ঢাকা   বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪ | ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বাংলাদেশের নাগরিক যে ব্রিটিশ এমপি নিজের মৃত্যুর গল্প তৈরি করেছিলেন

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫১ পিএম | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫১ পিএম

 

 

 

ফ্লোরিডার মায়ামির সমুদ্রতটে একটা স্তূপ থেকে যখন যুক্তরাজ্যের এমপি জন স্টোনহাউসের জামাকাপড় পাওয়া যায়, তখন অনেকেই ভেবে নিয়েছিলেন তিনি মৃত। সমুদ্রে সাঁতার কাটার সময় তলিয়ে গেছেন। সময়টা ১৯৭৪ সালের ২০ নভেম্বর।

 

সাঁতার কাটতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়েছে এই ভাবনা কিন্তু সেই বছরের ক্রিসমাসের আগের দিন পর্যন্ত বজায় ছিল যতক্ষণ না অস্ট্রেলিয়ায় তার হদিশ মেলে জীবিত এবং একেবারে সুস্থ অবস্থায়। যে সময় পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করছিলেন, তখন একাধিক সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন জন স্টোনহাউস।

 

তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সেই সময় স্থবির হয়ে পড়েছিল, ব্যবসায়িক লেনদেনের ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছিল, কমিউনিস্ট গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং তার সেক্রেটারির সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কও ছিল।

এসব থেকে বাঁচতে লেখক ফ্রেডরিক ফরসিথের উপন্যাস ‘দ্য ডে অফ জ্যাকাল’-এর গল্প অনুকরণ করে দু’জন মৃত ব্যক্তির পরিচয় ধার করে নিজেকে ‘অদৃশ্য’ করে ফেলার পরিকল্পনা করেন তিনি। এই ব্রিটিশ রাজনীতিবিদের জীবন কোনও রোমাঞ্চকর গল্পের চাইতে কম নয়। নিজের মৃত্যুর গল্প ফেঁদে ছিলেন তিনি।

 

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সঙ্গে এই ব্রিটিশ সংসদ সদস্যের নিবিড় যোগ রয়েছে। ১৯৭১-এর যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাঙালি আবেগের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। বাঙালিদের স্বার্থ নিয়ে তার চিন্তা ভাবনার কারণে বেশ পরিচিতি পান স্টোনহাউস। সম্মানের চিহ্ন হিসাবে মুক্তিযুদ্ধের পর নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে তাকে নাগরিকত্বও দেয়া হয়েছিল।

 

‘অদৃশ্য’ হওয়ার পরিকল্পনা

১৯৭৪ সালের নভেম্বরে ব্যবসায়িক কাজে মায়ামি গিয়েছিলেন তিনি এবং সেখান থেকে হঠাৎই নিখোঁজ হয়ে যান। তারপর নিজের পরিকল্পনা মাফিক অস্ট্রেলিয়ার বিমানে উঠে পড়েন। তার এই অভিযান চলেছিল এক মাসেরও বেশি সময় ধরে।

 

প্রায় একই সময়ে লর্ড লুকান নামে এক ব্রিটিশ অভিজাত ব্যক্তিও অদৃশ্য হয়ে যান। তিনিও কুখ্যাত ছিলেন। নিজের অজান্তেই তিনিই অস্ট্রেলিয়ায় জন স্টোনহাউজের ধরা পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ান।

 

স্বাভাবিক ভাবেই কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে যাওয়ার মতো তার এই কার্যকলাপকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন মি. স্টোনহাউস?

 

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে বিবিসির এর সাক্ষাৎকারে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, “শুধুমাত্র সত্য-অনুসন্ধান সফরে গিয়েছিলেন তিনি এবং সেই অনুসন্ধান শুধুমাত্র ভৌগলিক দিক থেকেই ছিল না, রাজনৈতিকসত্ত্বা এবং ব্যক্তিসত্ত্বার দিক থেকেও ছিল।”

 

১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা নিশ্চিতভাবেই তাকে এমন একজন মানুষ বলেই ভেবে থাকবেন, যার কাছে সবকিছুই ছিল- ৪৩ বছর বয়সে পোস্টমাস্টার জেনারেল পদ, একজন গ্ল্যামারাস স্ত্রী ও তিন সন্তান।

 

ভবিষ্যতে লেবার পার্টির প্রার্থী হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসবেন এমন আলোচনাও হতো তার বিষয়ে। মি. স্টোনহাউসই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ডাকটিকিট প্রবর্তনের তদারকি করেছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনও উল্লেখযোগ্য ছিল।

 

তবে পরিস্থিতির বদল হতে শুরু করে ১৯৬৯ সালে। কমিউনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়া থেকে আসা এক ব্যক্তি দাবি করেন, তথ্য পাচারের জন্য মি. স্টোনহাউসকে ওই দেশের হয়ে (চেকোস্লোভাকিয়ার) নিয়োগ করা হয়েছে। এই সময় থেকেই জন স্টোনহাউসের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সমস্যা দেখা দিতে থাকে।

 

তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসনের কাছে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন তিনি। তার কথা বিশ্বাসও করেছিলেন যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।

 

স্নায়ু যুদ্ধের সময় অনেকের এমন অভিযোগ বিরল না হলেও তা প্রভাব ফেলেছিল মি. স্টোনহাউসের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিতে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে যখন লেবার পার্টি হেরে যায়, তখন বিরোধী আসনে তার জন্য কোনও জায়গা ছিল না।

 

কিছুটা হতাশ হয়েই লন্ডনে তার ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে আরও বেশি করে সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মূলত রফতানি সংক্রান্ত ব্যবসা ছিল তার। নিজের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমেই এই ব্যবসার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি।

 

১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, নতুন উদ্যম দেখা যায় তার মধ্যে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন তিনি। বাঙালিদের সঙ্গে তার আবেগ জড়িয়ে যায়। সম্মানের প্রতীক হিসাবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তাকে নতুন রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।

 

এটা কিন্তু শুধুমাত্র সূচনা ছিল। শীঘ্রই তাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। ‘ব্রিটিশ বাংলাদেশ ট্রাস্ট’ নামে একটা ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করতে তার সাহায্য চাওয়া হয়। এই ট্রাস্টের উদ্দেশ্য ছিল, ব্রিটেনে বসবাসকারী বাঙালিদের পরিষেবা প্রদান করা।

 

কিন্তু যেভাবে এই ব্যাঙ্ক পরিচালনা করা হচ্ছিল সে বিষয়ে একটা সংবাদপত্রে সমালোচনা করা হয়। ক্রমশ যুক্তরাজ্যের ফ্রড স্কোয়াড (জালিয়াতি সংক্রান্ত মামলার তদন্তকারী সংস্থা) এবং লন্ডনের ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেড এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (বাণিজ্য ও শিল্প বিভাগ) তদন্তকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

 

নেতিবাচক প্রচার এবং সরকারি তদন্তের কারণে ব্যাঙ্কের বেশিরভাগ সমর্থকই ধীরে ধীরে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই পুরো বিষয়টা মি. স্টোনহাউসকে গভীরভাবে হতাশ করেছিল। মনে হয়েছিল, সহকর্মীদের কাছ থেকে তিনি সম্মানও হারাচ্ছেন।

 

নতুন পরিচয়

এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে একটা ফন্দি আঁটেন তিনি। এর জন্য প্রথমেই জোসেফ আর্থার মারখামের নামে এক সদ্য মৃত এক ব্যক্তির নাম ভাঁড়িয়ে পাসপোর্টের জাল আবেদন করেন। ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিডল্যান্ডসের ওয়ালসাল এলাকার বাসিন্দা ছিলেন ওই ব্যক্তি।

 

এরপর নিজেকে পরিচয় দেন একজন গ্লোবট্রোটিং এক্সপোর্ট কনসালট্যান্ট (এমন একজন বিশেষজ্ঞ পরামর্শদাতা যিনি বিশ্বজুড়ে কাজের জন্য ঘুরে বেড়ান) হিসাবে। নতুন পরিচয়ের সঙ্গে জুড়ে দেন লন্ডন, সুইজারল্যান্ড এবং মেলবোর্নে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলোকেও।

 

এখানেই থেমে থাকেনি তিনি। ওয়ালসলে সদ্য মৃত আরেক ব্যক্তি ডোনাল্ড ক্লাইভ মিলদুনের নাম ভাঁড়িয়ে আরেকটা নতুন পরিচয় গড়ে তোলেন। নতুন পরিচয় নিয়ে বাঁচার জন্য তার ব্যবসা থেকে প্রচুর পরিমাণে অর্থ একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত করেন।

 

দ্বৈত জীবন

১৯৭৪ সালের ২০ নভেম্বর ফ্লোরিডার মায়ামির সমুদ্রতট থেকে নিখোঁজ হয়ে যান জন স্টোনহাউস। মায়ামির সৈকতে কয়েকটা জামা কাপড় পড়ে থাকা ছাড়া ৪৯ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের কোনও চিহ্নই পাওয়া যায়নি সেই সময়।

 

তিনি কি সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছেন, না কি তাকে হত্যা করে ওই সৈকতেরই কোনও কংক্রিটের ব্লকের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হয়েছে না কি অপহরণ করা হয়েছে- এই কয়েকটা সম্ভাব্য প্রশ্নই ঘোরাফেরা করছিল সকলের মাথায়।

 

তার স্ত্রী বারবারা স্টোনহাউসের মনে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না যে তার স্বামী একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।

 

সেই সময় তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, “আমি কিছু অভাবনীয় গুজব শুনেছি এবং সেগুলো আমার স্বামীর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এতটাই বেমানান যে সে বিষয়ে ভাবাও যায় না আর তার উত্তরও দেওয়া যায় না।”

 

“আমি মনে মনে নিশ্চিত যে এটা একটা দুর্ঘটনা। আমাদের কাছে যে সমস্ত প্রমাণ রয়েছে তা এটাই ইঙ্গিত করে যে উনি ডুবে গিয়েছেন।”

 

লন্ডন পুলিশের অবশ্য অন্যরকম ভাবনা ছিল।

 

মি. স্টোনহাউসের সেক্রেটারি এবং গোপন বান্ধবী শীলা বাকলে কিন্তু বন্ধুদের ক্রমাগত বলে চলেছিলেন যে ওই রাজনীতিবিদের মৃত্যু হয়েছে। যদিও আসল ‘গল্পটা’ বছর ২৮-এর মিজ বাকলের ভালো করেই জানা ছিল।

 

নিজের কিছু জামাকাপড় ট্রাঙ্কে প্যাক করে এর ঠিক এক মাস আগেই অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তার কাছে বেশ কয়েকটা ট্রান্সআটলান্টিক টেলিফোন কলও এসেছিল। জন স্টোনহাউসের অস্ট্রেলিয়ান ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মধ্যে একটার মাধ্যমে সেমি-কোডেড চিঠিও পাঠিয়েছিলেন।

 

মি. মারখাম ও মি. মিলদুনের নামে ওই দু’টো ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এই দুই অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরেই মেলবোর্ন পুলিশ জন স্টোনহাউসের হদিশ পায়।

 

সেই সময়, লর্ড লুকান নামক কুখ্যাত ব্যক্তির সন্ধানে ছিল পুলিশ। কাকতালীয়ভাবে নভেম্বরে মাসেই তিনিও নিখোঁজ হয়েছিলেন। চৌঠা নভেম্বর তার সন্তানদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা এক নারীকে হত্যা করে পালিয়ে যান।

 

প্রাথমিকভাবে পুলিশের অনুমান করেছিল যে ব্যক্তিত্বপূর্ণ ইংরেজ পুরুষকে চেকে সই করতে দেখা গিয়েছে, তিনিই লর্ড লুকান। তবে তেমনটা ছিল না।

 

প্রসঙ্গত, লর্ড লুকানের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা পুলিশের কাছে ৫০ বছর ধরে একটা রহস্য থাকলেও, জন স্টোনহাউসের ‘অদৃশ্য’ হওয়ার গল্পের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র একমাসের কিছু বেশি সময়। তার মধ্যেই এই মামলার কিনারা করে ফেলে পুলিশ।

 

ক্রিসমাসের আগের দিন তার আসল পরিচয় স্বীকার করতে বাধ্য হন জন স্টোনহাউস।

 

মেলবোর্নের পুলিশ সদর দফতরে থাকা কালীন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত স্ত্রীকে ফোন করতে পারবেন কি না সে বিষয়ে জানতে চান মি. স্টোনহাউস। যদিও তার সেই টেলিফোনের কথোপকথনে যে কেউ আড়ি পাতছে এবং রেকর্ড করছে, সে বিষয়ে ধারণাই করতে পারেননি। কিছু না জেনেই বেশ কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন।

 

স্ত্রী বারবারাকে ফোনে তিনি বলেছিলেন, “হ্যালো ডার্লিং। এখানে ওরা ভুয়া পরিচয় ধরে ফেলেছে। এসব থেকে তুমি বুঝতেই পারবে যে আমি তোমাকে ঠকাচ্ছিলাম। আমি এর জন্য দুঃখিত, কিন্তু এক অর্থে আমি খুশি কারণ এখন সবকিছুর শেষ হচ্ছে।”

 

এরপর কিছুদিন মি. স্টোনহাউসকে ডিটেনশন সেন্টারে রাখা হয়েছিল। এরপর প্রথমে তার পরিবার এবং পরে বান্ধবীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় তার সাক্ষাৎ হয়।

 

পুনরাবির্ভাবের এক মাস পর বিবিসির অস্ট্রেলিয়া সংবাদদাতা বব ফ্রেন্ডকে সাক্ষাৎকার দেন মি. স্টোনহাউস। বব ফ্রেন্ডের সঙ্গে সেই সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য “বিভক্ত ব্যক্তিত্বের বিকাশ”কে দায়ী করেন।

 

তার দাবি ছিল “নতুন পরিচয় নিয়ে তিনি তার পুরনো ব্যক্তিত্বকে মুক্তি দিয়েছিলেন যার (পুরানো ব্যক্তিত্ব) ওপরে বেশ মানসিক চাপ ছিল।”

 

“কী ভাবে স্ত্রী ও পরিবারকে এমন যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিতে পারলেন?” এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমি চেষ্টা করছিলাম- নিখোঁজ হয়ে গিয়ে তাদের জীবনকে সহজ করে দিতে। আমি আমার পুরানো ব্যক্তিত্বর কারণে তাদের উপর যে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছিল, সেটা সরিয়ে নিতে চেয়েছিলাম।”

 

জন স্টোনহাউস কিন্তু তখনও এমপি ছিলেন। তার নির্বাচনি এলাকা থেকে ১২ হাজার মাইল দূরে থাকা অবস্থাতে সংসদীয় বেতন না নেওয়ার বিষয়ে কোনও পরামর্শ শুনতে চাননি তিনি। বরং পাল্টা যুক্তি দিয়েছিলেন।

 

সেই সময় তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, “অনেক এমপিই বিদেশ সফরে যান এবং ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং ট্যুর (তথ্য অনুসন্ধান করার জন্য সফর) করেন। আমি কেবল ভৌগোলিক দিক থেকেই নয়, একটা রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিসত্ত্বার দিক থেকে একটা ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং ট্যুর করছি।”

 

“এখন সেই সফরটা খুব আকর্ষণীয় এবং এমপির বেতন নেওয়ার দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে ন্যায়সঙ্গত হতে পারে যদি আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার গল্পটা বলতে পারি।”

 

তিনি আরও বলেছিলেন, “আমি মনে করি,একজন এমপিরও কোনও রকম অসুস্থতার বিষয়টা বিবেচনা করা উচিত যেমনটা অন্য কাজে নিযুক্ত কর্মীদের ক্ষেত্রে করা হয়।” স্টোনহাউসের রাজনৈতিক ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলেছিল।

 

‘দু’বার’ মৃত্যু

সাত মাস ধরে অস্ট্রেলিয়ায় থাকার চেষ্টা করে চলেছিলেন মি. স্টোনহাউস।

 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে নির্বাসন দেওয়া হয় এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা তাকে যুক্তরাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যান। ১৯৭৬ সালের আগস্টে, তার ব্যর্থ ব্যবসায়িক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে ৬৮ দিন ব্যাপী বিচারের পর চুরি, জালিয়াতি এবং প্রতারণার অপরাধে তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

 

এর তিন বছর পর তার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। সেড়ে ওঠার সময় তিনি কারাগারের বাইরে আসেন। জেলে থাকাকালীন তার তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছিল।

 

বারবারা স্টোনহাউস তাকে ১৯৭৮ সালে ডিভোর্স দেন। তিন বছর পর, তার সাবেক সেক্রেটারি শীলা বাকলেকে বিয়ে করেছিলেন জন স্টোনহাউস।

 

১৯৮৮ সালে ‘দ্বিতীয়বার’ এবং সত্যিকারের তার মৃত্যু হয়। একটু কাকতালীয় ভাবেই নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে একটা টেলিভিশন অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার তিন সপ্তাহ আগেই বছর ৬২-র মি. স্টোনহাউসের মৃত্যু হয়।

 

কিন্তু তার বিরুদ্ধে ওঠা সেই গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ কী সঠিক ছিল যা তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে এতটা ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল? পুনরায় আবির্ভূত হওয়ার পরে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি ‘চেকোস্লোভাকিয়ার গুপ্তচর’ হওয়ার অভিযোগ “হাস্যকর” বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

 

জন স্টোনহাউসের মেয়ে জুলিয়া কিন্তু (বাবার বিরুদ্ধে ওঠা) বিদেশি শক্তিকে তথ্য পাচারের অভিযোগ আজও অস্বীকার করেন। বাবার পক্ষ সমর্থন করে ২০২১ সালে একটা বইও লিখেছিলেন তিনি।

 

স্টোনহাউসের ‘এমআই ফাইভ’-এর ফাইল দেখেছেন এমন হাতে গোনা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ এবং অধ্যাপক ক্রিস্টোফার অ্যান্ড্রু।

 

২০০৯ সালে তার অনুমোদিত ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার ইতিহাসে অধ্যাপক আন্ড্রু এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে স্টোনহাউস প্রকৃতপক্ষেই চেকোস্লোভাকিয়ার হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেছিলেন।

 

২০১২ সালে প্রফেসর অ্যান্ড্রু বিবিসিকে বলেছিলেন, “ এই প্রসঙ্গে সত্যিকারের প্রমাণ এসেছিল ১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন মিত্র হয়ে ওঠা চেকোস্লোভাকিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা স্টোনহাউসের কিছু ফাইল জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিল।”

 

“তিনি যে গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছিলেন তার গুণমান নিয়ে তারা (চেকোস্লোভাকিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা) বেশ হতাশ ছিল। তাই জন স্টোনহাউস প্রতারণা করেছেন এমন মানুষের যে দীর্ঘ তালিকার রয়েছে, তার সঙ্গে সম্ভবত আমরা চেকোস্লোভাক গোয়েন্দা সংস্থার নামও জুড়ে দিতে পারি,” তিনি বলেন। সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করতে চান এরদোগান
৩০ কোটি টাকায় বিক্রি ৪০০ বছরের রুপোর মুদ্রা
নতুন লোগো নিয়ে হাজির হচ্ছে জাগুয়ার, কবে থেকে চালু হবে?
মস্কো-ওয়াশিংটন হটলাইন এখন ব্যবহার হচ্ছে না: ক্রেমলিন
আত্মরক্ষার অধিকার রাশিয়ার আছে: এরদোগান
আরও

আরও পড়ুন

বিসিবির অর্থ পুরস্কার হাতে পেলেন সাবিনারা

বিসিবির অর্থ পুরস্কার হাতে পেলেন সাবিনারা

ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের ৮ নেতা গ্রেপ্তার

ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগের ৮ নেতা গ্রেপ্তার

ঝিকরগাছায় রাস্তার পাশে পড়ে ছিল যুবকের লাশ

ঝিকরগাছায় রাস্তার পাশে পড়ে ছিল যুবকের লাশ

সালমান খানকে হত্যার হুমকিদাতা বিষ্ণোই গ্যাংয়ের ছোট ভাই গ্রেফতার

সালমান খানকে হত্যার হুমকিদাতা বিষ্ণোই গ্যাংয়ের ছোট ভাই গ্রেফতার

আলী ইমাম মজুমদার-খোদা বকশ চৌধুরীরা গণতন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন: রিজভী

আলী ইমাম মজুমদার-খোদা বকশ চৌধুরীরা গণতন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন: রিজভী

৫৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বর্ণাঢ্য মিলনমেলায় হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী

৫৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বর্ণাঢ্য মিলনমেলায় হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করতে চান এরদোগান

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করতে চান এরদোগান

গণপূর্তে কর্মরত হত্যা মামলার আসামিসহ ১৬ জনকে অপসারণের দাবি

গণপূর্তে কর্মরত হত্যা মামলার আসামিসহ ১৬ জনকে অপসারণের দাবি

দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে আনসারদের নির্দেশনা দিলেন মহাপরিচালক

দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে আনসারদের নির্দেশনা দিলেন মহাপরিচালক

র‍্যাব পরিচয়ে ফ্যাসিবাদের দোসররা কি এখনো সক্রিয়?

র‍্যাব পরিচয়ে ফ্যাসিবাদের দোসররা কি এখনো সক্রিয়?

যত দ্রুত নির্বাচন দেবেন, জাতির জন্য মঙ্গল,দেরি হলে সমস্যাগুলো বাড়বে: মির্জা ফখরুল

যত দ্রুত নির্বাচন দেবেন, জাতির জন্য মঙ্গল,দেরি হলে সমস্যাগুলো বাড়বে: মির্জা ফখরুল

রাজধানীর ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজে সংঘর্ষে আহত ৩২ শিক্ষার্থী ঢামেকে

রাজধানীর ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজে সংঘর্ষে আহত ৩২ শিক্ষার্থী ঢামেকে

ঈশ্বরগঞ্জে দন্ত চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় গুরুতর অসুস্থ রোগী

ঈশ্বরগঞ্জে দন্ত চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় গুরুতর অসুস্থ রোগী

গণতদন্ত কমিশন গঠন করে আমেরিকান কনভেনশনাল সিস্টেমে গণশুনানি করতে হবে : এবি পার্টি

গণতদন্ত কমিশন গঠন করে আমেরিকান কনভেনশনাল সিস্টেমে গণশুনানি করতে হবে : এবি পার্টি

ঈশ্বরগঞ্জে মদসহ মাদক কারবারি মতিলাল গ্রেপ্তার

ঈশ্বরগঞ্জে মদসহ মাদক কারবারি মতিলাল গ্রেপ্তার

"বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানালেন রহমান-সায়রার তিন সন্তান

"বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানালেন রহমান-সায়রার তিন সন্তান

বিতর্কিত কর্মকর্তা কুমিল্লার এসপি হারুনের সহযোগি জিএমপিতে

বিতর্কিত কর্মকর্তা কুমিল্লার এসপি হারুনের সহযোগি জিএমপিতে

জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় জরুরি : সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় জরুরি : সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

৩০ কোটি টাকায় বিক্রি ৪০০ বছরের রুপোর মুদ্রা

৩০ কোটি টাকায় বিক্রি ৪০০ বছরের রুপোর মুদ্রা

কেরানীগঞ্জে কোন্ডা ইউনিয়ন কৃষক লীগ সভাপতি গ্রেফতার

কেরানীগঞ্জে কোন্ডা ইউনিয়ন কৃষক লীগ সভাপতি গ্রেফতার