আরাকান আর্মির সাফল্যে রোহিঙ্গাদের কোন লাভ হবে?
১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:১৩ পিএম | আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:১৩ পিএম
বেশ দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের পরিস্থিতি। সেখানে একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। বিভিন্ন জায়গায় নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে জান্তা সরকার। এই পটভূমিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাখাইনে আরাকান আর্মির শক্ত অবস্থান রোহিঙ্গা সমস্যার ক্ষেত্রে একটা 'উভয় সংকট' তৈরি করতে পারে।
প্রায় দেড় বছর আগে আরাকান আর্মির একজন মুখপাত্র অনলাইন বক্তব্যে দাবি করেছিলেন যে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তারা অন্যতম স্টেকহোল্ডার বা অংশীদার। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে রিপোর্টও হয়েছিল। প্রশ্ন হলো – আরকান আর্মি রাখাইন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিলে সেটি রোহিঙ্গা সংকটকে কোন দিকে নিয়ে যাবে?
বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সম্প্রতি দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। এই অঞ্চলটির নাম পালেতোয়া, যেটি মিয়ানমারের চিন রাজ্যে অবস্থান। এই জায়গাটির দূরত্ব বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটারের মতো। মিয়ানমারের যে তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আরাকান আর্মি।
গত নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে বলেছেন, দেশটির শান রাজ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পুরো দেশই ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির প্রভাব এখন বাড়তে শুরু করেছে। রাখাইন অঞ্চল থেকে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে আরো সাত বছর আগে। কিন্তু সেই সংকট সমাধানের কোন কূলকিনারা হচ্ছেনা।
'উভয় সংকট হতে পারে'
রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব যত বাড়বে ভূরাজনীতি তত বেশি জটিল হবার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ তাদের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে, ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে একরকম স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন। রাখাইন অঞ্চলে জান্তা সরকারের কর্তৃত্ব দুর্বল করে আরাকান আর্মির প্রভাব বাড়তে থাকলে সেটি রোহিঙ্গা সংকটের জন্য ‘শাঁখের করাত’ হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন মনে করেন, রাখাইন অঞ্চলে জান্তা সরকারকে হটিয়ে দিয়ে আরাকান আর্মি যদি শক্ত অবস্থান নেয় তাহলে রোহিঙ্গা সংকটের জন্য ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যে কোনও কিছুই হতে পারে। আরাকান আর্মি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার পুরনো নাম ছিল হারাকাহ আল-ইয়াকিন। অবশ্য আরাকান আর্মির রাজনৈতিক শাখা ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান গঠিত হয় ২০০৯ সালে।
আরাকান আর্মি কখন সামরিক তৎপরতা শুরু করে সেটি নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে ধারণা করা হয় ২০১৫ সাল থেকে পালেতোয়া টাউনশিপ এলাকায় তাদের সামরিক তৎপরতা দেখা যায়। সেনাবাহিনীর সাথে তারা গত কয়েক বছর ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে এবং এই সময়ে রাখাইন রাজ্য ও পার্শ্ববর্তী চিন রাজ্যে নিজেদের অবস্থানকে সংহত করতে সমর্থ হয়েছে।
এমনকি সেনাবাহিনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতা দখলের আগে থেকেই রাখাইনে তাদের ভিত মজবুত ছিলো। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে তাদের তৎপরতা ছিল। আরাকান আর্মির তৎপরতা যেখানে রয়েছে সেখানে অধিকাংশ রোহিঙ্গা মুসলিম বসবাস করে। দুই বছর আগে তারা দাবি করে, রাজ্যটির ৬০ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে।
ব্রাসেলস-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-এর একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মির নেতৃত্ব রোহিঙ্গাদের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছে। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের শত্রু হিসেবে দেখে না। যদিও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনা আরাকান আর্মি।
তবে পরিস্থিতি আরো জটিল হবার সম্ভাবনা বেশি দেখছেন এম সাখাওয়াত হোসেন। সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোন অগ্রগতি হবেনা। রাখাইন অঞ্চলের মংডু এবং রথিডং থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সে সব এলাকায় আরাকান আর্মির সাথে সৈন্যদের সাথে মাঝে মধ্যেই সংঘাত চলছে। পরিস্থিতি যেদিকে এগুচ্ছে তাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি মোটেও ইতিবাচক কিছু নয় বলে মনে করেন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম।
তিনি একসময় সিটোয়েতে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকটকে অনেকে অনেকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। সেটি আরাকান আর্মির দিক থেকেও হতে পারে আবার মিয়ানমার জান্তা সরকারের দিক থেকেও হতে পারে। ‘আরাকান আর্মি যদি রাখাইন অঞ্চলের একটি বড় অংশ দখলে নিয়েও আসে তাহলে তারা বলবে না যে এখন রোহিঙ্গারা চলে আসুক। বরং মিয়ানমার জান্তা বলবে যে এখানে রোহিঙ্গাদের ফিরে আসার পরিবেশ নেই’, বলেন ইসলাম।
তিনি মনে করেন, আরাকান আর্মি রাখাইন অঞ্চলে যতটুকু জায়গা দখল করেছে সেটি সাময়িক ব্যাপার এবং সেটি তারা দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে পারবে না। এর কারণ হচ্ছে মিয়ানমার আর্মির শক্তি বিদ্রোহীদের চেয়ে অনেক বেশি।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা
মিয়ানমারে যে কোনও ধরনের পরিবর্তন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের উপর প্রভাব তৈরি করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না বলেও মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা গত কয়েক বছর ধরেই দৃশ্যমান। সেখানে একের পর এক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে।
ক্যাম্পের বসবাসরত সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভাষ্য হচ্ছে – সেখানে বর্তমানে দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। একটি হচ্ছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা ‘আরসা’ এবং অপরটি হচ্ছে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা ‘আরএসও’। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আরএসও’র সাথে আরাকান আর্মির সুসম্পর্ক আছে। অন্যদিকে আরসাকে মনে করা হয় আরাকান আর্মির বিরোধী শক্তি।
রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মির প্রভাব বাড়লে সেটি আরএসওকে শক্তিশালী করবে। ফলে আরসার সাথে তাদের সংঘাত আরো বাড়বে বলে আশংকা করছেন অনেকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরসা ও আরএসও'র তৎপরতা এখন আর অজানা বিষয় নয়। দুই বছর আগে বাংলাদেশের পুলিশ দাবি করেছিলে যে আরসা'র প্রধান মোহাম্মদ আতাউল্লাহর ভাইকে উখিয়া থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী গত ডিসেম্বর মাসের গোড়ার দিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা ও আরএসও-র মধ্যে গোলাগুলিতে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছে। মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম মনে করেন, সশস্ত্র সংগঠন 'আরসা' মিয়ানমার জান্তা সরকারের হয়ে কাজ করে। সেজন্য ক্যাম্পগুলোতে তারা কোনভাবেই আরএসওকে স্থান দেবেনা।
জটিল হচ্ছে ভূরাজনীতি
আরাকান আর্মির প্রতি ভারতের কোন সমর্থন নেই। তবে তাদের প্রতি চীনের সমর্থন আছে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।সীমান্ত লাগোয়া পালেতোয়ায় ভারতের অর্থায়নে কোটি কোটি ডলারের উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। দূরবর্তী অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নত করতে সেখানে বিনিয়োগ করেছে ভারত।
‘আরাকান আর্মি যে জায়গাটি দখল করে নিয়েছে সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আরাকান আর্মি যেসব জায়গা দখল করছে সেগুলো ভারতের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে যাচ্ছে না,’ বলেন এম সাখাওয়াত হোসেন। রাখাইন রাজ্যে চীনের গভীর সমুদ্র বন্দর ও গ্যাস পাইপলাইনসহ বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে।
‘রাখাইন অঞ্চলে চীন তার স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে এক ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।’ মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে ভারত এবং চীনের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে সেটির উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে বলে মনে করেন মি, হোসেন।
আরাকান আর্মি এখনও পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় যতগুলো আক্রমণ করেছে সেগুলো সবই ভারতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে, চীনের বিরুদ্ধে নয়। মেজর এমদাদুল ইসলাম বলছেন, এখন মিয়ানমারের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটি অনেকটাই নীর্ভর করছে চীনের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত
দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান
ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই
বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪
পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা
মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি
জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী
মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান
বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির
একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১
কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু
সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক
‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান
যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ
ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১
ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী
মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে
মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন
গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ