যেভাবে ভারতের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল হিন্দু জাতীয়তাবাদ
১২ মে ২০২৪, ০২:৪২ পিএম | আপডেট: ১২ মে ২০২৪, ০২:৪২ পিএম
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের কয়েক ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হবে ১ জুন। তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আশায় দিন গুণছেন নরেন্দ্র মোদী। যে কয়টি বিষয়ের ওপর মোদী এবং তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি’র জনপ্রিয়তা ভর করে আছে তার অন্যতম হিন্দু জাতীয়তাবাদী আদর্শ বা হিন্দুত্ব। এই আদর্শের কট্টর সমর্থকরা একটি হিন্দু ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র চান যেখানে হিন্দুদের চাওয়া-পাওয়া অগ্রাধিকার পাবে।
সমালোচকরা এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে বৈষম্যমূলক এবং পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশটিতে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য হুমকি বলে মনে করেন। মোদীর শাসনামলে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এবং আক্রমণ বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ করে থাকেন অনেক মুসলিম। যদিও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কোনো খারাপ পরিস্থিতিরি শিকার হয়েছেন, সেটি স্বীকার করতে নারাজ বিজেপি।
ধর্ম ও জাতীয়তাবাদকে এক করে দেখা হয় হিন্দুত্বে। মনে করা হয়, হিন্দু ধর্মীয় পরিচয় এবং ভারতীয় জাতীয় পরিচয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হিন্দুত্ব শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবর্তক চন্দ্রনাথ বসু। ১৮৯০ সালের দিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সংগ্রামের সময়টাতে ধারণাটি আলোচনায় আসে।
তবে এটি জনপ্রিয়তা পায় আরো দুই দশক পরে, উপনিবেশ-বিরোধী রাজনীতিবিদ বিনায়ক দামোদর সাভারকারের হাত ধরে। সাভারকারকে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের জনক হিসেবেও দেখা হয়। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ কারাগারে বসে ‘এসেনশিয়ালস্ অফ হিন্দুত্ব’ নামে একটি পুস্তিকা লেখেন তিনি। সেখানে সিন্ধু উপত্যকাকে তিনি ‘হিন্দু আইডেনটিটি’র জন্মস্থান হিসেবে উল্লেখ করেন।
নিজেকে নাস্তিক দাবি করলেও, তিনি বিশ্বাস করতেন ওই অঞ্চলের সঙ্গে হিন্দুদের সংযোগটা কেবল ধর্মের নয় বরং এথনিক বা নৃতাত্ত্বিক যার সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় জড়িয়ে আছে। ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে লিপ্ত অনেক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটি হয়ে ওঠে হিন্দু জাতীয়তাবাদ।
এমনকি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও তার বক্তব্য সাধারণের কাছে সহজবোধ্য করে তুলতে ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করতেন। বিবিসিকে এ তথ্য জানান লন্ডনের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিউটের ডিরেক্টর অধ্যাপক সুবীর সিনহা।
কিন্তু, গান্ধী ও সাভারকারের পথ ছিল ভিন্ন। অধ্যাপক সিনহা এবং আরো অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সাভারকার সেই সময়ে বিকাশ লাভ করা ফ্যাসিবাদ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। সিনহা বলেন, “হিন্দুত্ব’র শুরুর দিককার নেতৃত্ব প্রকাশ্যেই মুসোলিনি এবং হিটলারের প্রশংসা করতেন।” তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি এই আকর্ষণের কারণ, “তারা কে জার্মান আর কে জার্মান নন তার একটা সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছিলেন”, বলছিলেন অধ্যাপক সুবীর সিনহা।
ভারত কি একটি হিন্দু রাষ্ট্র?
২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী, ভারতের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দু এবং ১৪ শতাংশ মুসলিম। এছাড়া, খ্রিষ্টান, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন এবং অন্যান্য সম্প্রদায় মিলে বাকি জনসংখ্যার বাকি ছয় শতাংশ। সেক্যুলারজিম বা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে ভারতের সংবিধানে। যার মানে, রাষ্ট্রক্ষমতা কোনো ধর্মের প্রতি আনুগত্য দেখাতে বাধ্য নয় এবং সকল ভারতীয় নাগরিকের নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। কিন্তু, ধর্মের ভূমিকা ক্রমশই স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে।
বিরোধীদের অভিযোগ, মোদী এবং বিজেপি’র হিন্দু-ফার্স্ট নীতি সেক্যুলারিজমের ভিত্তিটাকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। যদিও, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও লেখক সরোজ চাধার মতো কোনো কোনো ভারতীয় মনে করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগণের প্রতি ওপরের কাঠামোর সমর্থনের নীতি, ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ। তার যুক্তি, প্রাচীন হিন্দু রাজারা হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা করে এসেছেন, “হিন্দু ধর্মকে রক্ষায় নিজেদের অঙ্গীকার এবং দায়িত্বশীলতাকে অবিচল রেখেই”। তার ভাষায়, “এটাই সম্ভবত সেক্যুলারিজমের সবচেয়ে ভালো রূপ”।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ বিজেপি’র মূল নীতিগুলোর অন্যতম। দলটির শেকড় জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ শাসনের সময় গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) মতো হিন্দু পুনর্জাগরণের আন্দোলনগুলোতে। আরএসএস কট্টর ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেজেওয়ার ব্যাপকভাবে সাভারকারের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে তিনবার নিষিদ্ধ করা হয় সংগঠনটিকে। প্রথমবার ১৯৪৮ সালে, প্রাক্তন আরএসএস সদস্য নাথুরাম গডসের হাতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নিহত হওয়ার পর। তারপর আবার ১৯৭৫ সালে, যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন। সেসময় প্রায় সব বিরোধী নেতাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল।
আরএসএসকে তৃতীয়বারের মতো নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৯২ সালে। সে বছর কট্টর হিন্দু সংগঠনগুলো ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত বাবরি মসজিদটি ভাঙে। বর্তমানে, আরএসএসকে বিজেপি’র আদর্শিক উৎস হিসেবে দেখা হয়। তৃণমুল পর্যায়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব দুটোই আছে তাদের।
আট বছর বয়স থেকে আরএসএসের সাথে যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকেই, দলটি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে জোরেশোরে সামনে নিয়ে আসতে শুরু করে। ওয়াশিংটন ডিসির কার্নেগি এনডোমেন্টের পরিচালক মিলন বৈষ্ণব ব্যাখ্যা করে বলেন, “অনেক দিক থেকে তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদের একজন আদর্শ মুখপাত্র। কারণ তিনি সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাসী এবং আন্দোলনটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।”
কী ঘটছে?
বিজেপি’র কোনো কোনো নীতি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে টানাপোড়েন বাড়িয়েছে। ২০১৯ সালে সরকার মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য জম্মু ও কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা বাতিল করে। দেশের অন্যান্য অংশের সাথে সমতা আনার জন্য এটি করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
এ বছরের জানুয়ারিতে, হিন্দুদের দেবতা রামের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত অযোধ্যায়, ঠিক ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের স্থানটিতেই রাম মন্দির উদ্বোধন করেছেন মোদী। বিরোধীদের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীদের কেউ কেউ নিয়মিতই জ্বালাময়ী, ইসলামোফোবিক উপমা দিয়ে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন।
এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২১শে এপ্রিল রাজস্থানে তার একটি নির্বাচনি জনসভায় ধর্মের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। এরপর দুইদিনে দুইটি পৃথক সভায় আবার ধর্মের প্রসঙ্গ তোলেন। রাজস্থানের জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী বলেন, "‘যাদের বেশি বেশি ছেলেমেয়ে আছে’ বিরোধী কংগ্রেস তাদের মধ্যেই দেশের ধনসম্পদ ভাগবাঁটোয়ারা করে দিতে চায়।"
এসময় মুসলিম শব্দটি ব্যবহার না করে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। যা নিয়ে সমালোচনারও শিকার হন তিনি। এছাড়াও, বিভিন্ন সময় মুসলিমদের ওপর আক্রমণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে এবং মুসলিম-বিরোধী হেইট স্পিচ বা বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তাও বেড়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়া হেইট ল্যাবের তথ্য অনুয়ায়ী, ২০২৩ সালে ভারতে প্রকাশ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো ঘটনাগুলোর এক তৃতীয়াংশই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে ঘটেছে।
হিন্দুত্বের সমর্থকদের মধ্যে মধ্যপন্থী থেকে চরমপন্থী, বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ রয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর ঘটনাও ঘটছে। এমন তৎপরতায় সম্পৃক্ত একজনের সাথে ২০২২ সালে কথা হয় বিবিসি বাংলার। তিনি মুসলিমদের ঘৃণা করেন না দাবি করে বলেন, “শুধু তারা যেভাবে তাদের ধর্মপালন করে সেটা নিয়েই আমার আপত্তি”।
কোনো কোনো হিন্দু ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির ব্যাপারে কিছু না জেনেই এর মূল্যবোধগুলোকে গ্রহণ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ - কেউ কেউ মনে করেন ভারত হিন্দুদের দেশ ছিল। পরে সেটা তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। ইসলামিক শোনায় এমন নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নামকরণকে স্বাগত জানায় তারা। যেমন – আওরঙ্গাবাদের নাম পাল্টে শম্ভাজিনগর রাখা হয়। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৫৩
বিএনপি মুক্ত সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী নামমাত্র মূল্যে কক্সবাজার প্রেসক্লাবের জমি বন্দোবস্তি দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া
সচিবালয়ে আগুন: গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতাকে দায়ী করলো এবি পার্টি
পরকীয়া প্রেমের ঘটনায় গৌরনদীতে উপ-সহকারী ২ কৃষি কর্মকর্তা এলাকাবাসীর হাতে আটক
‘প্রতিবন্ধীদের সংগঠন ও সম্পদ দখল করে পতিত সরকারের শিল্পমন্ত্রীর কন্যা’
আশিয়ান সিটির স্টলে বুকিং দিলেই মিলছে ল্যাপটপ
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি পরিকল্পিত নাশকতা: ইসলামী আইনজীবী পরিষদ
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
লামায় ১৭টি ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বসতঘর পুড়ে ছাই হওয়ার ঘটনায় ৪জন গ্রেপ্তার
বিজয় দিবস টেনিস শুক্রবার শুরু
আশুলিয়ায় ভাড়াটিয়া তাড়িয়ে জোরপূর্বক জমি দখলের অভিযোগ
আজানের জবাব দেওয়া প্রসঙ্গে।
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে নাকে খত দেওয়ার ঘটনায় মামলা
শরীয়তপুরে শ্রমিক দলের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ
হেঁটে টেকনাফ গেলেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাসেদুল
বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে সম্পাদিত গোপন চুক্তি বাতিল চেয়ে আইনি নোটিশ!
বাগেরহাটে জেলা একীভূত চক্ষু সেবা কর্মসূচির এডভোকেসি সভা অনুষ্ঠিত
সাতক্ষীরায় বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল