জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যের ব্যবস্থা, পরিবেশের ক্ষতি এড়ানোর মতো একাধিক চ্যালেঞ্জ সামলাতে আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা অভিনব এক পথ বেছে নিয়েছে। বহুমুখী এই উদ্যোগের সুফলও পাওয়া যাচ্ছে।

তাঁবুর অন্ধকার ও আর্দ্র পরিবেশে সেমাগাম্বো এভারিস্তে এমন এক খাদ্যপণ্য চাষ করছেন, যা রুয়ান্ডার খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি ঘটাতে পারে। সেটা হলো অয়েস্টার মাশরুম। মাশরুম চাষি হিসেবে সেমাগাম্বো এভারিস্তে নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘‘আমি পাঁচ বছর ধরে মাশরুম চাষ করছি। এটা ঘটনা, যে অন্যান্য শস্য থেকে এর অনেক দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। চাষ শুরু করার পর নয় থেকে পনেরো দিনের মধ্যে মাশরুম বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। সে তুলনায় অন্যান্য শস্য তোলার জন্য পাঁচ থেকে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়। মোটকথা মাশরুমের ক্ষেত্রে মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায়ই উপার্জন করা যায়। অতএব অন্যান্য শস্যের তুলনায় মাশরুমের বাড়তি সুবিধা রয়েছে।''

সেমাগাম্বো রুগারামা গ্রামে মাশরুম চাষ করেন। কিগালি ফার্মস এমন ১৫টি গ্রামে সহায়তা দেয়। সেই প্রতিষ্ঠান প্রায় ৭০০ ছোট চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তারা তাঁবুগুলিও বিশেষভাবে তৈরি করিয়ে দিয়েছে। চাষিরা বিনামূল্যে সেগুলি ব্যবহার করতে পারেন। কিগালি ফার্মস উৎপাদন ও বাণিজ্যিক বিপণনের ক্ষেত্রেও সহায়তা করে।

২০১০ সালে লোরঁ দেমোইনক সেই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তার আগে তিনি নিউ ইয়র্কে এক মাইক্রোব্রিউয়ারি চালাতেন। কিন্তু তিনি আফ্রিকায় বাস করে তৃণমূল স্তরে টেকসই কোনো কাজ করতে চেয়েছিলেন। তখনই তিনি এই প্রেরণা পান। লোরঁ বলেন, ‘‘মাইসেলিয়াম রানিং. হাউ ক্যান মাশরুম হেল্প সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড নামের একটি বই দেখে ভাবলাম বাড়াবাড়ি আশা করা হচ্ছে। মাশরুম আবার কীভাবে জগত বাঁচাতে পারে? কিন্তু বইটি পড়তে শুরু করে বুঝলাম, ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে মাশরুম অসাধারণ জীব হতে পারে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মাশরুম উপকারী হতে পারে, খেতেও স্বাস্থ্যকর ও অত্যন্ত পুষ্টিকর। পরিবেশের জন্যও সেগুলি ভালো, কারণ ছত্রাক অরগ্যানিক বস্তুকে কার্যকর কোনো অবস্থায় রূপান্তরিত করে।''

রুয়ান্ডার কৃষি-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নানা জাতের মাশরুম চাষের জন্য আদর্শ। তাছাড়া সেই শস্য প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির অনেক সমস্যার মধ্যে একটির সমাধানের আদর্শ উপায় হতে পারে।

রুয়ান্ডায় চাষযোগ্য জমি খুবই সীমিত। গোটা দেশে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ হেক্টর জমিতে চাষবাস করা হয়। সে দেশের কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ড. কামানা অলিভিয়ার বলেন, ‘‘আমাদের বর্তমান ভূমিসম্পদ যে ভবিষ্যতে নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে, সেটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও আমাদের বাস্তব সমাধানসূত্র খুঁজতে হবে। মাশরুম চক্রাকার জৈব-অর্থনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে শস্যের অবশিষ্ট অংশের নেতিবাচক প্রভাব কমাতেও সেটি সমাধানসূত্র হিসেবে কাজে লাগে।''

কারণ মাশরুম ক্ষেতের নীচের স্তরে সেই বর্জ্য ব্যবহার করা হয়। কিগালি ফার্মস ফসল তোলার সময়ে স্থানীয় গম চাষিদের সহায়তা করে। তারা গম ক্ষেতের খড়ও কিনে নেয়। সেই খড় গাজন করে মাশরুম ক্ষেতে ছড়ানো হয়। অতীতে চাষিরা খড় পুড়িয়ে বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন। লোরঁ দেমোইনক মনে করেন, ‘‘গ্রামাঞ্চলে আরো কৃষি বর্জ্য রয়েছে, যা মাশরুমে পরিণত করা যেতে পারে। আমরা সেই কাজ শুরু করার পাঁচ থেকে ছয় বছর পর বাটন মাশরুম চাষ করছি। গোটা বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে মাশরুমের চাষের প্রায় ৯০ শতাংশই এই জাতের হয়। কিন্তু রুয়ান্ডায় সেই মাশরুমের চাষ একেবারেই হতো না। গোটা আফ্রিকায়ও সেই মাশরুমের হার খুব কম।''

বিনিয়োগ, জমি ও শ্রমের নিরিখে সামান্য উদ্যোগের কারণে মাশরুম চাষ রুয়ান্ডার সমাজে অনেক উপকার বয়ে আনছে। সেইসঙ্গে কার্বন নির্গমন কমাতে ও জমির মান বাড়াতেও সাহায্য করছে। চাষি হিসেবে নিরানসাবাবেরা আদেলা মনে করেন, ‘‘মাশরুম চাষের প্রতি আমার ঝোঁকের পেছনে অনেক উপকারের ঘটনা রয়েছে। ফলনের জন্য প্রায় তিন মাস সময় লাগে। ফসল তোলার পরেও জমিতে সাবস্ট্রেটের ক্ষমতা থেকে যায়। আমরা সেই মিশ্রণকে উচ্চ মানের সার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি, যা বিশেষ করে শাকসবজি চাষের জন্য আদর্শ। ফলে ভালোই ফসল হয়। অন্যান্য সারের মতো এই স্তর মোটেই মাটির মানের অবনতি ঘটায় না।''

শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে মাশরুম আরো বেশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় চলে আসছে। মাংসের তুলনায় প্রোটিনের আরো পরিবেশবান্ধব উৎস হিসেবেও মাশরুমের কদর বাড়ছে। লোরঁ দেমোইনক বলেন, ‘‘হ্যামবার্গারে গরুর মাংসের বদলে মাশরুম দিয়ে তৈরি নিরামিষ প্যাটি ব্যবহার করতে পারেন। একই রকম সুস্বাদু, অথচ অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। আমাদের গ্রহের স্বাস্থ্যের জন্যও অনেক বেশি উপকারী।''

রুয়ান্ডার সরকার কৃষিক্ষেত্রকে জলবায়ু নিরোধক করে তোলার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, মাশরুম চাষ তার সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খেয়ে যায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ড. কামানা অলিভিয়ার বলেন, ‘‘আমরা ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষিকাজ আমাদের কৃষি নীতির মধ্যে শামিল করতে চাই। আমরা টেকসই ও পরিবেশবান্ধব চাষের পদ্ধতিতে উৎসাহ দিতে চাই। আমরা এমন সব ধরনের কৃষিকাজে সহায়তা দিতে চাই, যে সব ক্ষেত্রে অরগ্যানিক সার সৃষ্টি হয়। এমন মনোভাব শুধু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সাহায্য করে না, নির্ভরতা কমাতে আমাদের মাশরুম ছাড়াও অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদনের সুযোগ দেয়।''

পরিবেশের জন্য নানা সুবিধার কারণে মাশরুম চাষ রুয়ান্ডাকে চলতি দশকের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন প্রায় ৪০ শতাংশ কমাতে সাহায্য করছে। সূত্র: ডয়চে ভেলে।