আল-আকসার বিজয় ও গাজী সালাহউদ্দীন আইয়ুবী
০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৫ এএম

মৃত্যুশয্যায় শায়িত মহাবীর সাইফুল্লাহিল মাসলুল খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলেন। কান্নার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমার শরীরে তাকিয়ে দেখ। একটি আঙুলের সমান জায়গাও কি বাকি আছে যেখানে আঘাতের চিহ্ন নেই? আজ আমাকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে বিছানায় শুয়ে। বড় স্বাদ ছিল আল্লাহর রাহে শহীদ হবো। উলামায়ে কেরাম বলেন, খালিদকে (রা.) স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করতেই হতো। কারণ সায়্যিদে কাউনাইন (সা.) তাঁকে সাইফুল্লাহ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। যদি খালিদ যুদ্ধাবস্থায় শত্রুর আঘাতে প্রাণ দিতেন, তবে মনে হতো আল্লাহর তরবারি ভেঙ্গে গেছে; এমনটি হতেই পারেনা। কার্যসমাধা শেষে আল্লাহ তাঁর তরবারিটি নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
খালিদের (রা.) তিরোধানের ৪৯৫ বছর পর, ১১৩৭ সালে ইরাকের তিকরিতের এক কুর্দি পরিবারে নজমুদ্দীন আইয়ুবের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন আল্লাহর আরেক তরবারি। নজমুদ্দীন পুত্রের নাম রাখেন ইউসুফ। গভর্নর নিজামুল মুলকের মাদরাসায় পড়ালেখা করে কেটে যায় বাল্যকাল। জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পাশাপাশি দামেস্কের আমীর সুলতান নুরউদ্দীন জংগীর (রহ.) নিকট সামরিক প্রশিক্ষণ নেন ইউসুফ। এরপর চাচা আসাদুদ্দীন শিরকুহ’র তত্ত্বাবধানে ফাতেমী শাসক আল-আদীদের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রসঙ্গত, আব্বাসি খেলাফতের ক্ষয়িষ্ণুতাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম বিশ্বের নানাদিকে প্রচুর স্বতন্ত্র শাসন গড়ে উঠেছিল। ফাতেমীরা ছিল এর অন্যতম।
শিরকুহ’র মৃত্যুর পর আল-আদীদ ইউসুফকে মিশরের গভর্নর পদে আসীন করেন। নুরউদ্দীন প্রতিবাদ করেননি। তিনি জানতেন, শিয়া শাসকের অধিনে উজির হলেও ইউসুফ একনিষ্ঠ সুন্নী এবং তাঁরই হাতে গড়া তাসাউফের অভিনিবিষ্ট খাদিম। ১১৬৯ সালে নুরউদ্দীন জংগীর নির্দেশনায় ইউসুফ প্রথমবার ক্রুসেডারদের বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বিজয় লাভ করেন। ইতোমধ্যে তাঁর ইউসুফ পরিচয়টি হারিয়ে গেছে। তিনি হয়ে উঠেছেন আল্লাহর সিংহ সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী। ইতিহাস আরেক খালিদের উপাখ্যান রচনা করবে বলে কলম-কালি প্রস্তুত করছে।
৬৩৭ সাল। উত্তপ্ত সাহারা পেরিয়ে বাইতুল মুকাদ্দাসের পানে ছুটে চলেছেন আমিরুল মু’মিনীন উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)। বহুদিন ধরে জেরুজালেম অবরোধ করে রেখেছে আবু উবায়দাহ ইবনে জাররাহ (রা.) এবং খালিদের (রা.) নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনী। খ্রিস্টানদের দাবী, তারা খলিফার হাতেই জেরুজালেম সোপর্দ করবে। অবশেষে উমর (রা.) জেরুজালেমে পদার্পণ করলেন। উম্মতে মুহাম্মাদির হাতে আল-কুদস বিজিত হল। মুসলমানদের প্রথম কিবলায় আযানের ধ্বনি শোনা গেল।
ইউরোপের খ্রিস্টানরা ক্রুশ ছুঁয়ে জেরুজালেম পুনর্দখলের শপথ করল। ১০৯৯ সালে আব্বাসি ও ফাতেমী খেলাফতের দৈন্যতা এবং কতিপয় স্বার্থপর মুসলিম শাসকের ভীরুতার সুযোগে সারা ইউরোপ একজোট হয়ে আক্রমণ করল সিরিয়া ও ফিলিস্তিন। রক্তের বন্যা বইয়ে জেরুজালেমের দখল করল ক্রুসেড বাহিনী। প্রায় ৭০ হাজার মুসলিম নর-নারীকে চরম নির্মমতায় শহীদ করা হল। ক্রুসেডারদের ঘোড়ার পা মুসলমানদের রক্তে ডুবিয়ে সম্পন্ন হল খ্রিস্টানদের প্রথম ক্রুসেড। ৪৬২ বছর পর আল-কুদস আবার খ্রিস্টানদের দখলে চলে গেল। শিশুকাল থেকেই সালাহুদ্দীন শুনে আসছিলেন প্রথম ক্রুসেডের সেই মর্মান্তিক পরাজয় গাঁথা। কেমন একটি অনুভূতি যেন নাড়িয়ে যাচ্ছিল তাঁর শিশু-মন।
ঐতিহাসিক আল-মাকরিযি বলেন, ‘সালাহুদ্দীনের বাল্যকাল গড়ে উঠেছিল তাসাউফের স্নিগ্ধ পরিবেশে। বাল্যকালেই তিনি কুরআনুল কারীম এবং ইমাম মালিকের (রহ.) মুয়াত্তা পাঠ করেছিলেন। কুরআন শরীফের তিলাওয়াত ছিল তাঁর হৃদয়ের খোরাক। শায়েখ কুতবুদ্দীন আবুল মা’আলী নিশাপুরীর (রহ.) নিকট থেকে সালাহুদ্দীন তাসাউফের সবক গ্রহন করেন। সালাহুদ্দীন ছিলেন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী। মিশরে অবস্থানকালে তিনি তথায় শাফেয়ী, মালিকি এবং হানাফি মাযহাবের মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’
আল-মাকরিযি সালাহুদ্দীনের একান্ত সহচর বাহাউদ্দীন ইবনে শাদ্দাদের বরাত দিয়ে লিখেছেন : ‘সালাহুদ্দীনের সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য ছিলেন সুলতানুল আউলিয়া সায়্যিদ আব্দুল কাদির জিলানীর (রহ.) মাদরাসা থেকে আগত এবং তাঁর মুরিদান। কতিপয় সৈন্য ছিলেন ইমাম গাযালীর (রহ.) প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা নিযামিয়ার ছাত্র। এরা বিভিন্ন মাযহাব এবং সুফি তরিকার অনুসারী ছিলেন। যখন সালাহুদ্দীন জেরুজালেম অভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন, তখন তাঁর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন বিখ্যাত ফকীহ ইবনে কুদামাহ হাম্বলি (রহ.)।’ সালাহুদ্দীনের মূল শক্তি ছিল তাঁর ঈমান ও তাকওয়া। দীর্ঘ ৮৮ বছর ক্রুসেডাররা বাইতুল মুকাদ্দাস কেবল নিজেদের শক্তি বলেই দখল করে রাখেনি। বিভক্ত মুসলিম বিশ্বের কতিপয় লোভি শাসককে নারী, মদ ও ঐশ্বর্যের টোপ দিয়ে অক্ষম করে রেখেছিল খ্রিস্টানরা। কিন্তু এসব আবর্জনার একটি ছিটাও আল্লাহর ওলী সালাহুদ্দীনের পদতল স্পর্শ করতে পারেনি।
১১৭০ সালে দারুম অবরোধ ও বিজয়ের মাধ্যমে সালাহুদ্দীনের ফিলিস্তিন অভিযানের সূচনা হয়। ১১৭১ সালে নুরউদ্দীন জংগীর পরামর্শে সালাহুদ্দীন মিশরকে আব্বাসি খেলাফতের অধীনস্থ করেন। এরপর কেরাক ও মন্ট্রিয়াল অভিযানে বের হন। ১১৭৪ সালে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সুলতান নুরউদ্দীন জংগী (রহ.) শাহাদাত বরণ করলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন সুলতান সালাহুদ্দীন। সে বছরই ক্রুসেডারদের দখলকৃত সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে তিনি বিজয় লাভ করেন। কুচক্রী মহল নুরউদ্দীন জংগীর বালক-পুত্রকে সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেও জনগণ সালাহুদ্দীনকেই সুলতান বলে গ্রহন করে। কৌশলে জংগী বংশের সাথে সংঘাত এড়িয়ে মিশরে ফিরে এসে সালাহুদ্দীন মিশরের উন্নয়নে হাত দেন। ১১৭৭ সালে ক্রুসেডাররা যখন সিরিয়া পুনর্দখলে ব্যস্ত, তখন সালাহুদ্দীন আসকালানে অভিযান করে ক্রুসেডারদের ভীত কাঁপিয়ে দেন। একদিকে তাঁকে সামলাতে হচ্ছিল ক্রুসেডারদের, অন্যদিকে দমিয়ে রাখতে হচ্ছিল লোভি শাসকদেরকে।
হাজারো প্রতিকূলতা মাড়িয়ে সালাহুদ্দীনের বাহিনী ১১৮২ সালে আইন জালুতে হাজির হয়। ওদিকে ক্রুসেড নেতা গাই অব লুসিগনান তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসে। কৌশলে তার পথ রুদ্ধ করে সালাহুদ্দীন ক্রুসেডারদেরকে দুটি শিবিরে ভাগ করে ফেলেন। বিভক্ত ক্রুসেডাররা সহজেই পরাভূত হয়। সালাহুদ্দীনের বাহিনী সামনে এগিয়ে গিয়ে মুখামুখি হয় রেনাল্ড অব শালিটনের। এই রেনাল্ড সর্বদা হজযাত্রীদের আক্রমণ করত এবং রাসুলুল্লাহ (স.)-কে অকথ্য গালিগালাজ করত। সালাহুদ্দীন তাকে হত্যা করার শপথ করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থ সালাহুদ্দীন এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেননি। বড় বিজয়ের পূর্বে এই ছোট ধাক্কাটি মুসলিম বাহিনীর জন্য একটি পরীক্ষা ছিল।
১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মাহে রামাদ্বানের শেষ রাত। দুনিয়া বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। সালাহুদ্দীন তাঁর বাহিনী নিয়ে সারাটি রাত সালাতুত তারাবীহ ও কিয়ামুল লাইলে কাটিয়ে দিলেন। মালিকের দরবারে ফরিয়াদ করলেন- আল্লাহ, আজ যদি আমাদের জীবনের শেষ তারাবীহ হয়ে থাকে, তবে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে এটুকু প্রার্থণা করছি মাবুদ, বাইতুল মুকাদ্দাসকে তুমি জয় করে দাও। ৩০ রামাদ্বান সকালে গাই অব লুসিগনান এবং রেনাল্ড অব শালিটনের সম্মিলিত বাহিনীর বিপক্ষে চুড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় সালাহুদ্দীনের মুসলিম বাহিনী। সংঘটিত হয় সাহাবায়ে কেরাম-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ যুদ্ধ- জঙ্গে হিত্তিন। রক্তক্ষয়ী এ লড়াইয়ে সালাহুদ্দীনের বীরত্বগাঁথা ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে।
সামনেই জেরুজালেম। ২রা অক্টোবর রাজা বেলিয়ানকে সহজেই অবরুদ্ধ করে মুসলিম বাহিনী। জেরুজালেমের রাজতোরণ উন্মোচিত করে বিজয়ীর বেশে মাসজিদুল আকসায় প্রবেশ করেন বীর মুজাহিদ সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী। সেজদায় লুটিয়ে পড়েন মহান রবের সামনে। সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় ক্রুসেড। আমাদের প্রথম কিবলা আমাদের হাতে ফিরে আসে।
পরাজিত সব খ্রিস্টান রাজাদেরকে বিনা বিচারে দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন সালাহুদ্দীন। যুদ্ধের ময়দান ব্যতীত ইউরোপের কোন রাজা (রেনাল্ড ব্যতীত), কোন সামরিক-বেসামরিক বাহিনীকে তিনি হত্যা করেননি, করতেও দেননি।
৮৮ বছর আগে এই ক্রুসেডারদের হাতে ঝরা ৭০ হাজার মুসলমানের সমুদ্রসম রক্তের কোন প্রতিশোধ নেননি সালাহুদ্দীন। রাহমাতুল্লিল আলামিন (স.)-এর মক্কা বিজয়ের অনুপম আদর্শ তাঁর হৃদয়পটে জ্বলজ্বল করছিল। ত্যাগ ও বদান্যতার দরূণ তিনি শত্রুশিবিরেও সমাদ্রিত ছিলেন। আজো ইউরোপে তিনি ঞযব এৎবধঃ ঝধষধফরহ নামে প্রশংসিত। ১১৯১ সালে গাই অব লুসিগনান ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্টকে সঙ্গে নিয়ে তৃতীয় ক্রুসেড পরিচালনা করে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর সালাহুদ্দীন তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেন। বিজয় অভিযান সমাপ্ত হয়। দামেস্কে ফিরে গিয়েই সালাহুদ্দীন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্লান্ত দেহখানি আর সঙ্গ দিচ্ছেনা। ১১৯৩ সালের ৪ঠা মার্চ মুসলিম জাহানকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ইন্তেকাল করেন ইমামুল মুজাহিদীন সুলতানুল মুসলিমিন গাজী আবু নাসির সালাহুদ্দীন ইউসুফ আইয়ুবী।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ২৫ ফিলিস্তিনি

১৫ বছর পর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবরা বৈঠকে বসছেন আজ

উখিয়ায় পৃথক সড়ক দূর্ঘটনায় ১ শিশু নিহত ও আহত ৬

আবারও নিষেধাজ্ঞা পেলেন জহির

সখিপুরে প্রবাসীর স্ত্রীর লাশ উদ্ধার

আইপিএলে সন্দিপের অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ড

ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে নিষিদ্ধ ইংলিশ পেসার

আমিরাতে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সম্মানে বাংলাদেশ দূতাবাসের জমকালো অনুষ্ঠান

সেই বার্নাব্যুতে রিয়ালকে হারিয়েই সেমিত আর্সেনাল

স্টার্কের দুর্দান্ত বোলিংয়ে সুপার ওভার রোমাঞ্চ জিতল দিল্লী

সড়ক বিহীন সেতু,কাজে আসছেনা এলাকাবাসীর

দুর্নীতির অভিযোগে নওগাঁ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দুদকের অভিযান

কলাপাড়ায় একটি ছাগলকে কেন্দ্র করে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘর্ষে, আহত-৪

ফ্যাসিস্টের পতন হয়েছে কিন্তু বিএনপি নিয়ে ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে -মিজান চৌধুরী

উইন্ডিজকে হারালেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ

গাজায় মানবিক সহায়তা নিষিদ্ধ ঘোষণা ইসরায়েলের, সংকট তীব্র

টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় ড. ইউনূস

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে প্রজ্ঞাপন জারি

সুন্নত নামাজে ভুল করে নামাজ শেষ করে ফেলা প্রসঙ্গে?

কূট-কৌশলে ভিআইপিদের টার্গেট করতেন মেঘনা আলম চক্র