মানবজীবনে ওয়াদা রক্ষার গুরুত্ব
২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৫ এএম
‘ওয়াদা’ আরবী শব্দ। এর মানে চুক্তি, অঙ্গীকার। ওয়াদা রক্ষা করা সৎ লোকের অন্যতম গুণ। ওয়াদার বিপরীত করা হীন লোকের স্বভাব। যারা ওয়াদা রক্ষা করে না, মানুষ তাদেরকে বিশ্বাস করে না। যারা ওয়াদা রক্ষা করে না তারা পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির কাছে অপমানিত হয়। পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় ওয়াদা পূরণের গুরুত্ব অপরিসীম। ওয়াদা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন : (১) ‘তোমরা ওয়াদা পূরণ করিও, নিশ্চয়ই ওয়াদা সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে’ (সূরা বনি ইসরাইল : আয়াত-৩৪)। (২) ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করবে’ (সূরা মায়িদা : আয়াত-১)। (৩) ‘স্মরণ কর, যখন আল্লাহপাক নবীদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, ‘তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি তার শপথ, আর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসূল আসবে তখন নিশ্চয়ই তোমরা তাকে বিশ্বাস করবে এবং তাকে সাহায্য করবে’। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে?’ তারা বলল, আমরা স্বীকার করলাম’। তিনি বললেন, ‘তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম’ (সূরা আল-ইমরান : আয়াত-৮১)। (৪) ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের’ (সূরা ফাতাহ : আয়াত-২৯)। উক্ত আয়াতগুলোতে ওয়াদা রক্ষার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
ওয়াদা রক্ষার জন্য হাদীসে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। (১) হযরত আনাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই এবং যার মধ্যে অঙ্গীকারের মূল্য নেই তার দ্বীনও নেই’ (বায়হাকী)। (২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে, সে পাক্কা মুনাফিক এবং যার মধ্যে তার একটি স্বভাব থাকবে, তার মধ্যে মুনাফিকীর একটি স্বভাব থাকবে, যে পর্যন্ত না সে তা পরিহার করে-(১) যখন তার কাছে কিছু আমানত রাখা হয় তাতে সে খিয়ানত করে। (২) সে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে। (৩) সে যখন ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে। (৪) যখন কারও সাথে কলহ করে, তখন সে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে’ (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত : পৃষ্ঠা-১৭)। (৩) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুনাফিকের আলামত হচ্ছে তিনটি-যখন সে কথা বলে, মিথ্যা বলে। যখন সে ওয়াদা করে, ভঙ্গ করে। যখন তার কাছে কোনো কিছু আমানত রাখা হয়, তাতে সে খিয়ানত করে’ (বুখারী ও মুসলিম) কিন্তু মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এটাও রয়েছে যে, যদিও সে নামাজ পড়ে, রোজাও রাখে এবং মনে করে যে, সে মুসলমান (মুসলিম ১ম খ- : পৃষ্ঠা-৫৬, মিশকাত : পৃষ্ঠা-১৭)।
(৪) হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নিজেদের পক্ষ থেকে আমাকে ছয়টি বিষয়ের জামানত দাও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জামিন হব-(১) যখন তোমরা কথা বলবে, তখন সত্য বলবে। (২) যখন ওয়াদা কর তা পূর্ণ করবে। (৩) যখন তোমাদের কাছে আমানত রাখা হয় তা আদায় করবে। (৪) নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে। (৫) আপন দৃষ্টিকে অবনত রাখবে। (৬) আপন হস্তকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে’ (আহমদ, বায়হাকী, মিশকাত : পৃষ্ঠা-৪১৫)। মানবজীবকে ওয়াদা রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। আগেকার মুসলমানগণ কিভাবে ওয়াদা রক্ষা করতেন তার কয়েকটি উদাহরণ উপস্থাপন করা হল : (১) হযরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে জেরুজালেম বিজিত হলে সেখানে যে সকল অমুসলিম ছিল, তাদের সাথে মুসলমানদের পক্ষ থেকে এ চুক্তি করা হলো যে, আমরা তোমাদের জানমালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব। এর বিনিময়ে তোমরা আমাদেরকে জিজিয়া (নিরাপত্তা কর) প্রদান করবে। চুক্তি অনুযায়ী অমুসলিমগণ প্রতি বছর জিজিয়া প্রদান করতো। এক সময় জেরুজালেমে নিয়োজিত সৈন্যদের অন্যত্র জিহাদে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। বিষয়টি খলিফাকে জানানো হলে তিনি বললেন, জিহাদের মাঠে সৈন্য প্রেরণের পূর্বে জেরুজালেমে বসবাসকারী অমুসলিমদেরকে একত্রিত করে ঘোষণা দাও যে, ‘আমরা তোমাদের জানমালের হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম এবং এ লক্ষ্যে সৈন্য মোতায়ন করেও রেখেছিলাম। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে এখন আমরা সৈন্য সরিয়ে নিচ্ছি। এজন্য আমরা তোমাদের তত্ত্বাবধান করতে পারবো না। তাই এ বছর তোমরা আমাদেরকে যে জিজিয়া প্রদান করেছ, তা আমরা ফিরিয়ে দিচ্ছি। এখন আমরা তোমাদের নিকট থেকে ওয়াদামুক্ত। সুতরাং আজ থেকে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেরাই করতে হবে।
(২) হযরত মুআবিয়া (রা.) যখন সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন, তখন পাশ্ববর্তী সা¤্রাজ্য রোমের সাথে প্রায়ই তার যুদ্ধ হতো। একবার তাদের সাথে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হল। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বে হযরত মুআবিয়া (রা.) সৈন্য নিয়ে বের হয়ে পড়েন। সীমান্ত এলাকায় গিয়ে সৈন্য বিন্যস্ত করে রাখেন। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তিনি সৈন্য বাহিনীকে সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। প্রতিপক্ষ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত, তাই মুসলিম বাহিনীর গতিরোধ করতে পারেনি। তারা একটির পর একটি জনপদ জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তাদের মধ্যে বিজয়ের উল্লাস। ঠিক এমন সময় ঘোড়া ছুটিয়ে উপস্থিত হন প্রিয় নবীর প্রিয় সাহাবী হযরত আমর ইবনে আব্বাসা (রা.)। তিনি হযরত মুআবিয়া (রা.)-কে লক্ষ্য করে বললেন, ওয়াদা পূর্ণ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। ভঙ্গ করা নয়। হযরত মুআবিয়া (রা.) ব্যথিব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার! আমরের জবাব! ‘আমি রাসূল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যুদ্ধ বিরতির সময় হামলা করা যেমন অবৈধ, তেমনি হামলার উদ্দেশ্যে সৈন্য মোতায়েন করাও অবৈধ।’ এ কথা শুনামাত্রই হযরত মুআবিয়া (রা.) নির্দেশ দিলেন, যতটুকু এলাকা আমাদের দখলে এসেছে, তা ফিরিয়ে দাও। সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম বাহিনী সম্পূর্ণ বিজিত এলাকা প্রত্যার্পণ করে নিজ এলাকায় প্রত্যাবর্তন করলেন।
(৩) একদিন হযরত ওমর (রা.) বসে আছেন দরবারে। পাশে উপবিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম অনেকেই। এমন সময় দুই যুবক অন্য এক যুবককে ধরে নিয়ে হযরত ওমর (রা.) এর দরবারে প্রবেশ করে সমস্বরে বলে উঠলো, আমিরুল মুমিনীন! এ জালিম আমাদের পিতাকে হত্যা করেছে। আমরা আপনার কাছে এর বিচার চাই। হযরত ওমর (রা.) তখন ঘাতকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সম্পর্কে এরা যা বললো তা কি সত্য? ঘাতক বলল, হ্যাঁ। ওমর (রা.) বললেন, তুমি যা করেছ তার বিচার তো একমাত্র মৃত্যুদ-। ঘাতক বলল, শরীয়তের হুকুম এবং খলিফার রায় মানতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আমার একটি আবেদন আছে। আবেদন হলো-আমার একটি ছোট ভাই আছে। যার জন্য আমার মরহুম পিতা সামান্য সোনা আমার কাছে রেখে গেছেন। আমি এগুলো এক জায়গায় পুতে রেখেছি। এ-খবর আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। এই মুহূর্তে যদি আমাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়, তবে ভাইটি সম্পদ থেকে বঞ্চিত হবে। আর কিয়ামতের দিন আমি দায়ী হব। তাই আমাকে তিন দিনের জন্য জামিনে ছেড়ে দেওয়ার আবেদন করছি।
খলিফা ওমর (রা.) একটু ভেবে বললেন, সুযোগ দেওয়া যায়। কিন্তু তোমার জামিন হবে কে? লোকটি দরবারে উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমার মুসলমান ভাইগণ! সন্দেহ নেই আপনারা কেউ আমাকে চিনেন না। কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি ওয়াদা খেলাপ করবো না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমি এসে যাবো। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি আমার জামিন হোন তাহলে আমার দায়িত্বটি পূর্ণ হতে পারে। এ কথা শুনে হযরত আবু জর গিফারী (রা.) তার জামিন হলেন। লোকটি ছাড়া পেয়ে চলে গেল। তৃতীয় দিন দরবার যথারীতি বসলো। জামিনদার আসামীর অপেক্ষায় রইলেন। সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আসামীর কোনো পাত্তা নেই। হযরত ওমর (রা.) ঘোষণা করলেন, আসামী যদি না আসে তবে আবু জরের উপর সে হুকুম কার্যকরী হবে, সেটা ইসলামী বিধান মতে প্রযোজ্য। আবু জর (রা.) বলে উঠলেন, খোদার কসম! আমি জানামত পূর্ণ করবো। এরূপ কথাবার্তা হচ্ছে-এমন সময় আসামী হাজির। সালাম দিয়ে দরবারে প্রবেশ করে বলল, ‘আমি দায়িত্ব পালন করে এসেছি। এখন আমার উপর শাস্তি প্রয়োগ করুন। আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত।’ আসামীর সততায় মুগ্ধ হয়ে এ মুহূর্তে বাদীদ্বয় বলে উঠলো-‘আমিরুল মুমিনীন! আমরা আমাদের পিতার রক্তের দাবী মাফ করে দিলাম’।
ওয়াদা রক্ষা করা সৎলোকের অনুপম বৈশিষ্ট্য। ওয়াদা রক্ষায় ব্যর্থ হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে অনেক বিপর্যয় দেখা দেয়। ওয়াদা রক্ষায় অলসতা করা মোটেই উচিত নয়। সকল প্রকার ওয়াদা রক্ষায় ইস্পাত কঠিন সংকল্প নিয়ে এগিয়ে আসা আমাদের সকলের উচিত।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শেষ বিকেলে লুইস-অ্যাথানেজের 'আক্ষেপে' ম্যাচে ফিরল বাংলাদেশে
রানআউট হজ,লুইসের ব্যাটে এগোচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
জমকালো 'কনটেনন্ডার সিরিজ',কে কার বিপক্ষে লড়বেন?
তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল
অবশেষে ২৬ মামলার আসামি কুমিল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী আল-আমিন গ্রেফতার
'জুলাই অনির্বাণ’ এ রক্তপিপাসু হাসিনার নির্মমতা দেখে কাঁদছেন নেটিজেনরা
দেশনেত্রীর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও সম্মান
বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসহ সরকারের কাজের পরিধি বিশাল
অদক্ষ ফার্মাসিস্ট দ্বারাই চলছে ফার্মেসি
নির্বাচন কমিশন গঠন : গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু
বেনাপোল দিয়ে যাত্রী পারাপার কমেছে অর্ধেক, রাজস্ব আয় ও ব্যবসা বাণিজ্যে ধস
দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম
মসজিদে পরে এসে ঘাড় ডিঙিয়ে সামনের কাতারে যাওয়া জায়েজ নেই
দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সুন্দর জীবন এবং কৃতজ্ঞতাবোধ
যুগে যুগে জুলুম ও জালিমের পরিণতি
সালাম ইসলামী সম্ভাষণ রীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ
করিমগঞ্জের নাম কি আদৌ শ্রীভূমি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
বিশাল স্বর্ণখনির সন্ধান পেলো চীন
মাছ ধরার নৌকার সঙ্গে ভারতীয় সাবমেরিনের সংঘর্ষ
যৌন পর্যটনের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠছে টোকিও : বাড়ছে ভিড়