বিবিসির প্রতিবেদন: যেভাবে আরাকানের নিয়ন্ত্রণ হারায় মিয়ানমার বাহিনী

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪৩ এএম | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৪৩ এএম

স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে দীর্ঘ ১১ মাস ধরে মিয়ানমার সামরিক জান্তা বাহিনীর টানা লড়াই চলছিল। এরই একপর্যায়ে গত ১১ ডিসেম্বর হার মেনে নেয় জান্তা বাহিনী। ফলে মংডু শহর দখলের মধ্য দিয়ে আরাকান আর্মির কবজায় চলে আসে প্রায় পুরো আরাকান বা রাখাইন রাজ্য।

 

এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো তুলে ধরা হলো- ‘প্রথমে ভাঙা ভাঙা শব্দে মাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান, তারপর প্রচণ্ড শব্দে গোলাবর্ষণ, রকেট ও রাইফেলের গুলির শব্দ, যা ভবনের বড় একটি অংশ ধসিয়ে দেয়। এই ভবনগুলোতে শত শত সৈন্য লুকিয়ে ছিল। বিজিপি-৫ অর্থাৎ বর্ডার গার্ড পুলিশ ছিল উত্তর রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার শেষ প্রতিরোধ স্থল, যার অবস্থান বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে।’ বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (এএ) ঘাঁটি ঘেরাও করার এক ভিডিওতে দেখা যায়, তাদের রংচটা পোশাক পরা এবং খালি পায়ে থাকা যোদ্ধারা বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে ঘাঁটিতে গুলি চালাচ্ছে। তখন তাদের মাথার ওপর দিয়ে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান উড়ছিল। এটি ছিল এক ভয়াবহ যুদ্ধ (হয়তো এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনা, যা ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে চলছে)।

 

আরাকান আর্মির এক সদস্য জানায়, তারা ঘাঁটির চারপাশে বড় গর্ত খুঁড়ে তাতে ধারালো খুঁটি বসায়। সেখানে বেশ কয়েকটি বাংকার ও প্রতিরক্ষা ভবন ছিল। তারা (জান্তা সেনারা) এর আশপাশে এক হাজারের বেশি স্থল মাইন পুঁতে রেখেছিল, যেগুলো পার হতে গিয়ে আমাদের অনেক যোদ্ধা হাত-পা হারিয়েছে, অনেকে মারা গেছে। মংডু দখল সম্পর্কে আরাকান আর্মির এক সদস্য জানায়, ‘তারা ধীরে ধীরে ক্যাম্পের দিকে এগিয়েছে, আর নিজেদের আড়াল করার জন্য গর্ত খুঁড়েছে।’

 

বিবিসির বিবরণ অনুযায়ী, জুন মাসে মংডুতে শুরু হওয়া যুদ্ধের তীব্রতা থেকে অনুমান করা যায়, আরাকান আর্মির শত শত যোদ্ধা নিহত হয়েছে। যুদ্ধের ফলে রাখাইন রাজ্যের অনেক অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। অবরোধ চলাকালীন, মিয়ানমারের বিমান বাহিনী মংডুতে অবিরাম বোমাবর্ষণ করে। এতে সেখানকার বেসামরিক নাগরিক পালাতে বাধ্য হয়। বিমানগুলো রাতে অবরুদ্ধ সেনাদের জন্য খাবার সরবরাহ করত, কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না।

 

স্থানীয় সূত্র বিবিসিকে জানায়, বাংকারগুলোতে প্রচুর চাল ছিল, কিন্তু আহতদের চিকিৎসার সুযোগ ছিল না। এতে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে। এরপর গত সপ্তাহ থেকে তারা আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে। আরাকান আর্মির ভিডিওতে দেখা যায়, সেনা সদস্যরা শোচনীয় অবস্থায় সাদা কাপড় নাড়িয়ে বেরিয়ে আসছে। কেউ কেউ ক্রাচে ভর করে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, কারও পা কাপড়ে মোড়ানো। বেশির ভাগের পায়ে জুতা ছিল না। বিধ্বস্ত ভবনগুলোর ভিতরে বিজয়ী বিদ্রোহীরা অনেক মৃতদেহের স্তূপ খুঁজে পায়। আরাকান আর্মি দাবি করেছে, এই অবরোধে ৪৫০ জনের বেশি সেনা নিহত হয়েছেন। তারা বন্দি কমান্ডার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন টুনসহ তার কর্মকর্তাদের আটক হওয়ার ভিডিও প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, তারা আরাকান আর্মির পতাকার খুঁটির নিচে হাঁটু গেড়ে বসে আছে এবং ওপরে বিদ্রোহীদের ব্যানার উড়ছে।

বিবিসি উল্লেখ করে, বিজিপি-৫ এর দখল প্রমাণ করে যে আরাকান আর্মি (এএ) মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী দলগুলোর একটি।

এটি গঠিত হয়েছিল ২০০৯ সালে- মিয়ানমারের অন্য বিদ্রোহী দলগুলোর চেয়ে অনেক পরে। রাখাইন সম্প্রদায়ের তরুণরা এই দলটি তৈরি করেছিল, যারা কাজের খোঁজে দেশের অন্য প্রান্তে চীন সীমান্তে গিয়েছিল। আরাকান আর্মি হলো থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অংশ, যারা গত বছর থেকে জান্তার পরাজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ। এই জোটের অন্য দুই দল শান রাজ্যের সীমান্তে অবস্থান করছে।

আরাকান আর্মি আট বছর আগে রাখাইনে ফিরে আসে এবং নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। দারিদ্র্য, বিচ্ছিন্নতা আর কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার কারণে রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ঐতিহাসিক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল, তার ভিত্তিতেই এই লড়াই শুরু হয়। আরাকান আর্মি প্রমাণ করেছে যে তাদের নেতারা বুদ্ধিমান, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নিজেদের যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম। তারা রাখাইন রাজ্যের যে বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, সেটি এমনভাবে পরিচালনা করছে যেন নিজেদের রাজ্যই চালাচ্ছে তারা। ভালো অস্ত্রও পেয়েছে তারা। কারণ চীন সীমান্তের পুরনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। ধারণা করা হয়, তাদের যথেষ্ট অর্থও রয়েছে। সম্প্রতি মংডু থেকে বাংলাদেশে আসা এক রোহিঙ্গা বিবিসিকে জানান, মংডু ও এর আশপাশের গ্রামগুলোর ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। প্রায় সব দোকানপাট ও ঘরবাড়ি লুট করা হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের পতন সম্পর্কে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছরের সামরিক বিপর্যয়ের পর এটি ছিল জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর জন্য আরেকটি শোচনীয় পরাজয় ছিল।

প্রথমবারের মতো তার সেনাবাহিনী পুরো একটি সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। মিয়ানমার ও বাংলাদেশের ২৭০ কিমি (১৭০ মাইল) সীমান্ত এখন পুরোপুরি আরাকান আর্মির দখলে। এখন শুধু রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়ে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে, তবে এটি দেশের বাকি অংশ থেকে আলাদা। মিয়ানমার সেনাবাহিনী চলতি বছরের শুরু থেকেই আরাকান আর্মির কাছে পরাজিত হয়ে একের পর এক শহরের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীর সবশেষ ইউনিট বিজিপি-৫ এ গিয়ে অবস্থান নেয়, যা মংডু সীমান্ত শহরের বাইরে প্রায় ২০ হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত, যেখানে আরাকান আর্মি তাদেরকে ঘিরে রাখে। বিজিপি-৫ তৈরি হয়েছিল মুসলিম রোহিঙ্গা গ্রামের মিও থু জি নামে এক অঞ্চলে। যে জায়গাটি থেকে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করেছিল সশস্ত্র বাহিনী এবং তারা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেয়। বিবিসি সংবাদদাতা ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সামরিক অভিযানের পর মংডুতে যান।

সেখানে তিনি পুড়ে যাওয়া গ্রাম দেখতে পান, সেখানকার গাছপালায়ও পোড়ার চিহ্ন পাওয়া যায়। সে সময় অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছিল, যার কারণে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। দুই বছর পর সেই একই জায়গায় গিয়ে বিবিসি সংবাদদাতা দেখতে পান, নতুন পুলিশ কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে, সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে যাতে হামলাকারীদের সহজেই দেখা যায়।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

প্রথমবারের মতো মক্কার বাইরে পবিত্র কাবার সম্পূর্ণ কিসওয়া প্রদর্শন

প্রথমবারের মতো মক্কার বাইরে পবিত্র কাবার সম্পূর্ণ কিসওয়া প্রদর্শন

মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে ধুলো নিয়ন্ত্রণ করছে ভোলা পৌরসভা

মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে ধুলো নিয়ন্ত্রণ করছে ভোলা পৌরসভা

তামিমকে মুশফিক-মাহমুদ উল্লাহদের বিদায়ী বার্তা

তামিমকে মুশফিক-মাহমুদ উল্লাহদের বিদায়ী বার্তা

নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবীতে আশুলিয়ায় সমাবেশ

নিত্যপণ্যের দাম কমানোর দাবীতে আশুলিয়ায় সমাবেশ

ইবির হিসাববিজ্ঞান বিভাগের নবনিযুক্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ

ইবির হিসাববিজ্ঞান বিভাগের নবনিযুক্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ

ইজতেমার সাদপন্থিদের নিষিদ্ধের দাবিতে কুষ্টিয়ায় হেফাজতের বিক্ষোভ

ইজতেমার সাদপন্থিদের নিষিদ্ধের দাবিতে কুষ্টিয়ায় হেফাজতের বিক্ষোভ

কুষ্টিয়া জেলা সমিতি ঢাকার দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে শেখ সাদী সভাপতি, আবুল হোসেন মহাসচিব নির্বাচিত

কুষ্টিয়া জেলা সমিতি ঢাকার দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে শেখ সাদী সভাপতি, আবুল হোসেন মহাসচিব নির্বাচিত

সভাপতি মিজানুর ও সা. সম্পাদক আ. হাই নির্বাচিত

সভাপতি মিজানুর ও সা. সম্পাদক আ. হাই নির্বাচিত

মাদরাসা শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য- মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী

মাদরাসা শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অগ্রগণ্য- মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী

চট্টগ্রামে ম্যারাথন অনুষ্ঠিত

চট্টগ্রামে ম্যারাথন অনুষ্ঠিত

নির্দিষ্ট সময়েও শেষ হয়নি রাস্তার কাজ, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার

নির্দিষ্ট সময়েও শেষ হয়নি রাস্তার কাজ, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার

কেরানীগঞ্জে বন্ধুকে হত্যার ঘটনায় ঘাতক বন্ধু আল আমিন গ্রেফতার

কেরানীগঞ্জে বন্ধুকে হত্যার ঘটনায় ঘাতক বন্ধু আল আমিন গ্রেফতার

সস্ত্রীক লন্ডনে গেলেন মির্জা আব্বাস

সস্ত্রীক লন্ডনে গেলেন মির্জা আব্বাস

চট্টগ্রাম ইপিজেডে শ্রমিক সংঘর্ষে আহত অর্ধশত

চট্টগ্রাম ইপিজেডে শ্রমিক সংঘর্ষে আহত অর্ধশত

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার: রিজভী

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার: রিজভী

পটুয়াখালীতে ইমামের উপর সাদপন্থিদের হামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন

পটুয়াখালীতে ইমামের উপর সাদপন্থিদের হামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন

দেশ গড়ার কাজে অন্তর্বর্তী সরকার অভিজ্ঞ নয় : মান্না

দেশ গড়ার কাজে অন্তর্বর্তী সরকার অভিজ্ঞ নয় : মান্না

ভৈরবে ট্রেনের টিকেটসহ দুই কালোবাজারিকে আটক

ভৈরবে ট্রেনের টিকেটসহ দুই কালোবাজারিকে আটক

গণিতের জগতে মেয়েদের জায়গা তৈরিতে ড. অ্যাঞ্জেলার মিশন

গণিতের জগতে মেয়েদের জায়গা তৈরিতে ড. অ্যাঞ্জেলার মিশন

জাতীয় ঐক্যে অনেকেই ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে : মির্জা ফখরুল

জাতীয় ঐক্যে অনেকেই ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে : মির্জা ফখরুল