ওয়্যাগনারের ধাঁচে আরাকানে ‘সেনা’ নামাচ্ছে চীন!
০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:১৭ পিএম | আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫২ পিএম
চলতি বছরেই চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি (মউ) সেরে ফেলতে চাইছে মিয়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকার। উদ্দেশ্য, যৌথ ভাবে একটি নিরাপত্তা সংস্থার প্রতিষ্ঠা। এই সংস্থা মূলত বিদ্রোহীদের হাত থেকে বেইজিংয়ের বিনিয়োগ রক্ষার জন্য কাজ করবে বলে সরকারি ভাবে জানা গিয়েছে।
গত ২২ অক্টোবর এই চুক্তির খসড়া তৈরির জন্য একটি ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করে জুন্টার সেনা সরকার। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই একে বেসরকারি ফৌজ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ বলে দাবি করে বসেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। পাশাপাশি, শুরু হয়েছে রুশ ‘ওয়্যাগনার গ্রুপ’-এর সঙ্গে এর তুলনা।
মস্কোর বেসরকারি সেনাবাহিনী ‘ওয়্যাগনার গ্রুপ’-এর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাতে। সিরিয়া, চেচনিয়া থেকে ইউক্রেন— একাধিক যুদ্ধে তাদের কাজে লাগিয়েছেন তিনি। নিষ্ঠুর ওয়্যাগনার যোদ্ধারা পুতিনের কথায় হাসতে হাসতে গণহত্যা চালায় বলেও দাবি করে থাকে নিন্দুকের দল।
ইয়াঙ্গন (সাবেক রেঙ্গুন) এবং বেজিংয়ের যৌথ উদ্যোগে জন্ম নিতে চলা নিরাপত্তা সংস্থার ধাঁচ ‘ওয়্যাগনার গ্রুপ’-এর মতোই কিনা, তা অবশ্য এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এই খবরে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। একে ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কানি দিতে ড্রাগন যে চেষ্টার খামতি রাখবে না, তা বলাই বাহুল্য।
বেইজিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর (বিআরআই) অন্যতম বড় প্রকল্প হল, ‘চীন মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর’ (চায়না মিয়ানামার ইকোনমিক করিডর বা সিএমইসি)। ড্রাগনভূমির কুনমিং প্রদেশ থেকে আরাকানের রাখাইন রাজ্যের কিয়ুকপিউ বন্দর পর্যন্ত চলছে এর নির্মাণকাজ।
এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে হাইওয়ে, রেলপথ, পাইপলাইনের মাধ্যমে কুনমিংয়ের অর্থনৈতিক অঞ্চলকে গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে জুড়ে ফেলতে পারবে চীন। কৌশলগত দিক থেকে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই সিএমইসিকে মলাক্কা প্রণালীর ‘বাইপাস’ বলে দাবি করেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
বর্তমানে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করার ক্ষেত্রে মলাক্কা প্রণালী ছাড়া বেইজিংয়ের কাছে দ্বিতীয় রাস্তা নেই। আমেরিকার সঙ্গে সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ায় এই রাস্তা ওয়াশিংটন বন্ধ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বেইজিং। সে ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে চীনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। পঙ্গু হতে পারে চীনা অর্থনীতি।
সিএমইসি প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দূর হবে বেইজিংয়ের এই দুশ্চিন্তা। তখন মলাক্কা প্রণালী বন্ধ হলেও সরাসরি ভারত মহাসাগরে ঢুকতে পারবে চীনা জাহাজ। আর তাই দ্রুত সিএমইসি শেষ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এশিয়ার ড্রাগন। কিন্তু গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা।
২০২১ সালে জুন্টা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ‘জনগণের প্রতিরক্ষা যুদ্ধ’ ঘোষণা করে বিদ্রোহী তথা আরাকানের গণতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠী। এর ঠিক পরের বছরই তাগাং তাং নিকেল প্রসেসিং প্ল্যান্টে হামলা চালায় তারা। এর ফলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৮০ কোটি ডলারের ওই চীনা কারখানা।
চলতি বছরে মান্দালয়ে চীনা দূতাবাসে বোমা ছুড়ে পালায় জুন্টা বিরোধীরা। তাতে কারও মৃত্যু না হলেও দূতাবাসের দেওয়ালে চিড় ধরে। এই অবস্থায় মিয়ানমারে থাকা তেল এবং গ্যাস পাইপলাইনের প্রকল্পগুলির যে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তা বেইজিংয়ের কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়।
সূত্রের খবর, তখন থেকেই যৌথ নিরাপত্তা সংস্থা তৈরির জন্য জুন্টা সরকারের উপর চাপ দিতে থাকেন জিনপিং। শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব মেনে নেয় ইয়াঙ্গন। যদিও এই সংক্রান্ত ঘোষণা হতেই আরাকানে জন্ম নিয়েছে নতুন বিতর্ক। অনেকেই একে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন বলে সুর চড়াচ্ছেন।
২০০৮ সালের সংবিধানে দেশের মাটিতে বিদেশি সৈন্য মোতায়েন নিষিদ্ধ করেছে মিয়ানমার। ফলে আইনের ফাঁক গলে যৌথ নিরাপত্তা সংস্থা তৈরি যে সহজ নয়, তা বিলক্ষণ জানে জুন্টা সরকার। আর তাই সংশ্লিষ্ট সংস্থাটিকে ব্যক্তিগত এবং আংশিক ভাবে বর্মীয় হিসাবে গঠন করবেন তারা।
ওই ধাঁচে নিরাপত্তা সংস্থা তৈরি হলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে বলে মনে করছে জুন্টা প্রশাসন। প্রথমত, চীনা সামরিক কোম্পানির অস্তিত্ব অস্বীকার করতে সক্ষম হবে ইয়াঙ্গন। দ্বিতীয়ত, এটিকে ব্যবহার করে কাজ হাসিল করতে পারবে বেইজিং।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, গত কয়েক বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে বিদ্রোহীদের কাছে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ সেনাঘাঁটি হারিয়েছে সামরিক জুন্টা সরকার। ধীরে ধীরে ফুরোচ্ছে তাদের অস্ত্রের ভান্ডার। এই অবস্থায় যৌথ উদ্যোগে তৈরি নিরাপত্তা সংস্থা তাদের কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার শামিল।
কারণ আগামী দিনে এই সংস্থাকে সামনে রেখে গোলা-বারুদ থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান – যাবতীয় হাতিয়ার চীন থেকে আমদানি করতে পারবে আরাকানের সরকারি ফৌজি অফিসাররা। ফলে প্রতি আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়ে বিদ্রোহীদের দখলে থাকা এলাকা ছিনিয়ে নেয়া সহজ হবে।
এ বছরের অগস্টে কৌশলগত দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ লাশিও এলাকা দখল করে বিদ্রোহী ‘মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি’ (এমএনডিএএ)। জুন্টার কাছে যা ছিল বড় ধাক্কা। অক্টোবরে বিদ্রোহী কম্যান্ডার পেং ড্যাকসুনকে ইউনান প্রদেশের কুনমিঙে গৃহবন্দি করে চীন।
এর পর থেকেই এমএনডিএএ-কে লাশিও ছাড়তে ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে বেইজিং। উত্তর মিয়ানমারের শান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এই এলাকাটি সিএমইসির প্রবেশদ্বার হিসাবে চিহ্নিত। লাশিও বিদ্রোহীদের দখলে থাকলে প্রকল্পের কাজ শেষ করা দুই দেশের পক্ষে যে একরকম অসম্ভব, তা বলাই বাহুল্য।
ড্রাগনল্যান্ডে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা যে নেই, তা কিন্তু নয়। তালিকায় নাম রয়েছে ডি ওয়েই সিকিউরিটি গ্রুপ লিমিটেড, হুয়া জিন চায়না সিকিউরিটি, গুয়ান আন সিকিউরিটি টেকনোলজি, চায়না ওভারসিজ সিকিউরিটি গ্রুপ এবং ফ্রন্টিয়ার সার্ভিসেস গ্রুপের।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, এই সংস্থাগুলির একটির সঙ্গে যৌথ ভাবে নতুন একটি সংস্থা তৈরি করবে বেইজিং। সেটি নামে বর্মীয় হলেও পিছন থেকে নিয়ন্ত্রণ থাকবে বেইজিংয়ের হাতেই। নিরাপত্তা সংস্থার যোদ্ধাদের মোতায়েন করা হবে নির্মীয়মাণ সিএমইসির বিভিন্ন সাইটে।
কিন্তু তার পরও সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির সঙ্গে রুশ ওয়্যাগনার গ্রুপের তুলনা টানতে নারাজ ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসারদের একাংশ। প্রথমত, এর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ জিনপিংয়ের হাতে থাকছে না। ফলে একে ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারবে জুন্টা প্রশাসন।
দ্বিতীয়ত, এই সংস্থার নেপথ্যে থাকা চীন ও মিয়ানমারের আলাদা আলাদা স্বার্থ রয়েছে। আরকানের সরকারি বাহিনী চাইবে সামনে থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়ুক নিরাপত্তা সংস্থা। অন্য দিকে, বেইজিং তাদের প্রকল্পের নিরাপত্তা পেলেই খুশি। এই দুই স্বার্থ পূরণ করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যৌথ নিরাপত্তা সংস্থায় রক্ষী বা যোদ্ধা হিসাবে কারা কাজ পাবেন তা স্পষ্ট নয়। বিদ্রোহীদের আক্রমণে তাদের মৃত্যুর আশঙ্কাও অমূলক নয়। ফলে বেইজিং বা মিয়ানমার— দু’পক্ষই চাইবে অন্য তরফে বাহিনীতে যোগ দিক যোদ্ধারা। ফলে কর্মীর অভাবে চরম মূল্য দিতে হতে পারে ওই নিরাপত্তা সংস্থাকে। পিছন থেকে নিয়ন্ত্রণ থাকবে বেইজিংয়ের হাতেই। নিরাপত্তা সংস্থার যোদ্ধাদের মোতায়েন করা হবে নির্মীয়মাণ সিএমইসির বিভিন্ন সাইটে।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
গভীর রাতে গরিব অসহায় শীতার্ত মাঝে ইউএনও'র কম্বল বিতরন
বরিশালে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে
সেবা বঞ্চিত হলে অভিযোগ করা যাবে ইসির বিরুদ্ধে
এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরও ৩ হাজার শিক্ষক
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের নবনিযুক্ত সচিব ছাগলনাইয়ার সন্তান সামছু উদ্দিন
বাংলাদেশে শনাক্ত হলো 'রিওভাইরাস’, রোগটি সম্পর্কে যা জানা যায়
আন্দোলনের মুখে পাঠ্যবই থেকে বাদ পড়লো ‘আদিবাসী’ শব্দযুক্ত গ্রাফিতি
মাসের শেষে আবারো আসছে শৈত্যপ্রবাহ
বর্ষসেরা ফটোগ্রাফার হিসাবে পুরস্কার পেলেন, আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক মুগনিউর রহমান মনি
রাজশাহীর সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ
বেড়া কৈটোলা নির্মাণ বিভাগের অফিসিয়াল ও উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা
গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বাইডেন-নেতানিয়াহুর ফোনালাপ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা
না ফেরার দেশে নির্মাতা রায়হান রাফির বাবা
এলিফ্যান্ট রোডে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে হত্যা চেষ্টা, গ্রেপ্তার ২
ছাগলনাইয়ায় খালে ভাসছিল নারীর অর্ধগলিত লাশ
ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বরতায় ৫ দিনে গাজায় নিহত ৭০ শিশু
ঘরে বসে মাত্র ১০ দিনেই মিলবে থাইল্যান্ডের ভিসা
মিয়ানমারের কাচিনে জান্তার বিমান হামলা, শিশুসহ নিহত ১৫
আজ বায়ুদূষণে শীর্ষে ঢাকা