কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে কেন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায় না?

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম | আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম

 

 

 

জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে ফিলিস্তিনকে পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা দেয়ার বিষয়ে সম্প্রতি এক ভোটাভুটি হয়। যাতে ভেটো দেয় যু্ক্তরাষ্ট্র, কিন্তু নিরাপত্তা কাউন্সিলের ১২টি সদস্য দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়, যার মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্রের তিন মিত্র– ফ্রান্স, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড এতে ভোট প্রদানে বিরত থাকে।

 

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রদানকে ‘অনৈতিক’ বলে বর্ণনা করেন, আবার ইসরাইল জাতিসংঘের এই প্রস্তাবকেই লজ্জাজনক বলে অভিহিত করে। ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদের অনুরোধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিল এই ভোটের আয়োজন করে। কাউন্সিলের ১৫ সদস্যকে এই বিষয়ে খসড়া প্রস্তাবে ভোট দেয়ার আহবান জানানো হয়, আলজেরিয়ার উত্থাপিত এই প্রস্তাবে বলা হয়, “ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেয়া হোক”।

 

পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং তাদের প্রত্যেকের ভেটো দেয়ার ক্ষমতা আছে। কাউন্সিলের বাকি ১০টি অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র। যদি নিরাপত্তা কাউন্সিলে এ প্রস্তাব পাশ হতো, তাহলে সাধারণ পরিষদে এ নিয়ে ভোট হতো, এবং ফিলিস্তিনের সদস্য হতে সেখানে দুই তৃতীয়াংশ ভোট হলেই চলতো। কিন্তু সে চেষ্টায় পানি ঢেলে দেয় ইসরাইলের দীর্ঘদিনের মিত্র যু্ক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা কাউন্সিলে যে কোনো খসড়া প্রস্তাব পাশ হওয়ার জন্য পাঁচ সদস্যেরই ভোট লাগবে– যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স কোনো একটি সদস্য ভেটো দিলেই প্রস্তাবটি আটকে যাবে।

 

ভোটের পর জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি অ্যাম্বাসেডর রবার্ট উড কাউন্সিলকে বলেন: ‘যুক্তরাষ্ট্র দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের সমাধান মনে প্রাণে সমর্থন করে। আমাদের এই ভোট ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিপক্ষে নয়, বরং এটা যে কেবল সব পক্ষের আলোচনার মাধ্যমেই আসতে হবে সেটাই বোঝানো হয়েছে।’

 

জাতিসংঘে এখন ফিলিস্তিনি অঞ্চলের স্বীকৃতি কী?

সদস্য নয়, ফিলিস্তিনিদের এই মুহূর্তে স্বীকৃতি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে। ২০১১ সালে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদের জন্য আবেদন করে, কিন্তু নিরাপত্তা কাউন্সিলের যথেষ্ট সমর্থন না থাকায় তা গ্রহণ হয়নি এবং এর আগে কখনো ভোটাভুটিও হয়নি। কিন্তু ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে ভোটের মাধ্যমে “নন-মেম্বার অবজারভার স্টেট” হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যা তাদের অধিবেশনের বিতর্কে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়, যদিও তারা জাতিসংঘে ভোটের অধিকার পায় না।

 

কিন্তু এই ২০১২ সালের সিদ্ধান্ত– যা পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকাজুড়ে উদযাপিত হয় এবং ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা সমালোচিত হয়, ফিলিস্তিনকে অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত হওয়ার পথ খুলে দেয়, যার মধ্যে আছে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত, দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট– আইসিসি। ২০১৫ সালে ফিলিস্তিন এর সদস্য হয়।

 

“জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হওয়াটা ফিলিস্তিনের কূটনৈতিক সামর্থ্য আরও বাড়িয়ে দেবে, তারা তখন নিজেরাই সরাসরি কোনো প্রস্তাব আনতে পারবে, সাধারণ অধিবেশনে ভোট দিতে পারবে এবং হয়তো একসময় নিরাপত্তা কাউন্সিলেরও সদস্য হতে পারবে,” বলেন ওয়াশিংটন ভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিন-ইসরাইল বিষয়ক প্রোগ্রামের পরিচালক খালেদ এলগিনদি। “তবে এর কোনো কিছুই দুই রাষ্ট্রের সমাধান এনে দেবে না– সেটা আসবে কেবলমাত্র ইসরাইলের দখলদারিত্ব শেষ হলে,” যোগ করেন তিনি।

 

সব মিলিয়ে প্রায় ১৪০টি দেশ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে মেনে নেয়, যাদের মধ্যে আছে জাতিসংঘের আরব গ্রুপের সদস্যরা, দ্য অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশন এবং নন অ্যালাইনড মুভমেন্টের সদস্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া এমন আরো অনেক দেশই আছে যারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকার করে না। তবে গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া জানায় ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে “দুই রাষ্ট্রের সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে” তারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে পারে।

 

এদিকে গত মাসে স্পেন, আয়ারল্যান্ড, মাল্টা ও স্লোভেনিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এক শীর্ষ সম্মেলনের মাঝে আলাদা করে এক বিবৃতি দিয়ে জানায় তারা একসাথে মিলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে কাজ করবে যখন “সঠিক সময় ও পরিস্থিতি আসবে।” “তবে এতে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়,” বলেন, ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের সিনিয়র পলিসি ফেলো হিউ লোভাট, “আর তা হলো যদি জাতিসংঘে স্বীকৃতির রাস্তা যুক্তরাষ্ট্র বন্ধ করে রাখে তাহলে কী অন্য সদস্যরা বিশেষ করে এসব ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এগুবে?

 

 

কেন কিছু দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয় না?

যেসব দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না, তাদের সিদ্ধান্তের পেছনে সাধারণত কারণ হলো- ইসরাইলের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের কোনো বোঝাপড়ায় না আসা।

 

“যদিও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় শুধু সমর্থনই যথেষ্ট, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র জোর দেয় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সরাসরি আলোচনায়, যেটি আসলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পথে ইসরাইলকে বাধা দেবার ক্ষমতায় দিয়ে দিয়েছে,” এমনটা মনে করেন লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিকসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক রাজনীতির অধ্যাপক ফাওয়াজ গের্গেস।

 

১৯৯০ সালে শান্তি আলোচনার শুরু, এরপর দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের মাধ্যমে সমাধানের চিন্তা, যেখানে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন আলাদা দেশে পাশাপাশি বাস করতে পারে।

 

কিন্তু ২০০০ সালের শুরু থেকেই শান্তি আলোচনা ধীরে ধীরে ব্যর্থ হতে থাকে, আর ২০১৪ সালে ওয়াশিংটনে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের আলোচনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়। দুই দেশের সীমানা, ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রকৃতি, জেরুসালেমের কী হবে এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ভবিষ্যতই বা কী এমন সব জটিল ইস্যুগুলো নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

 

ইসরাইল দ্ব্যর্থহীনভাবে ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের সদস্য হবার ভোটের বিষয়টির বিরোধিতা করে। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরাইলের দূত গিলাদ এরদান এপ্রিলের শুরুর দিকে এএফপিকে বলেন এ নিয়ে আলোচনা হওয়াটাই “গণহত্যাকারী সন্ত্রাসীদের জন্য একরকম বিজয়”, আরো যোগ করেন এই প্রস্তাব পাশ হলে সেটা হবে ৭ই অক্টোবর হামাসের সন্ত্রাসী হামলার একটা পুরস্কারের মতো।

 

যেসব দেশের ইসরাইলের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক তারাও সচেতন যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিলে তাদের অন্য মিত্রদের সেটা অখুশি করতে পারে।

 

ইসরাইলের কিছু সমর্থকসহ অনেকেই মনে করেন, ১৯৩৩ সালের মন্টেভিডিও কনভেনশন অনুযায়ী রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা ফিলিস্তিন তার মধ্যে পড়ে না, যেমন- স্থায়ী জনগোষ্ঠী, একটি নির্দিষ্ট সীমানা, সরকার ও অন্য দেশের সাথে সম্পর্কে যাওয়ার সামর্থ্য এসব। তবে অনেকে আবার এর চেয়ে রাষ্ট্রের নমনীয় সংজ্ঞা গ্রহণে আগ্রহী ও অন্য রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃতির উপর জোর দিয়ে থাকেন। সূত্র: বিবিসি।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নারাইন নৈপুণ্যে লাক্ষ্মৌর বিপক্ষে বড় জয়ে শীর্ষে কলকাতা

নারাইন নৈপুণ্যে লাক্ষ্মৌর বিপক্ষে বড় জয়ে শীর্ষে কলকাতা

লিভারপুলের বিপক্ষে হেরে অস্বস্তিতে টটেনহ্যাম

লিভারপুলের বিপক্ষে হেরে অস্বস্তিতে টটেনহ্যাম

অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি, ঋণের ঝুঁকি ও প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি

অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি, ঋণের ঝুঁকি ও প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি

ডিবি কার্যালয়ে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী

ডিবি কার্যালয়ে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী

লক্ষ্যটা নাগালেই রাখল বাংলাদেশ

লক্ষ্যটা নাগালেই রাখল বাংলাদেশ

ইসলামী শিক্ষা নিয়ে যে কোন দূরভিসন্ধি রুখে দিতে হবে পীর সাহেব চরমোনাই

ইসলামী শিক্ষা নিয়ে যে কোন দূরভিসন্ধি রুখে দিতে হবে পীর সাহেব চরমোনাই

জনসমর্থন না থাকায় বিএনপি নির্বাচন থেকে দূরে থাকছে: কুষ্টিয়ায় হানিফ

জনসমর্থন না থাকায় বিএনপি নির্বাচন থেকে দূরে থাকছে: কুষ্টিয়ায় হানিফ

উখিয়া ক্যাম্পে এক রোহিঙ্গা যুবককে জবাই করে হত্যা

উখিয়া ক্যাম্পে এক রোহিঙ্গা যুবককে জবাই করে হত্যা

ইসলামবিরোধী হিন্দুত্ববাদী কারিকুলাম প্রত্যাখ্যান করুন

ইসলামবিরোধী হিন্দুত্ববাদী কারিকুলাম প্রত্যাখ্যান করুন

শাহজালালে তিনদিন ৩ ঘণ্টা করে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ

শাহজালালে তিনদিন ৩ ঘণ্টা করে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ

মুস্তাফিজকে ছাড়াই চেন্নাইয়ের বড় জয়

মুস্তাফিজকে ছাড়াই চেন্নাইয়ের বড় জয়

সুদহার শিগগিরই বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে: গভর্নর

সুদহার শিগগিরই বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে: গভর্নর

মোদির মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণায় এবার উপজীব্য ভোট জিহাদ, তারপর কী?

মোদির মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণায় এবার উপজীব্য ভোট জিহাদ, তারপর কী?

‘বিশ্ব কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য দিবস ২০২৪’ পালন করলো এনার্জিপ্যাক

‘বিশ্ব কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য দিবস ২০২৪’ পালন করলো এনার্জিপ্যাক

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি. এর শরি‘আহ্ সুপারভাইজরি কমিটির ৪৪তম সভা অনুষ্ঠিত

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি. এর শরি‘আহ্ সুপারভাইজরি কমিটির ৪৪তম সভা অনুষ্ঠিত

দুই দিনে সোনার দাম বাড়ল ১৭৮৫ টাকা

দুই দিনে সোনার দাম বাড়ল ১৭৮৫ টাকা

এসআই পদে বয়সসীমা ৩০ করা হোক

এসআই পদে বয়সসীমা ৩০ করা হোক

ইউরোপীয় রাজনীতিতে শরণার্থী প্রসঙ্গ

ইউরোপীয় রাজনীতিতে শরণার্থী প্রসঙ্গ

হিন্দুত্ববাদের কবলে আমাদের পাঠ্যবই

হিন্দুত্ববাদের কবলে আমাদের পাঠ্যবই

রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব কী?

রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব কী?