় শক্তি সরাসরি সামরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি। কিন্তু তাদের সমর্থনকারী তৃতীয় দেশগুলোর স্থানীয় সংঘর্ষে জড়িত হয়েছিল। তখন দুই মেরুতে বিভক্ত বিশ্বে বেশ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ সবাই ভয়ে ছিল দুটি পরাশক্তির মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।

 

তবে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন- দুই পরাশক্তি পুরোপুরি তেলের উপর নির্ভরশীল ছিল। এই তেলকে ব্ল্যাক গোল্ড বা কালো সোনাও বলা হতো। কারণ এই তেল শিল্প বিকাশের কারণে অটোমোবাইল বা গাড়ির সুবিধা সব স্তরের ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে যায়। তখন পর্যন্ত, তেল তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে বেশ সহজলভ্য ছিল।

 

কারণ সে সময় পশ্চিমা কোম্পানিগুলো তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো থেকে - বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সুবিধাজনক দামে তেল কিনতে পারতো। বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী হিসাবে মধ্যপ্রাচ্য ক্রমেই সারা দুনিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে আরব-ইসরাইল সংঘাত বেধে যায়। মধ্যপ্রাচ্য যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে সেটা ওই সংঘাতের সময়ই টের পেয়েছিল বিশ্ব।

 

কেন তেল সংকট শুরু হয়

ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের রক্তপাত বন্ধ করার জন্য ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অংশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় আন্দোলনকারীরা হেনরি কিসিঞ্জার নামে একজন ইহুদি কূটনীতিকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। যাকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তার নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। কেননা কিসিঞ্জারকে ওই সংঘাত বন্ধের জন্যই নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।

 

কিন্তু সদ্য ঘোষিত আরেকটি যুদ্ধ হঠাৎ করেই বিশ্বের নজর কেড়ে নেয়। ১৯৭৩ সালের ৬ই অক্টোবর, মিশর এবং সিরিয়ার নেতৃত্বে একটি আরব জোট ইসরাইলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণ শুরু করে। ইহুদিদের পবিত্র দিন ইয়োম কিপুরের ছুটির সময় থেকে সেই সংঘাত বেধে যায়। ওই যুদ্ধের মাধ্যমে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আনোয়ার আল-সাদাত এবং সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল-আসাদ, ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইলের দখলকৃত অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন।

 

মস্কো তাদের মিত্র দেশ সিরিয়া এবং মিশরের জন্য সামরিক সরবরাহ পাঠাতে শুরু করে। তখন নিক্সনও একটি সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। ওয়াশিংটন ইসরাইলে সামরিক সামগ্রী পাঠাতে শুরু করে, যা আরব বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। এগারো দিন পরে, আরবের তেল-রপ্তানিকারক দেশগুলো তাদের উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয়। এরপর তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরাইলকে সমর্থনকারী অন্যান্য দেশ যেমন নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়।

 

পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেক-এ নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় আছে সউদী আরব। ছয় অক্টোবরের সংঘাত শুরুর পর থেকে সউদী আরব তেলের উৎপাদন কমানোর পদক্ষেপ নিলে বিশ্ব এক দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে। তারপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র একটা শিক্ষা পেয়েছিল যে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহের বিষয়টিকে হেলাফেলা করা যাবে না। তৎকালীন সউদী বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ, এই পদক্ষেপের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন। যদিও অনেকে এর পেছনে মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আনোয়ার আল-সাদাতের ভূমিকা থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেন।

 

ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্র বা জিউইশ স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর পক্ষ সমর্থন করতো, তাহলে আল সাদাত কয়েক মাস আগেই পরিকল্পিতভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক হিসেবে বহু বছর কাজ করেছেন গ্রায়েম ব্যানারম্যান। তিনি বিবিসি মুন্ডোকে বলেছেন যে "সাদাত এবং ফয়সাল এতে সম্মত না হলে কখনই নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতো না।"

 

কানাডার ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বেসমা মোমানি বিবিসি মুন্ডোকে বলেন, “তখনকার আরব ঐক্যের চেতনা বর্তমান সময়ের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল।” “যে দেশগুলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তাদের ক্ষেত্রে মিশরের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা সামরিক শক্তির বাইরেও তেলের শক্তি আরেকটি বিকল্প হয়ে ওঠে।” “তারা বুঝতে পেরেছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা প্রশ্নে মধ্যপ্রাচ্যের এই তেল সম্পদ রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে।”

 

এরপর অনেক আলোচনার পর, ১৯৭১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য নির্ধারণ বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগ পর্যন্ত প্রতি আউন্স স্বর্ণের ভিত্তিতে ডলারের দাম নির্ধারিত হতো। ব্রেটন উডস অ্যাকর্ড অনুযায়ী, এই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি গড়েছিল। নিক্সনের এই পদক্ষেপের কারণে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা আগে মূলত ডলারে তেল বিক্রি করতো। কিন্তু গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড উঠে যাওয়ায় তারা তেলের নিশ্চিত মূল্য বুঝতে পারছিল না।

 

বরং তেলের দাম এমন একটি বিষয়ের উপর নির্ভর করেছিল যার কারণে তেলের মূল্য কেমন হতে পারে সে বিষয়ে ধারণা করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বিপরীতে অন্যান্য মুদ্রার মুক্ত বিনিময় হার বিষয়টিকে জটিল করে তোলে। বেশ কয়েকটি আরব দেশ, বহু বছর ধরে তাদের দাবিগুলোকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়ে আসছিল। কিন্তু অন্যরা, যেমন সউদী আরব নিজেই, এই আহ্বানে সাড়া দিতে রাজি হয়নি। সম্ভবত এই ভয়ে যে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তাদের পরিবর্তে বিকল্প তেল সরবরাহকারী খুঁজে পাবে।

 

স্পেনের মাদ্রিদের কমপ্লুটেন্স ইউনিভার্সিটির আরব এবং ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক ইগনাসিও আলভারেজ-ওসোরিও বিবিসি মুন্ডোকে বলেছেন যে “বাস্তবে বাদশাহ ফয়সাল অনেক ঘটনা প্রবাহের কারণে কিছুটা বাধ্য হয়ে এবং অনেকটা অনিচ্ছার সাথেই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ আলজেরিয়ার মতো অনেক দেশ আরও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছিল।" নিক্সন যখন আরব শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য ইসরাইলের গোল্ডা মেয়ার সরকারকে সামরিক সাহায্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, তখন তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিকল্পটি ব্যবহার করতে শুরু করে দেশগুলো। এতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ বিপদে পড়তে হয়।

 

তেল সংকট কি প্রভাব ফেলেছে?

নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার তাৎক্ষণিক প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম, যা সেই বছরের জুলাইয়ে দুই দশমিক ৯০ মার্কিন ডলার থাকলেও ডিসেম্বরে একলাফে বেড়ে ১১ দশমিক ৬৫ মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস স্টেশনগুলোতে পেট্রোল ফুরিয়ে যায় এবং জ্বালানি তেলের অপেক্ষায় কয়েক মাস ধরে অসংখ্য গাড়ি লাইন ধরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। এটি সেসময় একটি সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছিল। বেশ কয়েকটি রাজ্যে জ্বালানি রেশনিং ব্যবস্থা আরোপ করা হয়।

 

যে দেশের মানুষ মোটরচালিত যান ভালোবাসে, যে দেশে অটোমোবাইলকে স্বাধীনতার প্রতীক ধরা হয় এবং তথাকথিত আমেরিকান ড্রিমের মূল্যবোধ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়, সেখানে পেট্রোলের ঘাটতি ছিল এক নজিরবিহীন ধাক্কা এবং অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের কষাঘাত। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন কমে ছয় শতাংশে এবং বেকারত্ব দ্বিগুণ হয়ে নয় শতাংশে পৌঁছায়। দেশটির লাখ লাখ নাগরিক মন্দার পরিণতি কেমন হতে পারে তা অনুভব করেছিল।

 

দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) এর বিশ্লেষক এবং প্রাক্তন এজেন্ট ব্রুস রিডেলের মতে, সউদী আরবের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ে। ১৮১৫ সালে ব্রিটিশরা ওয়াশিংটনকে পুড়িয়ে দেওয়ার পর ওই প্রথম দেশটি এতোটা ক্ষতির মুখে পড়লো।” সেই সময় থেকে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ওই আরব দেশগুলোর রাজধানীতে বারবার ভ্রমণ করতে থাকেন যেন তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।

 

১৯৭৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সেই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। ততদিনে ইয়োম কিপুর যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। অনেক আমেরিকান পরিবার এবং বিভিন্ন দেশ থেকে তেল আমদানি করা কোম্পানিগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের জনজীবনে স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসে। নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলো যদিও এতে ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি ভাঙতে পারেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ধরে ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে গেছে। তবে তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্ব পরিচালনা ও মানুষের চিন্তা চেতনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটায় যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।

 

তেল সংকট এবং মূখ্য চরিত্রগুলো কীভাবে মিলিয়ে গিয়েছে

ইসরাইলে আক্রমণ চালানোর জন্য আনোয়ার আল-সাদাত যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন তা তিনি অর্জন করতে পারেনি। তবে তিনি ইসরাইলের নেতাদের এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তিনি সত্যিকারের সামরিক হুমকি তৈরি করতে পারেন। যার কারণে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় ১৯৭৮ সালে ঐতিহাসিক ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ওই চুক্তির আওতায় ইসরাইল তাদের দখলকৃত সিনাই উপদ্বীপ মিশরকে ফিরিয়ে দেয়।

 

ব্যানারম্যান মনে করেন যে "মার্কিন নীতির পরিবর্তন ছাড়া ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি কখনই সম্ভব হত না" যা নিষেধাজ্ঞা আরোপকে উস্কে দিয়েছে। সিনাই উপত্যকা ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে মিশর ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া প্রথম আরব দেশ হয়ে ওঠে। এমন এক সিদ্ধান্তের কারণে আল-সাদাত বেশিরভাগ আরব বিশ্বের কাছে অপছন্দের ব্যক্তিতে পরিণত হন। এই একই কারণে পশ্চিমা দেশগুলো তাকে মহান শান্তিবাদী নেতা হিসাবে দেখতে শুরু করে।

 

এর ধারাবাহিকতায় মিশর সোভিয়েত রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে পশ্চিমা দেশ ও ওয়াশিংটনের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কারণে পদত্যাগ করেন। তিনিই ইতিহাসের একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি কার্যালয় থেকে পদত্যাগ করেছেন। এরপর বাদশাহ ফয়সালকে তারই ভাতিজা হত্যা করে। রিয়াদে একটি রাজকীয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আততায়ী কিছু সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। ওই ঘটনার সাথে মার্কিন কেন্দ্রীয় সংস্থা সিআইএ জড়িত থাকতে পারে এমন সন্দেহ দানা বাধলেও তা কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

 

দীর্ঘ মেয়াদে তেল সংকটের কী পরিণতি হয়েছে?

সস্তা তেলের যুগ চিরতরে শেষ হয়ে যায় এবং এর দাম বৃদ্ধির বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা অর্জনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূচক হয়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালের ইরানী বিপ্লব বা ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলটি যতবারই অস্থিরতার সম্মুখীন হয়েছে, ততবার অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়েছে এবং বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার পরে, ওপেক এতদিন পর্যন্ত বিশ্বের জ্বালানি বাজারে একটি নমনীয় ভূমিকা পালন করলেও এই জোটে নতুন সদস্যরা যোগ হতে থাকলে সংস্থাটির আচরণ বেশ কঠোর হয়ে ওঠে।

 

তেলের উচ্চমূল্য ধরে রাখতে এবং প্রতিযোগিতা সীমাবদ্ধ রাখতে ওপেক তেল প্রস্তুতকারক বা সরবরাহকারীদের একটি শক্তিশালী সংস্থায় পরিণত হয়। এক কথায় ওপেক শক্তিশালী কার্টেল হিসাবে কাজ করতে শুরু করে। সংস্থাটি তাদের বিভিন্ন সভায় সদস্য দেশগুলোর তেল উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়। দেশগুলো বেশ গুরুত্বের সাথে সেই নিয়মগুলো মেনে চলে। অনেক উন্নয়নশীল দেশ যার মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশও রয়েছে- তাদের বিপুল তেল সম্পদ থাকলেও এই উৎস থেকে তারা এতদিন সেভাবে আয় করেনি।

 

কিন্তু বিশ্বব্যাপী তেলের বাণিজ্য লাভজনক হয়ে ওঠায় ওই উন্নয়নশীল দেশগুলো এতদিন যে দেরী করেছে তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য, তেল রপ্তানিকে তাদের আয়ের একটি উৎস হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান অটোমোবাইল শিল্প দিন দিন ভারী কিন্তু কম জ্বালানী নির্ভর গাড়ি তৈরিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আরও দক্ষ মডেলের গাড়ির চাহিদা বাড়ে। এই প্রবণতা ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে ছোট আকারের, সস্তা গাড়িতে বাজার ছেয়ে যায়।

 

তেলের জন্য আরব দেশগুলোর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা বিপদ ডেকে আনতে পারে এমন উপলব্ধি থেকে পশ্চিমা দেশগুলো বিকল্প তেলের উৎস খুঁজতে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। এ সংক্রান্ত গবেষণাকে উৎসাহ দিতে থাকে। হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচারিং প্রযুক্তি বিকাশ লাভের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৫ সালের পর থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি কমিয়ে ফেলে। ২০২০ সালে এসে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ তেল রপ্তানি করছে তার চেয়ে কম তেল আমদানি করতে হচ্ছে।

 

তবে এই তেল বাণিজ্যের কারণে বিশ্বের যে অঞ্চলটি সবচেয়ে নাটকীয়ভাবে বদলে গিয়েছে তা হল মধ্যপ্রাচ্য। বিশেষ করে পারস্য উপসাগরীয় এলাকায় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। তেলের দাম বৃদ্ধি এবং জাতীয়করণের কারণে ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ এর দশকে ওই অঞ্চলের তেল রপ্তানিকারক প্রধান দেশগুলো যেমন: কুয়েত, সউদী আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রচুর আয় করতে শুরু করে। ওই আয়ের কারণেই আজ তারা বিশাল সম্পদের পাহাড় গড়তে পেরেছে। এসব দেশ আজ যে সমৃদ্ধি ভোগ করছে তার গাঁথুনি হয়েছিল কঠোর তেল বাণিজ্যের সময় থেকেই।

 

তারপর থেকে, যুক্তরাষ্ট্র সউদী আরবের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ নীতি বজায় রেখে চলছে। যার কারণেই হয়তো সাম্প্রতিক সময়ে ওপেক নতুন করে তেলের উৎপাদন কমানোর পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছে। না হলে বিশ্বব্যাপী অপরিশোধিত তেল আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠত। ওয়াশিংটন-রিয়াদের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূত্রপাতও হয়েছে '৭৩-এর নিষেধাজ্ঞার পর থেকে। তেলের অব্যাহত প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট সউদীদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে।

 

এর মাধ্যমে রিয়াদ একটি বড় ইসলামী শক্তি হিসেবে তাদের অবস্থানকে সুসংহত করেছে যা এর আগ পর্যন্ত ছিল না। সময়ের সাথে সাথে সউদী আরব আয়াতুল্লাহর ইরানের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। তেলের অর্থ দিয়ে সউদী আরব তাদের দেশের মানুষের জীবনমানের উন্নতি নিশ্চিত করেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে, তাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছে এবং অন্যান্য দেশে ওয়াহাবিবাদকে ছড়িয়ে দিয়েছে।

 

ইসলামের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি ধারণকারীদের ওয়াহাবি দর্শনের অনুসারী বলা হয়, যা সউদী আরবে বেশ প্রাধান্য রয়েছে। পঞ্চাশ বছর পরে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এলে বিশ্ব তেলের প্রতি আসক্তি কমাতে রাজি হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তেলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যারা তেল উৎপাদন করে, যাদের ভিত্তি ১৯৭০-এর দশকে স্থাপিত হয়েছে. তারা যে এখনও শক্তিশালী অবস্থানে আছে- তা ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধের সময় টের পেয়েছে বিশ্ব। কারণ তখন থেকে অপরিশোধিত তেলের দাম আবারও বেড়ে যায়। আজ, সউদী তেল কোম্পানি আরামকো অ্যাপলের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃত এবং চলতি বছর এটি ১৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেকর্ড মুনাফা অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। সূত্র: বিবিসি।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

শপথ নিলেন অতিশী, মমতার পর দ্বিতীয় মহিলা মুখ্যমন্ত্রী পেল ভারত

শপথ নিলেন অতিশী, মমতার পর দ্বিতীয় মহিলা মুখ্যমন্ত্রী পেল ভারত

মালয়েশিয়ায় নাইট ক্লাবে স্ফূর্তি করতে গিয়ে আটক ৫ বাংলাদেশি

মালয়েশিয়ায় নাইট ক্লাবে স্ফূর্তি করতে গিয়ে আটক ৫ বাংলাদেশি

নতুন রেকর্ড সোনার দামে, ভরি ১৩৩০৫১ টাকা

নতুন রেকর্ড সোনার দামে, ভরি ১৩৩০৫১ টাকা

সিলেটে একদিনে বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু

সিলেটে একদিনে বজ্রপাতে ৪ জনের মৃত্যু

কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জহুরুল হক

কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন মসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জহুরুল হক

শেখ হাসিনা সকল দপ্তরের টাকা লুট করে আমানত খেয়ানত করেছে : নোয়াখালীতে শিবির সভাপতি

শেখ হাসিনা সকল দপ্তরের টাকা লুট করে আমানত খেয়ানত করেছে : নোয়াখালীতে শিবির সভাপতি

ইসলামী ছাত্র মজলিসের নির্বাচন সম্পন্ন--রায়হান সভাপতি ও ইমরান সেক্রেটারি নির্বাচিত

ইসলামী ছাত্র মজলিসের নির্বাচন সম্পন্ন--রায়হান সভাপতি ও ইমরান সেক্রেটারি নির্বাচিত

হাজীগঞ্জে বিএনপি'র দুই গ্রুপের সংঘর্ষে চিকিৎসাধীন কিশোরের মৃত্যু

হাজীগঞ্জে বিএনপি'র দুই গ্রুপের সংঘর্ষে চিকিৎসাধীন কিশোরের মৃত্যু

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই-ধর্ম উপদেষ্টা

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই-ধর্ম উপদেষ্টা

নয়ন মিয়ার আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না : যুবদল সভাপতি মুন্না

নয়ন মিয়ার আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না : যুবদল সভাপতি মুন্না

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে আওয়ামীলীগের পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগে আওয়ামীলীগের পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার

একই কর্মস্থলে অর্ধ যুগ কাটিয়েছেন পিআইও রেজা, করেছেন প্রকল্পের টাকা হরিলুট

একই কর্মস্থলে অর্ধ যুগ কাটিয়েছেন পিআইও রেজা, করেছেন প্রকল্পের টাকা হরিলুট

আওয়ামীলীগ শাসনামলে যশোরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রদর্শিত অস্ত্রের কোনো হদিস নেই

আওয়ামীলীগ শাসনামলে যশোরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে প্রদর্শিত অস্ত্রের কোনো হদিস নেই

যে আইন বাংলাদেশে চলে, সেই আইনে পার্বত্য অঞ্চলেও চলবে -কুমিল্লার সমাবেশে ফয়জুল করিম চরমোনাই

যে আইন বাংলাদেশে চলে, সেই আইনে পার্বত্য অঞ্চলেও চলবে -কুমিল্লার সমাবেশে ফয়জুল করিম চরমোনাই

সীতাকু-ের বিতর্কিত সাবেক সহকারী কমিশনার চট্টগামের এডিসি হলেন

সীতাকু-ের বিতর্কিত সাবেক সহকারী কমিশনার চট্টগামের এডিসি হলেন

ফরাজীকান্দি নেদায়ে ইসলাম ওয়েসীয়ান ছাত্রদের উদ্যোগে  ঈদে মিলাদুন্নাবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ র‌্যালি

ফরাজীকান্দি নেদায়ে ইসলাম ওয়েসীয়ান ছাত্রদের উদ্যোগে ঈদে মিলাদুন্নাবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ র‌্যালি

ব্রুনাইয়ে ভবন থেকে পড়ে গফরগাঁওয়ের প্রবাসী নিহত

ব্রুনাইয়ে ভবন থেকে পড়ে গফরগাঁওয়ের প্রবাসী নিহত

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে