লাল গালিচা, ডুবুরি আর একলা সন্ন্যাসী - ভারতের নির্বাচনের ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪৫ এএম | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪৫ এএম

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত মোট সাতটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে ১৮ তম সংসদীয় নির্বাচন। দেশটির নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৯৬ কোটি, তারাই বেছে নেবেন ৫৪৩টি লোকসভা আসন থেকে কারা পার্লামেন্টে যাবেন।

 

ভারতে নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসও বলে, অতীতে তারা মাত্র একজন ভোটারের জন্য কিংবা দেশের প্রত্যন্ত কোনও প্রান্তে হাতেগানা কয়েকজন ভোটারের কাছে পৌঁছানোর জন্য যে পরিমাণ মেহনত করেছে বা ঝুঁকি নিয়েছে – তা প্রায় চোখ কপালে তুলে দেয়ার মতো। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে এমনই তিনটি বিশেষ ঘটনার – যেখানে দেশের নির্বাচন কমিশন কয়েকজন বিশেষ ভোটারের কাছে পৌঁছতে নজিরবিহীন নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। যাকে ভারতের সবচেয়ে পুরনো ভোটার বলে মনে করা হত, বয়সজনিত কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর কমিশন এক সময় তার বাড়ি গিয়েও মিছিল করে তাকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে এসেছে – যাতে তাকে দেখে বাকিরাও ভোট দিতে অনুপ্রাণিত হন।

 

ভারতে দুর্গমতম এলাকায় এমন কিছু গ্রামও রয়েছে, যেখানে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করার জন্য কমিশনকে পেশাদার ডুবুরি নিয়ে যেতে হয়! হাতির পিঠে চেপে, অথবা খচ্চরের ওপর মালপত্র চাপিয়ে বুথে যাওয়ার নজিরও বিরল নয়। আবার গভীর জঙ্গলের ভেতরে মাত্র একজন ভোটারের জন্য আলাদা ভোটকেন্দ্র তৈরি করারও দৃষ্টান্ত এই ভারতেই আছে। সেই সব বিচিত্র ঘটনারই বিবরণ থাকছে এই প্রতিবেদনে।

 

শ্যামশরণ নেগিকে ছাড়া এই প্রথম ভোট

স্বাধীনতার পর এই প্রথম ভারতে কোনও সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে যাতে শ্যামশরণ নেগি ভোট দেবেন না! যারা এই নামটির সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের জানানো যেতে পারে শ্যামশরণ নেগি-কে ‘ভারতের প্রথম ভোটার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তিনি ছিলেন পার্বত্য রাজ্য হিমাচল প্রদেশের দুর্গম কল্পা অঞ্চলের বাসিন্দা। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে ১০৫ বছর বয়সে শ্যামশরণ নেগির মৃত্যু হয়। শতবর্ষী এই অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের মৃত্যুর পর প্রকাশ্য জনসভায় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কল্পাতে তার গ্রামে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শ্যামশরণ নেগির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল।

 

এই বিরল সম্মানে তাকে শেষ বিদায় জানানো হয়েছিল, কারণ শ্যামশরণ নেগি সম্ভবত ভারতের একমাত্র নাগরিক – যিনি এ যাবত দেশে হওয়া সবগুলো সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের এপ্রিলে দেশে প্রথম লোকসভা গঠনের প্রায় পাঁচ মাস আগে ভোটগ্রহণ হয়েছিল হিমাচলের কল্পায়, কারণ গোটা শীতকালটাই হিমালয়ের ওই অঞ্চলটা ঢেকে থাকে পুরু বরফের চাদরে। তখনই জীবনে প্রথমবার স্বাধীন ভারতের সংসদীয় নির্বাচনে ভোট দেন শ্যামশরণ নেগি। তিনি তখন সদ্য তিরিশ পেরোনো একজন যুবক।

 

সেবারেরটা নিয়ে মোট ১৭ বার ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন মি নেগি। একবারের জন্যও সেই সুযোগ মিস করেননি – আর শেষবার লোকসভার জন্য তিনি ভোট দিয়েছেন ২০১৯ সালের গ্রীষ্মে। সেবার নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা তার বাড়িতে এসে রীতিমতো মিছিল করে নেগিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন পোলিং বুথে। পথে রীতিমতো কাঁসর-বাদ্য বাজিয়ে ও হিমাচলের সাবেকি রীতিতে তাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগেও তিনি একটি নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন – সেটা ছিল ২০২২ সালে হিমাচল প্রদেশের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন।

 

ডুবুরি নিয়ে পোলিং বুথে!

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মেঘালয়ের ওয়েস্ট জৈন্তিয়া হিলস জেলার এক প্রান্তে, ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে কামসিং নামে একটি গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সারিগোয়াইন নদী, যার মাঝবরাবর টানা হয়েছে সীমান্তরেখা। নদীর ঠিক অন্য পারে, কামসিং-এর উল্টোদিকে বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলা।

 

এই প্রতিবেদনে অখ্যাত কামসিং গ্রামের কথা বলতে হচ্ছে, কারণ ভোটের সময় ভারতের সবচেয়ে প্রত্যন্ত বা দুর্গমতম প্রান্তে নির্বাচন কমিশনকে যে পোলিং বুথগুলো স্থাপন করতে হয় তার অন্যতম হল এই কামসিং। কামসিং গ্রামে মোটরগাড়িতে চেপে পৌঁছনোর কোনও উপায় নেই। কারণ সেখানে কোনও রাস্তাই নেই। জেলা সদর জোওয়াই থেকে গ্রামটি ৬৯ কিলোমিটার দূরে, আর সবচেয়ে কাছাকাছি মহকুমা বা তহসিলদার অফিস যে আমলারেমে, সেটাও কামসিং থেকে অন্তত ৪৪ কিলোমিটার দূরে।

 

কামসিং-এ পৌঁছনোর একমাত্র রাস্তা হল সারিগোয়াইন নদী বেয়ে ছোট, সরু দেশি নৌকায় ঘন্টাখানেক ধরে চলা। ফলে প্রতিবার ভোটের সময় নির্বাচন কমিশনকে নৌকাতে করেই ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ও ইভিএম-সহ ভোটের সব সরঞ্জাম কামসিং গ্রামের পোলিং বুথে পাঠাতে হয়। নির্বাচন কমিশনের একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ‘কামসিং-এ যাওয়ার সময় নৌকাতে আমাদের পোলিং অফিসারদের সবাইকে লাইফ জ্যাকেট পরতে হয়।’ ভারতের কোনও প্রান্তে একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য অভিজ্ঞ ও পেশাদার ডুবুরিদেরও সঙ্গে যেতে হচ্ছে – এমন দৃষ্টান্ত সারা দেশে আর একটিও নেই!

 

জঙ্গলে একলা সন্ন্যাসীর পোলিং বুথ

ভারতের গুজরাটে ‘গির ফরেস্ট’ হল সারা পৃথিবীতেই এশিয়াটিক লায়ন প্রজাতির শেষ টিঁকে থাকা আবাসভূমি। সিংহের এই অভয়ারণ্যে, গির-এর গভীর জঙ্গলের ভেতরে সেই ২০০৭ সাল থেকে নির্বাচন কমিশন প্রতিবার ভোট এলেই একটি বিশেষ ভোটগ্রহণ কেন্দ্র তৈরি করে আসছে, এবারেও যার ব্যতিক্রম হবে না। জঙ্গলের ভেতরে ‘বানেজ’ নামে একটি জায়গার কাছে ওই পোলিং বুথটিতে মাত্র একজনই নথিভুক্ত ভোটার – তার নাম মহন্ত হরিদাসজী উদাসীন।

 

আসলে ওই জঙ্গলের ভেতরে রয়েছে হিন্দুদের একটি প্রাচীন শিবমন্দির। মহন্তজি ওই মন্দিরের পুরোহিত এবং উদাসীন আখড়ার একজন সন্ন্যাসী। মন্দির প্রাঙ্গণে হরিদাস উদাসীন একাই থাকেন। ওই জঙ্গলের ত্রিসীমানায় আর কোনও জনবসতি নেই – ফলে অনেকটা অঞ্চল জুড়ে তিনিই হলেন একমাত্র ভোটার। এরকম অদ্ভুত সব ঘটনা, অভিনব নানা পদক্ষেপ আর চোখ কপালে তোলা পরিসংখ্যানই যে ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে এত বর্ণময় ও বৈচিত্রপূর্ণ করে তুলেছে তাতে কোনও সন্দেহই নেই। সূত্র: বিবিসি।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের ২০ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর
রুপির দাম তলানিতে, নিয়ন্ত্রণে যে সিদ্ধান্ত নিলো ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএফডির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না
ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড কানাডার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী?
টানা তৃতীয় বছরের মতো চীনের জনসংখ্যা কমল
আরও

আরও পড়ুন

"গুপ্ত হত্যা, গুম ও ক্রসফায়ার ছিলো শেখ হাসিনার অত্যন্ত প্রিয়" : রিজভী

"গুপ্ত হত্যা, গুম ও ক্রসফায়ার ছিলো শেখ হাসিনার অত্যন্ত প্রিয়" : রিজভী

জনতার বাজার মনোপলি সিন্ডিকেটের ঊর্ধ্বে থাকবে- ঢাকা জেলা প্রশাসক

জনতার বাজার মনোপলি সিন্ডিকেটের ঊর্ধ্বে থাকবে- ঢাকা জেলা প্রশাসক

শুল্ক বৃদ্ধিতে জনগণের ওপর চরম চাপ বাড়বে: মির্জা ফখরুল

শুল্ক বৃদ্ধিতে জনগণের ওপর চরম চাপ বাড়বে: মির্জা ফখরুল

গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চলের কৃষকের স্বপ্ন এখন ইরি-বোরোয়

গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চলের কৃষকের স্বপ্ন এখন ইরি-বোরোয়

রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের ২০ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর

রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের ২০ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর

জাতীয় কবির নাতি দগ্ধ, আইসিইউতে ভর্তি

জাতীয় কবির নাতি দগ্ধ, আইসিইউতে ভর্তি

উখিয়ায় অবৈধভাবে মাটি কাটার দায়ে ১ জনকে ১০ দিনের সাজা, ট্রাক ও এক্সেভেটর মেশিন জব্দ

উখিয়ায় অবৈধভাবে মাটি কাটার দায়ে ১ জনকে ১০ দিনের সাজা, ট্রাক ও এক্সেভেটর মেশিন জব্দ

নগরকান্দায় ২ গ্রামবাসীর সংঘর্ষে পুলিশ সাংবাদিক নারীসহ আহত অর্ধশত

নগরকান্দায় ২ গ্রামবাসীর সংঘর্ষে পুলিশ সাংবাদিক নারীসহ আহত অর্ধশত

দুষ্ট লোকেরা বলে, আ’লীগকে প্রধান বিরোধীদল হিসেবে দেখতে চায় বিএনপি: শহীদুজ্জামান

দুষ্ট লোকেরা বলে, আ’লীগকে প্রধান বিরোধীদল হিসেবে দেখতে চায় বিএনপি: শহীদুজ্জামান

কটিয়াদীতে তারুণ্যের উৎসব ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত

কটিয়াদীতে তারুণ্যের উৎসব ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত

রুপির দাম তলানিতে, নিয়ন্ত্রণে যে সিদ্ধান্ত নিলো ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক

রুপির দাম তলানিতে, নিয়ন্ত্রণে যে সিদ্ধান্ত নিলো ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক

অবিবেচকভাবে ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে: ড. দেবপ্রিয়

অবিবেচকভাবে ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে: ড. দেবপ্রিয়

‘উন্নয়নের অংশীদার, প্রবাসীরাও দাবিদার’ শ্লোগানে রিয়াদে প্রবাস মেলা’র ১১ বর্ষে পদার্পণ ‍উদযাপন

‘উন্নয়নের অংশীদার, প্রবাসীরাও দাবিদার’ শ্লোগানে রিয়াদে প্রবাস মেলা’র ১১ বর্ষে পদার্পণ ‍উদযাপন

এবার বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস গ্রেপ্তার

এবার বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস গ্রেপ্তার

হিলিতে ব্যাডমিন্টন ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে

হিলিতে ব্যাডমিন্টন ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে

ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএফডির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না

ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএফডির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি: দোয়া চাইলেন তারেক রহমান

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবনতি: দোয়া চাইলেন তারেক রহমান

মাঘের শুরুতে আবার আসছে শৈত্যপ্রবাহ

মাঘের শুরুতে আবার আসছে শৈত্যপ্রবাহ

আজহারীর মাহফিলের আগের রাতেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ

আজহারীর মাহফিলের আগের রাতেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ

আজ ঢাকার বাতাস ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’, শীর্ষে করাচিতে

আজ ঢাকার বাতাস ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’, শীর্ষে করাচিতে