হিমালয়ে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করছেন লাদাখের আইসম্যান

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

৩০ জুন ২০২৪, ১১:৪৮ এএম | আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪, ১১:৪৮ এএম

ভারতের লাদাখের কৃষকদের সেচের জন্য পানির যোগান দিতে কৃত্রিম হিমবাহ বানিয়েছেন এক স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত এই এলাকায় তুষারপাত এবং বৃষ্টির পরিমাণ কমে গিয়েছে।

 

ভারতের উত্তরে অবস্থিত লাদাখের থিকসে গ্রামের বাসিন্দা ডোলকর। তার পরিবারের সদস্যরা কয়েক প্রজন্ম ধরে এই একই পেশায় রয়েছেন। ‘আমার মনে আছে ছেলেবেলায় এখানে প্রচুর বরফ পড়ত। প্রায় আমার হাটুর সমান উঁচু হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর তেমন বৃষ্টি বা তুষারপাত হয় না,’ বলেছেন ৫৮ বছরের ডোলকর পেশায় আলু চাষি।

 

বছরের পর বছর ধরে তার পরিবারের আয় ক্রমশ হ্রাস পেতে দেখেছেন ডোলকর-ঠিক যেমন ভাবে তার গ্রামকে ঘিরে থাকা পাহাড়ের বরফের টুপির মতো অংশকে চোখের সামনে একটু একটু করে গলে যেতে দেখেছেন। লাদাখের রাজধানী লেহ থেকে ১৯ কিলোমিটার (১১.৮ মাইল) পূর্বে অবস্থিত থিকসে। ‘আলু চাষ করে আমরা প্রতি মাসে ৭০ হাজার টাকা আয় করতাম। কিন্তু এখন ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি আয় করি।’

 

হিমালয় পর্বতমালার প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জুড়ে আছে ৫৫ হাজার হিমবাহ, যা পৃথিবীর বৃহত্তর (মেরু ক্যাপের বাইরে) বরফে আবৃত অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন কিন্তু হিমালয় পর্বতমালার বাস্তুতন্ত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে প্রভাবিত হচ্ছে এই অঞ্চলের অর্থনীতি, বাস্তুসংস্থান এবং পরিবেশও। এভাবে চলতে থাকলে আগামী শতাব্দীর শেষ নাগাদ হিমালয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হিমবাহ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

 

এর তীব্র প্রভাব পড়বে এশিয়ার নদী ব্যবস্থার উপর যা প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের জন্য পানি সরবরাহ করে। প্রভাব পড়বে ফসল উৎপাদন ও জীবিকার উপরেও। হিমবাহের বরফ গলা পানির উপর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১২ কোটি ৯০ লাখ কৃষক। তেমনই একটা অঞ্চল হলো ভারতের উত্তরাংশে অবস্থিত লাদাখ যেখানে ডোলকরের বাড়ি।

 

ঠান্ডা এবং শুষ্ক জলবায়ুযুক্ত লাদাখে বছরে ন্যূনতম বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আনুমানিক ৮৬.৮ মিমি (৩.৪ ইঞ্চি)। এই অঞ্চলের ৮০ শতাংশ কৃষক সেচের জন্য হিমবাহের বরফ গলা পানির উপর নির্ভর করে।

 

এদিকে, গত ৩০ বছরে, তুষারপাতের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। যার ফলে তুষার আচ্ছাদন হ্রাস পেয়েছে। যে কারণে হিমবাহ পশ্চাদপসরণ করেছে, প্রবাহে পানির পরিমাণ অপর্যাপ্ত হয়েছে এবং হিমালয় অঞ্চলের গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র পানির ঘাটতি।

 

কিন্তু ডোলকরের গ্রামে এই সংকট মোকাবিলা করার জন্য একটা উদ্ভাবনী কৌশল বের করেছেন একজন স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ার। থিকসের কাছেই নাং নামের এক গ্রামে কৃত্রিম হিমবাহ নির্মাণ করেছেন ওই ইঞ্জিনিয়ার । নাম ছেওয়াং নোরফেল। তিনি অবশ্য লাদাখের ‘আইস ম্যান’ বলেই পরিচিত।

 

তার পেশাগত কাজের অংশ হিসাবে, স্থানীয় বাসিন্দাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘুরতে হতো তাকে। সেই সময় নোরফেল আবিষ্কার করেন ৮০ শতাংশ কৃষক চাষের জন্য পানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

 

হিমবাহের বরফ গলা পানি যা চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে প্রবাহিত হতে শুরু করে যদিও বীজ বপনের মরসুম শুরু হয় এপ্রিল মাসে। দীর্ঘ শীতের কারণে অব্যবহৃত হিমবাহের বরফ গলা পানি স্থানীয় ঝোরাতে বয়ে যেতে থাকে।

 

ওই পানি যা স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য অত্যাবশ্যক সম্পদ, তা সংরক্ষণের জন্য একটা কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন নোরফেল। ধীরে ধীরে লাদাখের আরও ১০টা গ্রামে কৃত্রিম হিমবাহ তৈরী করে ফেলেন তিনি। নাং ওই গ্রামগুলোর মধ্যে একটা। লাদাখ অঞ্চলের লেহ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার (১৮.৬ মাইল) দূরে নাং গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,৭৮০ মিটার (১২,৪০২ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত।

 

এই গ্রামে বাস করেন মাত্র ৩৩৪ জন যাদের প্রাথমিক জীবিকা হল কৃষি। মূলত আলু এবং গম চাষ করেন তারা। এই অঞ্চলের অনেক গ্রামের মতোই, নাংয়ে কোনও স্থায়ী হিমবাহ নেই এবং পানি সরবরাহের উৎস প্রাকৃতিক ঝর্ণা এবং স্থানীয় ঝোরা। তবে তার পানি চাষের জন্য যথেষ্ট নয়। বীজ বপনের মরসুমে বিশেষত এপ্রিল এবং মে মাসে কৃষি কাজের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির যোগান দরকার।

 

চাষের জন্য বিশেষত বসন্তকালে গম, আলু এবং অন্যান্য ফসলের সেচের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ তইরি করে। কারণ গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত হিমবাহের বরফ গলে না। অনিশ্চিত আবহাওয়ার কারণে স্থানীয় কৃষকরা পরের বছরের জন্য তাদের কৃষিকার্যের পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলেন। অনিশ্চয়তা তাদের ভাবতে বাধ্য করেছিল আগামী মরসুমের জন্য আদৌ বীজ বপন করবেন কি না।

 

এতে একদিকে যেমন অনিশ্চয়তার কারণে বপন না করলে সম্ভাব্য আয় হ্রাসের ঝুঁকি থাকে, তেমনই বীজ বপন করার পর পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়। তার সম্প্রদায়ের মানুষেরা উপর যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে তা নজর এড়ায়নি ৮৭ বছরের ছেওয়াং নোরফেলের।

 

পেশায় ইঞ্জিনিয়ার এবং সাবেক গ্রামোন্নয়ন কর্মকর্তা, একটা অভিনব কৌশল বের করেন যাতে ফলনে ঘাটতি না হয়, কৃষকেরা ক্ষতির শিকার না হন আর একইসঙ্গে হিমবাহকে তাদের গ্রামের ‘কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়’। তিনি বলেন, ‘মূল হিমবাহ থেকে পানি পাওয়া শুরু হয় জুন মাস থেকে। আমরা পানি বানাতে পারব না। সুতরাং আমাদের কাছে থাকা উৎসকে ব্যবহার করাটাই হলো একমাত্র বিকল্প পথ।’

 

নোরফেল জানিয়েছেন যে হিমবাহের পানিকে সম্পদ হিসাবে ব্যবহার করার চিন্তাটা মাথায় এসেছিল এমন একটা জায়গা থেকে, যেখানে এমন একটা ভাবনা আসার কথা তিনি একেবারেই কল্পনা করেননি। বাড়ির পিছনের বাগানের একটা কল দেখে এই অভিনব কৌশল মাথায় আসে তার। তার কথায়, ‘শীতকালে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে আমরা কল চালু রাখি। নয়তো পাইপে পানি জমে সেটা ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।’

 

তবে এই পানি থাকে না। নোরফেল চালু করা কলের নিচে তৈরি হওয়া পাতলা বরফের একটি ছোট চাদর লক্ষ্য করেন। কলের নীচে ছায়ায় ঢাকা জায়গায় পানি জমে জমে বরফ হয়ে গেছে, কারণ ওই অংশে সরাসরি রোদ্দুর পড়েনি। ছেওয়াং নোরফেল বুঝতে পারেন তিনি যদি নষ্ট হওয়া পানি ধরে রাখতে এবং জমাতে সক্ষম হন তা হলে পুরো গ্রামের জন্য কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করা যাবে।

 

গ্রামবাসীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে সুকৌশলে বিভিন্ন উচ্চতায় কৃত্রিম হিমবাহ তৈরি করেন তিনি। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী, গ্রামের সবচেয়ে কাছের হিমবাহ যা সর্বনিম্ন উচ্চতায় অবস্থিত তার বরফ প্রথমে গলবে। বসন্তে কালে প্রাথমিক বপনের সময় প্রয়োজনীয় সেচের পানি সরবরাহ করে এই কৃত্রিম হিমবাহের বরফ গলা পানি।

 

তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে আরও বেশি উচ্চতায় থাকা পরবর্তী কৃত্রিম হিমবাহ গলতে শুরু করলে তা নিচের জমিতে সেচের জন্য অবিচ্ছিন্ন ও সময়মতো পানির সরবরাহ নিশ্চিত করবে।

 

কৃত্রিম হিমবাহ তৈরির এই কাজ আরও দক্ষতার সঙ্গে প্রসারিত করতে ১৯৯৫ সালে অলাভজনক সংস্থার সঙ্গে হাত মেলান নোরফেল। তার কৃতিত্বের জন্য প্রশংসাও অর্জন করেছেন। এই তালিকায় রয়েছে পদ্মশ্রী যা ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বেসামরিক পুরস্কার। সূত্র: বিবিসি।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

তুরস্কের মন্ত্রিসভায় রদবদল

তুরস্কের মন্ত্রিসভায় রদবদল

চলতি মাসে বজ্রঝড়-লঘুচাপ-নিম্নচাপ-তাপপ্রবাহ-বন্যা- সবই হতে পারে

চলতি মাসে বজ্রঝড়-লঘুচাপ-নিম্নচাপ-তাপপ্রবাহ-বন্যা- সবই হতে পারে

বাগেরহাটে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

বাগেরহাটে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছে ৭০০ পর্যটক

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছে ৭০০ পর্যটক

রূপগঞ্জে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বাড়ি ঘিরে রেখেছে এটিইউ

রূপগঞ্জে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বাড়ি ঘিরে রেখেছে এটিইউ

৭২ শতাংশ ব্রিটিশ সুনাককে আর চান না : জরিপ

৭২ শতাংশ ব্রিটিশ সুনাককে আর চান না : জরিপ

ইমরান খানের গ্রেপ্তার বিধিবহির্ভূত, আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন : ওয়ার্কিং গ্রুপ

ইমরান খানের গ্রেপ্তার বিধিবহির্ভূত, আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন : ওয়ার্কিং গ্রুপ

৪ ঘণ্টা পর খাগড়াছড়ির সঙ্গে যান চলাচল স্বাভাবিক

৪ ঘণ্টা পর খাগড়াছড়ির সঙ্গে যান চলাচল স্বাভাবিক

পেকুয়ায় পৃথক ঘটনায় দুই যুবকের মৃত্যু

পেকুয়ায় পৃথক ঘটনায় দুই যুবকের মৃত্যু

টানা বৃষ্টিতে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ টি ইউনিটে ১৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে

টানা বৃষ্টিতে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ টি ইউনিটে ১৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে

সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দাখিল ও প্রকাশ চেয়ে রিটের শুনানি আজ

সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দাখিল ও প্রকাশ চেয়ে রিটের শুনানি আজ

কাজে যোগ দেননি এখনো, বরখাস্ত হতে পারেন মতিউর

কাজে যোগ দেননি এখনো, বরখাস্ত হতে পারেন মতিউর

পর্তুগাল আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন'২৪ উপলক্ষে প্রস্তুতি সভা

পর্তুগাল আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন'২৪ উপলক্ষে প্রস্তুতি সভা

এইচএসসি: ফেনীর দুই উপজেলায় মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত

এইচএসসি: ফেনীর দুই উপজেলায় মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত

সিউলে পথচারীদের ওপর উঠে গেল বেপরোয়া গাড়ি, নিহত ৯

সিউলে পথচারীদের ওপর উঠে গেল বেপরোয়া গাড়ি, নিহত ৯

এশিয়ান ন্যাটো সৃষ্টির চেষ্টা: যুদ্ধ ও অস্ত্র বিক্রির মার্কিন ফন্দি

এশিয়ান ন্যাটো সৃষ্টির চেষ্টা: যুদ্ধ ও অস্ত্র বিক্রির মার্কিন ফন্দি

দেশে ফিরেছেন ৪০ হাজার ১১৫ হাজি, মৃত্যু ৫৭ বাংলাদেশির

দেশে ফিরেছেন ৪০ হাজার ১১৫ হাজি, মৃত্যু ৫৭ বাংলাদেশির

এলপি গ্যাসের নতুন মূল্য ঘোষণা বিকেলে

এলপি গ্যাসের নতুন মূল্য ঘোষণা বিকেলে

ট্রাম্পের দায়মুক্তি : রায়কে ‘বিপজ্জনক নজির’ বললেন বাইডেন

ট্রাম্পের দায়মুক্তি : রায়কে ‘বিপজ্জনক নজির’ বললেন বাইডেন

হংকংয়ে যাচ্ছে আরও এক জোড়া পান্ডা

হংকংয়ে যাচ্ছে আরও এক জোড়া পান্ডা